ঢাকার সকাল, প্রতিদিনের মতোই গরম আর রাস্তায় লাখ লাখা মানুষ। এই বিশাল শহরের আনাচেকানাচে ছুটে চলা লাখো মানুষের ভিড়ে নান্নু ভাই একজন ক্ষুদ্র কর্পোরেট যোদ্ধা। প্রতিদিনের মতো ব্রিফকেস হাতে অফিসের পথে রওনা। স্ত্রী আদরে প্যাকেট করে দিয়েছে রুই মাছের পেটি আর ফুলকপির বড়া। তবে তা সময়মত খাওয়া হবে কিনা, সেটাও একটা প্রশ্ন।
গুগল ম্যাপস বলছে, অফিসে পৌঁছতে লাগবে মাত্র ১ ঘণ্টা। নান্নু ভাই মনে হেসে উঠলেন—সকাল সকাল এমন ডাহা মিথ্যা একমাত্র গুগল বলতেই পারে। কিন্তু তবু, মানুষ তো আশায়ই বাঁচে। তাই নান্নু ভাইও বুক বাঁধলেন।
৮টা বাজে। নান্নু ভাই বের হলেন। রাস্তায় উঠেই দেখলেন, পুরো শহর যেন কোনো ভাঙ্গারি দোকানের গোডাউনে রুপ নিয়েছে। বাসগুলো দাড়িয়ে আছে এলোমেলোভাবে, কারও গতি নেই। প্যা পু হর্ন আর ঘামে ভেজা মানুষের গুঞ্জনে রাস্তা আজকে মাছের বাজারকেও হার মানিয়েছে। অফিসে তো যেতেই হবে। মনে মনে আল ইজ ওয়েল, আল ইজ ওয়েল করতে করতে বাসে উঠলেন।
সকাল সাড়ে নয়টা। দেড় ঘণ্টায় ২ কিলোমিটার আগানোর পর শুকরিয়া আদায় করলেন। এই সময়ে তিনি ‘ঢাকার জ্যামে মাথা ঠান্ডা রাখতে করণীয়’ নামে একটি মোটিভেশনাল পডকাস্ট শুনে ফেলেছেন, ফ্লাস্ক থেকে দুই কাপ চা শেষ করেছেন, এবং ‘জ্যামে স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট’ শিরোনামের অডিওবুকের অর্ধেক পড়ে ফেলেছেন। চারপাশে বাসের হর্ন, বাচ্চার কান্না, আর সবজি বিক্রেতার মাইকের আওয়াজ শুনে তিনি গুগলে সার্চ দিলেন—চোখ থাকতে অন্ধ আর কান থাকতে কীভাবে বধির হওয়া যায়?
বেলা ১১টা। গাড়ি আরো তিন চারটা সিগনাল পার করল, আবার থেমে গেল। যে সিগনালেই বাস থামে সেখানেই আধাঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে। এই সুযোগে রাস্তার পাশ থেকে হকাররা হাজির। শিঙারা, সমুচা, চানাচুর ফেরি করে বিক্রি হচ্ছে। টিফিন বক্সে থাকা রুই মাছের কথা ভেবে কিছুই খেলেন না। ভাবলেন, এখন এগুলা খেলে, অফিসে পৌছে রুই এর পেটির স্বাদ পাব না।
দুপুর ১২টা। ভিভিআইপি মুভমেন্টের কারণে সামনের চার কিলোমিটার রাস্তা ব্লক। গাড়ি চলছে না। ইয়ারবাডের চার্জ শেষ, গল্পের বইয়ের ইচ্ছাও উবে গেছে। পাশে বসা এক আংকেলের সঙ্গে কথা বলা শুরু করলেন। ১৫ মিনিটের গল্পে জানলেন, আংকেলের মেয়ের বেস্ট ফ্রেন্ড কোনো ছেলের সঙ্গে ভেগে গেছে, আর কালকের বাজারে পেয়াজ ছিল ১২০ টাকা কেজি। তিনি দুই কেজি পেয়াজ কিনেছিলেন যার মধ্যে ৭টা পচা পেঁয়াজও ছিল।
