হল না, বিশ্ববিদ্যালয়ের নামটাই ফকা চৌধুরীর নামে রাখেন

২২৪ পঠিত ... ১১ ঘন্টা ৪৯ মিনিট আগে

34

ফকা চৌধুরীর পুরো নাম ফজলুল কাদের চৌধুরী। তিনি ছিলেন তৎকালীন পাকিস্তান মুসলিম লীগের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানীদের আস্থাভাজন হিসেবে পাকিস্তান আমলে তিনি জাতীয় পরিষদের স্পিকার ও ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তিনি এবং তার সূর্যসন্তান সালাউদ্দিন কাদের ওরফে সাকা চৌধুরীর অবদান অপরিসীম। তারা দুজনেই একই পথের যাত্রী হয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করেছেন। 

চট্টগ্রামে শান্তি কমিটি, রাজাকার বাহিনী, আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠনে ফার্স্ট লাইন ভূমিকা পালন করেন এই পিতা পুত্র যুগল। পাকিস্তানের দালাল হিসেবে তাদের ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২৫ মার্চ ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের অভিযানে ঢাকায় যখন পাকিস্তানি বাহিনী ব্যাপক হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে, তখন চট্টগ্রামে ফকা চৌধুরী ও তার ছেলে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে প্যারা মিলিশিয়া বাহিনী গড়ে তোলেন।

গুডস হিল নামে তাদের চট্টগ্রামে একটি বাড়ি ছিল।

এই বাড়িটি ব্যবহার হতো নির্যাতনের কেন্দ্র হিসেবে। ফকা-সাকার গুডস হিলে বন্দীদের জন্য অপেক্ষা করত ভয়ংকর সব শাস্তি।

পানির পিপাসায় কাতর হয়ে গেলে বন্দীদের প্রস্রাব দেওয়া হতো। এরা সেইসব মানুষ যারা চেয়েছিল পাকিস্তানের সায়ার নিচে লুকিয়ে থাকতে। এরা সেইসব মানুষ যারা স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছিলেন।

সেক্টরস কমান্ডার্স ফোরাম শীর্ষ পঞ্চাশ যুদ্ধাপরাধীর এক তালিকা তৈরি করে। সেই তালিকায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও ফজলুল কাদের চৌধুরীর অবস্থান যথাক্রমে ১৫ ও ১৬ নং। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল স্বীকৃত এই যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয় তৎকালীন ইন্টার দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নিজাম উদ্দিন আহমেদ। ১৫তম এই সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। তার বর্ণনা থেকেই তুলে ধরছি কিছু অংশ।

‘১৯৭১ সালে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরীর নির্দেশে দুই বন্ধুসহ আমাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় গুডস হিলে। জিন্নাহ টুপি পরা ফজলুল কাদের চৌধুরীর সামনে যখন আমাদের হাজির করা হয়, তখন তিনি আমাদের দেখেই উত্তেজিত হয়ে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল শুরু করে দেন এবং বলেন, ‘তোরা মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গেছিস!’ এরপর তিনি (ফজলুল কাদের) আমাকে জাপটে ধরে ঘুষি মেরে বলেন, ‘তোরা জয় বাংলা জয় বাংলা করছিস, আর হিন্দুরা ধুতির কোচা নাড়ছে।’

আমাদের দেখিয়ে তিনি সেখানে উপস্থিত তার লোকদের নির্দেশ দেন, ‘ওদের বানাও’। এরপর ফজলুল কাদের চৌধুরীর নির্দেশে আমাদের উপর অকথ্য নির্যাতন করা হয়।

নিজাম উদ্দিন আরও বলেন, ‘এরপর আমাদের তিনজনকে আলাদা করে আমার ওপর মারপিট শুরু করে দেওয়া হলো। আমাকে রাবার কোটেড বেত দিয়ে পেটানোর পাশাপাশি বিভিন্ন প্রশ্ন করা হয়। ২/৩ ঘণ্টা কাটল এ অবস্থায়। পরে আমাকে কিছুক্ষণের জন্য পাশের একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত আরও অত্যাচার চালানো হয়। যারা আমার ওপর অত্যাচার চালিয়েছে তাদের কথা শুনে বুঝতে পারি যে, আমাকে যারা ধরে এনেছিল তাদের মধ্যে ফজলুল কাদের চৌধুরীর এক ছেলেও ছিল। পরে আমি শুনেছি ও জেনেছি যে, ফজলুল কাদের চৌধুরীর ওই ছেলেটি হচ্ছে সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী। বিষয়টি নিয়ে আমি পরবর্তী সময়ে পত্র-পত্রিকায় লিখেছিও।’

তিনি বলেন, ‘অত্যাচারের পর আমাকে গুডস হিলের গ্যারেজে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমার অপর দুই বন্ধুকে দেখি যে তারাও মুমূর্ষু অবস্থায়। আমার দুই হাত পেছনমোড়া করে এমনভাবে বাঁধা ছিল যে, আমি বসতেও পারতাম না। অত্যাচারে আমার সারা শরীর ফুলে গিয়েছিল। 

পরদিন আমাদের তিনজনকে চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামে আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেও সারারাত জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্যাতন করা হয়। এভাবে ১৩ জুলাই পর্যন্ত প্রতিদিন জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্যাতন চলে। ১৩ জুলাই সন্ধ্যায় ট্রাকে করে আমাদের দুজনকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রধান ছিলেন মেজর গজনফর। তিনিও আমাদের অনেক জিজ্ঞাসাবাদ ও তার সৈন্যদের দিয়ে নির্যাতন চালান। ওইদিন রাতেই ট্রাকে করে চট্টগ্রাম কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে ছাড়া পাই ১৮ নভেম্বর।’ 

জবানবন্দিতে নিজাম উদ্দিন একপর্যায়ে বলেন, '৫ জুলাই সন্ধ্যায় আমরা ঘরের ভেতরে হঠাৎ শুনি `হ্যান্ডস আপ`। 

তবে তার আগে আমরা গাড়ির আওয়াজ শুনি। জানালা দিয়ে দেখি পাকিস্তানি সৈন্যদের চাইনিজ রাইফেল তাক করা। খাকি পোশাকে থাকা পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে সাদা পোশাকে আরো তিন/চারজন যুবক ছিল। তারা ঘরের ভেতর ঢুকে আমাদের পিছ মোড়া করে হাত বেঁধে ফেলে এবং একটা জিপে তোলে। ৫/৬ মিনিটের মধ্যে দেখলাম আমাদের বহনকারি গাড়িটি গুডস হিলে ঢুকছে। গুডস হিলে পৌছানোর পর লনের সামনে গাড়ি থামে। পেছনের গাড়ি থেকে সেই যুবকরা নামে। সাদা পোশাকে থাকা একজন যুবক হাত তুলে চেঁচিয়ে বলে- `আমাদের মিশন সাকসেসফুল` । তখন আমাদের তিনজনকে নিয়ে যাওয়া হয় গুডস হিলের ড্রইং রুমে।’

বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে ফজলুল কাদের চৌধুরীর সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ভয়াবহতা বর্ণনা করে ১৯৭২ সালের ০৮ জানুয়ারি দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়-

‘ফজলুল কাদের চৌধুরী ২৫ শে মার্চের পর থেকে চাটগাঁয় অত্যাচারের যে স্টিমরোলার চালিয়েছিলেন, আইকম্যান বেঁচে থাকলে এই অত্যাচার দেখে তাঁকে নিশ্চয়ই স্যালুট দিতেন।’

শেষ পর্যন্ত ফকা কী করলেন? 

দেশপ্রেমিক ফকা মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়ের পর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল। ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর প্রায় দেড় মণ সোনাসহ একটি নৌযানে করে পালানোর সময় আনোয়ারা উপজেলার গহীরা উপকূলে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়েন। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে শুধু রাউজান থানাতেই ফজলুল কাদের চৌধুরীর ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে একাত্তরে সংঘটিত অপরাধের বিষয়ে ছয়টি মামলা দায়ের করা হয়।

পরবর্তীতে দালাল আইনে ফজলুল কাদের চৌধুরী কর্তৃক সংঘটিত একাত্তরে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হয়।

দুঃখের বিষয় হলো, বিচার চলাকালীন অবস্থায় ১৯৭৩ সালের ১৭ জুলাই ফজলুল কাদের চৌধুরী হার্টঅ্যাটাকে মারা যায়। ফকা তার শেষ পরিণতি দেখার আমাদের সুযোগ দিল না। 

আনন্দের ব্যাপার হলো, এই ফকার নামেই ছাত্রদের একটি হল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি)। গত শনিবার (২২ মার্চ, ২০২৫) বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এক্সট্রা অর্ডিনারি’ সিন্ডিকেট সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

তো প্রিয় পাঠক, কী বুঝলেন? 

স্বাধীন দেশে মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য কৃতজ্ঞতাস্বরূপ একটি হলের নাম রাখা যেতেই পারে। এতে মাইন্ড করার কিছু নেই। তবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নামটা কেটে ফকা বিশ্ববিদ্যালয় করে আরেকটু সম্মান প্রদর্শন করা যেত না? ফকার জন্মদিনে আমরা কেক কাটতাম, মৃত্যুদিনে কাঁদতাম, কালো ব্যাজ পরে নীরবতা পালন করতাম–সেটা ভালো হতো না? ‘কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ো’ জিজ্ঞেস করলে আমরা শ্রদ্ধায় মাথা নত করে বিনীত সুরে মিহি গলায় বলতাম, ফকা বিশ্ববিদ্যালয়, সাকা হল। ফকার অবদানের তুলনায় প্রাপ্য সম্মান (শুধু একটি হলের নাম) কম হয়ে গেল না? 

মানুষ ইদানিং কেমন যেন হয়ে গেছে। অন্যকে সম্মান দিতে চায় না। অদ্ভুত! 

তথ্য সহায়িকা:

* বাংলাপিডিয়া—বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ

* যেভাবে সাকার রাজনৈতিক উত্থান। প্রকাশিত-দৈনিক জনকণ্ঠ-৩০ জুলাই ২০১৫

*  আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, সাকা চৌধুরীর রায় ও ফিরে দেখা—NTV Online

*  ‘ফকা চৌধুরী বললেন, তোরা মুক্তিযোদ্ধা হয়েছিস!’—BDNews24

* মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ 

 

২২৪ পঠিত ... ১১ ঘন্টা ৪৯ মিনিট আগে

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি


Top