সন্ধ্যা হয়ে আসছিল, আলমের অপেক্ষা ফুরাচ্ছিল না। আলম দাঁড়িয়ে আছে গুলশান-২ এ। ঠিক সেখানে, যেখানে দাঁড়ালে নাকি ঘটনা ঘটে যায়।
ঘটনা যে ঘটে এটা কদিন আগে নিজ চোখেই আলম দেখেছে। গুলশান চক্করের পেছনে ছোট্টো এক রেডিমেড পোশাকের দোকান আছে। ওখান থেকেই আলমকে কেনাকাটা করতে হয়। নাহলে ২৫ কোমরের বড়দের প্যান্ট, এ তল্লাটে পাওয়া মুশকিল। সেদিনও ২৫ কোমরের দুটো জিন্স কিনে ফিরছিল; তখনই দেখল ব্যাপারটা।
বিকাল বেলা। দুইটা তরুণ ফিটফাট দাঁড়িয়ে আছে। ক্লিনশেভ। শ্যাম্পুমাখা চুল। শরীর-স্বাস্থ্য বেশ। চোখে সানগ্লাস। ঠোঁট প্রায় গোলাপি... লিপস্টিকও হতে পারে। বারের বাউন্সারের মতো দুজনের চলাফেরা। তখনই হুসসস করে দাঁড়াল কালো মার্সিডিজ। গ্লাস নামল। দুজন তরুণই এগিয়ে গেল। কী কথা হলো বোঝা গেল না; কিন্তু একজন থেকে গেল, গাড়িতে উঠে পড়ল আরেকজন। থেকে যাওয়া ছেলেটার মুখে অপমানের ছায়া।
পুরো ব্যাপারটা তখনও ধরতে পারেনি আলম। পারল আরও কদিন পর... ফেসবুকে গুলশান-২ নিয়ে যখন হইচই পড়ল, তখন।
ব্যাটারা জিগালো ছিল। টয়বয়। বাহ!
ভাবতেই বিষয়টা রোমাঞ্চকর ঠেকেছে আলমের। কেমন যেন থ্রিল। সাহস করে সেও যদি দাঁড়ায় ওখানে, হবে? নাকি এদের কোনো লাইসেন্স থাকে? ভেতর থেকে কলকাঠি নাড়ার লোকজন থাকে। পাক্কা তিন দিন সময় নিয়েছে আলম। তারপর নতুন প্যান্ট ভালো করে বেল্টে আটকে, টিশার্ট তার ওপর জ্যাকেট চাপিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। দাড়ি সে কাটেনি। তার মুখ ভাঙাচোরা, দাড়ি কাটলে সেটা আরও অদ্ভুত দেখায়। তবে সানগ্লাস পরেছে। আর সেদিনের সেই ছেলেগুলোর মতো একই কায়দায় অল্প কদমে হাঁটাহাঁটি করে চলেছে।
এখন শুধু গাড়ি আসার অপেক্ষা!
কিন্তু গাড়ি আসে না। রাস্তার বাতিগুলো জ্বলে ওঠে। ঢাকার আকাশ কালচেতর হয়ে ওঠে। শহর আলো-অন্ধকারে রহস্যময় হয়ে উঠতে উঠতে সন্দেহগ্রস্ততায় ডুবতে থাকে। আলম ভাবে, হুদাই খাড়াইছি... যাই গা!
তখনই এসে থামে একটা টয়োটা। একেবারে আলমেরই সামনে। উত্তেজনায় আলমের বুকের রক্ত ছলকে যায়। এই গাড়ি কি তার জন্য? তারই জন্য?
কাঁচ নেমে আসে গাড়ির। কিন্তু ভেতরে কোনো মুখ দেখা যায় না। শুধু কণ্ঠ; কত?
কী কত আলম বোঝে না। বা বুঝলেও অনভ্যাসে কিছু বলে উঠতে পারে না।
: কী হলো, বলেন... কত?
: পাঁপাপা...চ!
: পাঁচ হাজার...? আচ্ছা... আসেন!
আলম আসলে পাঁচশ বলতে চেয়েছিল। কিন্তু সে সব এখন কে মনে রাখে? আলম লাফ দিয়ে গাড়িতে উঠল আর তখনই দেখল কাস্টমারকে।
অনিন্দ্য সুন্দর কী একেই বলে? কী মায়াকাড়া চেহারা। চোখগুলো বড় বড়। ভ্রু খুব যত্ন করে সাজানো। থুতনির একপাশে ছোট্টো কাটাদাগ। কিন্তু এই দাগটাই এত সুন্দর মানিয়েছে মুখটাতে! মুগ্ধতায় আলম শ্বাস নিতেও ভুলে যায়, এমন দশা!
: কী নাম আপনার?'
: জি?
: নাম... কী আপনার?