বিকাল ২টা। বাস আর চলছে না। আশপাশের যাত্রীদের সঙ্গে যেন একটু খাতিরের সম্পর্ক গড়ে উঠতে শুরু করেছে। এক রিকশাওয়ালা আর বাস ড্রাইভার জাতীয় রাজনীতির গভীর আলোচনা চালাচ্ছে। পাশ থেকে এক যাত্রী বলল, ভাই, কেউ কি টয়লেটে যাবেন? এক সাথে যাই চলেন। নান্নু ভাই খেয়াল করে দেখলেন একটা জ্যাম ঠিক কতটা ইনফ্লুয়েন্সিয়াল হলে দুইজন অপরিচিত মানুষ এক সাথে টয়লেটে যেতে পারে।
বিকাল ৩টা। নান্নু ভাই বুঝতে পারলেন, আজকে কোনোভাবেই গুলশান যাওয়া সম্ভব না। পাশের লেন বন্ধ বলে বাড়িতেও যাওয়া যাবে না। বসের ঝাড়ি খাওয়ার ভয়ও নেই, কারন বস নিজেই অফিসে পৌছতে পারেন নি। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন– অফিসে যাওয়া সম্ভব না, বাসায় যাওয়াও সম্ভব না, এই সময়টা যে কোনো ভাবে সার্ভাইভ করতেই হবে। এজন্য আরো কিছু মানুষের সাথে আড্ডা দিবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। চারপাশের মানুষের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে তিনি বুঝলেন, এই যানজট আসলে জীবনের এক অদ্ভুত উপহার। এই যানজট আছে বলেই আজকে অফিসে যাওয়া লাগলো না, সাথে দিনটা ঈদের মত সুন্দর কাটছে।
সন্ধ্যা ৬টা। বাসটা যেন এখন একটা ছোটোখাটো মেলায় পরিণত হয়েছে। কে যেন গিটার নিয়ে বের হয়েছিলো, সে গিটার নিয়ে বলিউডের গান গাচ্ছে, কেউ চায়ের কাপে জীবনের দুঃখ-কথা ভাগ করছে। একজন এসে বলল, ভাই, এক কাপ চা খান। আপনি তো সারা দিনই বসে আছেন।
রাত ৮টা। শত শত গাড়ি চাঁদের আলোর নিচে অদ্ভুত মায়াময় রুপ নিয়েছে। নান্নু ভাই আচমকা বুঝলেন—যানজট কোনো শাস্তি নয়, এটি ধৈর্যের পরীক্ষা। তিনি গাড়ি থেকে নেমে মাঝ রাস্তায় ধ্যানে বসলেন। আশপাশের মানুষ তাকিয়ে দেখল, এক লোক বাস থেকে নেমে রাস্তায় বসে ধ্যান করছে। চোখ মুখে তৃপ্তির হাসি।
রাত ১০টা। বাসের ড্রাইভার এসে তাকে জানালো ভাই চলেন রাস্তা খুলে দিচ্ছে। বাসায় যাবেন না অফিসে? নান্নু ভাই মুচকি হেসে কী যেন বললেন, ড্রাইভার কিছু বুঝলেন না।
পরদিন। নান্নু ভাই আর কর্পোরেট যোদ্ধা নন। তিনি এখন জ্যামযোগী। বিজয় সরণি মোড়ে যানজটে আটকে থাকা মানুষদের মানসিক শান্তি দিতে বসে থাকেন। লোকমুখে শোনা যায়, জ্যামের মধ্যে বসে থেকে তাকে দেখলে গায়ে কোনো স্ট্রেস থাকে না। অনেকে অফিসে যাবার আগে তার কাছ থেকে পানি পড়া নিয়ে যান যেন অফিসে পৌছার টাইমে জ্যামে না পড়তে হয়।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন