বাংলাদেশে ভিআইপি কালচারের বিদায়ঘণ্টা

৫৭ পঠিত ... ১৫ ঘন্টা ১৯ মিনিট আগে

27 (9)

জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নতুন রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর তৃতীয় এই রাজনৈতিক শক্তির উত্থান অনিবার্য ছিল। ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতার অর্ধশতক পরে সেখানেও এভাবে তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটেছে। বিংশ শতকের সামন্ত বা জমিদারি প্রথার রাজনীতি দেশগুলোর স্বাধীনতার অর্থ জনজীবনে অনুবাদ করতে পারেনি। বরং বৃটিশ আমলের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত পাওয়া জমিদারদের আদলে গণতন্ত্রের নামে নতুন জমিদার শ্রেণী তৈরি করাই ছিলো বিংশ শতকের রাজনৈতিক দলগুলোর মূল উদ্দেশ্য।

ভারতের ক্ষেত্রে কংগ্রেস দেশটির স্বাধীনতার চেতনার মালিকানা দাবি করে একধরনের খেলনা অভিজাততন্ত্র কায়েমের চেষ্টা করে। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে মুসলিম লীগ একই কাজ করে। কংগ্রেস নেতা নেহেরু ও আবুল কালাম আজাদ বহুত্ববাদী সমাজে বিশ্বাসী হলেও; কংগ্রেসের বেশির ভাগ নেতাই ছিলেন হিন্দুত্ববাদী। তারা ভারতকে হিন্দুস্তান আর পাকিস্তানকে মুসলমানের আবাস বলে বিশ্বাস করতেন। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গ্রাউন্ড জিরো থেকে উঠে দাঁড়িয়ে জার্মানি ও ইউরোপের অন্যান্য দেশ মাত্র বছর দশকের মধ্যে সামাজিক গণতন্ত্রের কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত হলেও; ভারত হয়ে ওঠে বর্ণবাদ আর বৈষম্যের লীলাভূমি। ইউরোপের অনুকরণে এনলাইটেনমেন্টের লিপ সার্ভিস দিলেও; হিন্দুত্ববাদ এর অন্তঃসলিল প্রবাহ হিসেবে মাথাচাড়া দেয়। এসে পড়ে সরাসরি হিন্দুত্ববাদী বিজেপি। আর ইড ইগো ও সুপার ইগোর বশে দক্ষিণ এশিয়ার মোড়ল হয়ে ওঠার ভ্রান্ত চিন্তা ভারতকে কৌতুক উদ্দীপক করে তোলে। কংগ্রেস-এর জমিদারতন্ত্র আর বিজেপির হিন্দুত্ববাদের মাঝ থেকে জনগণের চাওয়া থেকে আত্মপ্রকাশ করে আম আদমি পার্টি; যা প্রমাণ করে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও জনকল্যাণমূলক ব্যবস্থা উপহার দেয়া সম্ভব। কিন্তু হিন্দুত্ব ফ্যাসিজমের চাপে আম আদমি এখন অস্তিত্বের লড়াই করছে।

পাকিস্তানের ক্ষেত্রে মুসলিম লীগ এর নেতা জিন্নাহ'র সেকুলারিজম চর্চা করতে ব্যর্থ হয় দলটির অন্যান্য নেতারা। ফলে মুসলিম লীগের নেতারা ইসলামপন্থার এক খেলনা জমিদার সমাজ গড়ে তোলে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী হাস্যকরভাবে রাজনীতির পাপেট মাস্টার হয়ে ওঠে। ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি সাম্যবাদের শ্লোগান দিয়ে আত্মপ্রকাশ করলেও; তা নতুন জমিদার তৈরির কারখানায় পরিণত হয়। মুসলিম লীগকে সেনাবাহিনি টুকরো টুকরো করলে মুসলিম লীগ নওয়াজ টিকে থাকে পাঞ্জাব প্রদেশের ভোট ব্যাংক সম্বল করে। বার বার সেনাশাসন ও আফঘান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে সাহায্য করতে গিয়ে ইসলামি সন্ত্রাসবাদের শিকারে পরিণত হয় দেশটি। পিপলস পার্টি ও মুসলিম লীগ নওয়াজ-এর জমিদারতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করে আত্মপ্রকাশ করে তেহেরিক ই ইনসাফ পাকিস্তান (পিটি আই)। তারুণ্য ও নারী সমর্থকদের জোরে দলটি পাকিস্তানের ক্ষমতায় গিয়ে প্রমাণ করেছে সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন উপহার দেয়া সম্ভব। কিন্তু দুর্নীতিতে অভ্যস্ত পুরোনো দুটি রাজনৈতিক দল ও সেনাবাহিনীর ষড়যন্ত্রে দলটি এখন অস্তিত্বের লড়াই-এ রয়েছে।

ঔপনিবেশিক প্রভু হিসেবে বৃটিশ রাজনৈতিক নেতা উইনস্টোন চার্চিল একজন নেতিবাচক লোক। কিন্তু ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তানকে স্বাধীনতা দেবার প্রশ্নে তিনি বলেছিলেন, দেখে নিও দেশগুলো শাসন করবে ডাকাতেরা। তার কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে। দেশ ডাকাতির লীলাভূমি ভারতে বৈষম্য বিদীর্ণ মানুষ এখনো কৃষিক্ষেত্রে বর্জ্য ত্যাগ করে, আর পাকিস্তানে বৈষম্য জীর্ণ মানুষ অর্ধাহারে-অনাহারে বাঁচে। হিন্দু ভারত আর মুসলমান পাকিস্তানের গ্রাম্য ইগোর লড়াইয়ে পৃথিবীর দোজখ হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশ একটি গ্রাম ভিত্তিক রাষ্ট্র। ফলে এখানে আমরা যা দেখি, তা মূলত ভিলেজ পলিটিক্স। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার লিপ সার্ভিস দিয়ে ভারতের কোলে বসে আওয়ামী লীগ এখানে দিল্লি শাসনের অধীনে নেহাত সুবেদার হিসেবে দেশ লুন্ঠন ও মানবতা বিরোধী অপরাধ করেছে। গ্রামের লোকের শহুরে এলিট হবার আকাংক্ষাই বাংলাদেশের রাজনীতি। আওয়ামী লীগের এন্টিথিসিস হিসেবে গড়ে ওঠা বিএনপিও তাই আদর্শ বলতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার লিপ সার্ভিস দিয়ে রুলিং এলিট হবার স্বপ্নে বুঁদ। কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষের জীবনে মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারের অনুবাদ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতির মাধ্যমে ঘটেনি। আগে দুটি দলের মধ্যে মন্দের ভালো সার্টিফিকেট পেয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ২০০৯-২৪ মানবতাবিরোধী অপরাধ করে ক্যানিবালিজমের রাজনীতি প্রচলন করেছে। এখন আবার বিএনপি মন্দের ভালো সার্টিফিকেট পেয়ে ‘আরেকটিবার ক্ষমতা দেরে সখা, চেয়ারটি যে চাই’ সংগীত পরিবেশন করছে। দক্ষিণ এশিয়া গ্রামের মাতবর ভারতের পছন্দের পাত্র হবার আকুলতাও উপস্থিত তার চোখে। কারণ ভারত আওয়ামী লীগকে স্ত্রীর মতো ভালোবাসে আর বিএনপিকে একদা প্রেম প্রত্যাখানকারী প্রেমিকার মতো অপছন্দ করে বলে; ১৮ বছর ক্ষমতার বাইরে বিএনপি।

বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানি বন্দোবস্ত থেকে তারুণ্য মুক্তি দিয়েছিলো। কিন্তু মাতবর ভারত এসে ছায়া উপনিবেশ গড়লে অবশেষে ২০২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশ পরিপূর্ণ সার্বভৌমত্ব অর্জন করে। দিল্লির কর্মচারি দিল্লিতে পালিয়ে গেলেও দিকে দিকে ভারতীয় নাগিনীরা ফেলিতেছে বিষ নিঃশ্বাস। এই পরিস্থিতিতে তারুণ্য ছাড়া আর কেউ নেই বাংলাদেশের।

বিংশ শতকের জাঢ্য জরদগব দলান্ধ ও ধর্মান্ধ অচল মানুষেরা এই তারুণ্যের শত্রু। গ্রাম্য রুলিং এলিট সিস্টেমটা দলকানা ও ধর্মকানা লোকেদের খুব পছন্দের বন্দোবস্ত। তারা একবিংশের তরুণের বিশ্ববীক্ষা ও আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজকে বুঝতে অক্ষম। তবে আশার কথা ঢাকার বাইরে বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে যে স্বশিক্ষিত মানুষেরা রয়েছেন; তারা জুলাইয়ের বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে সাড়া দিয়েছিলেন। কারণ তারা বিংশ শতকের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোর ক্যাডারদের চাঁদাবাজি ও দখলবাজিতে নির্যাতিত। মুক্তিযুদ্ধ থেকে চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থান কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষ; রক্ত দিয়েছে, ত্যাগ করেছে, সন্তান হারানোর বেদনায় লীন হয়েছে; তারপর ফিরে গেছে দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে। কিন্তু ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো কোন পরিশ্রম না করে দেশলুন্ঠন করে জমিদার হয়েছে। চোখের সামনে পার্টির টিকেটে ফইন্নি এলিট হয়েছে। ভিখিরির ছেলে ভি আই পি সেজে নির্দেশ করেছে, আমাকে স্যার বলে ডাকবি।

চব্বিশের ছাত্র গণ অভ্যুত্থান পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়, বাংলাদেশের নারী সমাজ ও শ্রমিক সমাজ বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের ডাকে সাড়া দিয়ে অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। বাকি যেসব নক্সী পোশাক পরে সংস্কৃতি করে বেড়ানো ফাঁপা সমাজ; এরা ৫ অগাস্ট সন্ধ্যা থেকেই বিজেপিতে লীন আফসোস লীগ। এরা গ্রাম থেকে এসে শহুরে বাবু কালচার শিখে ভাবছে; ঐটাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সংস্কৃতি। এরা শিক্ষিতের ভং ধরে থাকলেও ইংরেজিতে দুর্বল। ফলে এদের আলোর দৌড় কলকাতার বেঙ্গল রেনেসাঁ পর্যন্ত। অন্যদিকে টেকস্যাভি জেন জি ইন্টারনেটের জানালা খুলে ইউরোপের এনলাইটেনমেন্ট দেখেছে, আরব বিশ্বের সুফি ভাবনার আলো পেয়েছে; চিন্তাজগতে সাম্যই যে আধুনিকতা সেই সোনালি সূত্র জেনেছে। ফলে বাংলাদেশের মেহনতি মানুষের সঙ্গে এদের সম্পর্ক ও ভালোবাসা মৌলিক।

তাই বিংশ শতকের জমিদারির চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হারানোর ভয়ে ভীত আউটডেটেড লোকেদের খোয়ারিকে অবজ্ঞা করে একবিংশের বাংলাদেশ তারুণ্য যদি এগিয়ে যেতে পারে; জাদুবাস্তবতার সমৃদ্ধ এই ব-দ্বীপ মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে আত্মনির্ভর উন্নয়ন কৌশল নিয়ে; নিজস্ব সংস্কৃতিকে দাঁড় করাতে পারবে বিশ্বসংস্কৃতির আলোক সরণিতে।

৫৭ পঠিত ... ১৫ ঘন্টা ১৯ মিনিট আগে

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top