: জি আলম। বাবা-মায়ে আলমগীর দিছিল, আমি ছোটো করে আলম রাখছি।
কাস্টমার খিলখিল করে হেসে ওঠে। হাসলে কিছু বলিরেখা ছড়িয়ে পড়ে মুখে। ওইটুকুই বয়স। এ ছাড়া কোথাও বয়সের কোনো চিহ্ন নেই। আলম বোকার মতো তার হাসি দেখে।
: এ লাইনে তুমি নতুন না? তুমি করে বললাম কিছু মনে করো না!
: না না ঠিক আছে। আমি তো আপনার চেয়ে বয়সে অনেক ছোটো হব।
: হ্যাঁ ঠিক আছে, এ লাইনে তুমি নতুনই। আমিও নতুন বুঝেছ... তবে মাঝেমাঝেই তোমাকে লাগবে। অন্তত সপ্তাহে দুইদিন, পারবে না?
: জি পারব। অবশ্যই পারব।
গাড়ি মেইন রাস্তা ছেড়ে উপরাস্তায় ঢুকে পড়ে। সাকুল্যে তিন বাঁক নিয়েই হর্ন। দারোয়ান ছুটতে ছুটতে এসে দরজা খোলে। কাস্টমার গাড়ি বারান্দায় নেমেই ছুট দেয় লিফটের দিকে। আলম প্রায় দৌড়ে ফলো করে। লিফটের চার। ফ্ল্যাট এ। দরজা খুলে ভেতরে। সোজা বেডরুম।
বেডরুমই হবে মেবি এটা, আলম ভাবে। কিং সাইজ একটা বেড। নিম্নমাঝারি আলো। দেয়ালজুড়ে প্লাস্টিক পেইন্টের মায়াবী গ্ল্যামার। একটা বড় পেইন্টিং। তার পাশে স্বামী-স্ত্রীর সুখী ছবি। হায় রে সুখ!
কাস্টমার বলে, রেডি তুমি?
আলম বলে, জ্বি। রেডি।
: তুমি তাহলে জামা কাপড় খোলো, আমি আসছি...
কাস্টমার বেরিয়ে যায়। আলম জ্যাকেট আর টিশার্ট দ্রুতই খুলে ফেলে। কিন্তু বেল্টে হাত দিয়েই থমকে যায়। কীভাবে সম্ভব?
টাকার কথাই তখন মনে হয় আলমের। পাঁচশ ভেবেছিল, পাঁচ হাজার পাবে। সাথে বাধা কাস্টমার পাচ্ছে। সপ্তাহে দুইদিন মানে দশ হাজার। মাসে চল্লিশ হাজার ইনকাম। ইচ্ছা করলেই কুরিয়ার সার্ভিসের চাকরিটা ছেড়ে দিতে পারে।
বেল্ট খোলে আলম। তারপর প্যান্টও। একটা ঢিলঢিলে বক্সার শুধু তার পরনে। কোনো কারণ নেই তবুও বুকটা ঢিপঢিপ করতে শুরু করেছে আলমের। তখনই খটাস শব্দ। আলম দ্রুত তাকায়। দরজা আটকে দিয়েছে কাস্টমার। আহ, কী সুন্দর দেখতে উনি! কাস্টমারের হাত ধরে আছে আরেকটা হাত।
এ আবার কে?
পাঁচ ছয় বছরের এক ছেলে।
কাস্টমার বলল, দেখেছ বাবা আয়ান... দেখো ভালো করে... তুমি যদি ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া না করো, তাহলে তোমার স্বাস্থ্য এই আঙ্কেলের মতো হয়ে যাবে... আলম, তোমার ওয়েস্ট কত?
: জি?
: ওয়েস্ট... কোমর... কত?
: ২৪। তবে ২৫ পরতে পারি।
: আর ওজন?
: বেশি না।
: কত?
: ৪২…
: ধুরর... এর থেকে আমার বয়সই বেশি! দেখো আয়ান ভালো করে। তুমি কি এ রকম হতে চাও?
: না মামা। আমি স্যরি। আমি প্রত্যেকদিন খাব ভালো করে।
: আচ্ছা এখন যাও। যাওয়ার আগে আঙ্কেলকে বাই বলে যাও।
: বাই আঙ্কেল!
: বাই... বাই।
: আপনি এবার জামা-কাপড় পরে নিতে পারেন।
: জ্বি শুকরিয়া।
আলম কেমন ঘোরের মধ্যে চলে গেছে। তার মধ্যেই সে জামাকাপড় পরে। কাস্টমার একটা খাম বাড়িয়ে দেয়। বলে, শুক্রবার আর মঙ্গলবার, সপ্তাহে দুই দিন করে আসবেন... আয়ানকে আপনার ফিগারটা দেখিয়ে যাবেন। তাহলে ও আর খাওয়া নিয়ে ঝামেলা করবে না... কী, পারবেন না?
আলম কোনো উত্তর করতে পারে না। খামটা সে পকেটে চালান করে দেয় শুধু।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন