নাহিদ হাসান নলেজের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন তার জগতটি সম্পর্কে জানতে প্রলুব্ধ করেছে। ভাওয়াইয়া গানে চিলমারীর বন্দরের নাম শুনেছিলাম। যখন জানতে পারলাম নাহিদ চিলমারীর বন্দরের ছেলে; সেখানে বসেই জনস্বার্থে বিভিন্ন আন্দোলন সফল করেছেন; নদী রক্ষা, এজমালি ভূমি রক্ষা, ট্রেনের টিকিটের দাম যাত্রীদের আয়সীমার মাঝে রাখা এরকম নানা রকম আন্দোলন করেছেন তিনি। নাহিদের মতো সমাজসেবীর গল্প আমরা সেকালের বই পুস্তকে পড়েছি; কিন্তু একালে এরকম কাজ করছেন একজন যুবক; ব্যাপারটা মুগ্ধ করেছিল। এই মুগ্ধতা আরো বেড়ে যায় ই-সাউথ এশিয়ার ইন্টারভিউতে তাকে যুক্ত করলে। নাহিদের সরলতার জগত তার একার নয়; এইখানে তিনি তার জনপদের মানুষকে নিয়ে একটি আনন্দময় জীবনের আকাঙ্ক্ষা লালন করেন। তিনি জনপদের বিভিন্ন সংকট ও এর সমাধান নিয়ে জাতীয় দৈনিকে কলাম লেখেন। এইভাবে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তাদের দাবিগুলো একের পর এক পূরণ হতে থাকে।
নাহিদ নিয়মিত পণ্ডিত বইমেলার আয়োজন করেন। সুদূর ঢাকা থেকে গুনী মানুষেরা আসেন, প্রকাশকেরা আসেন। জনপদটি আনন্দের আলোয় ভরে ওঠে। এই বইমেলায় শিশুদের জন্য বই আর নানা আয়োজন থাকে।
এরকম সহজ সরল জ্ঞানপিপাসু জীবনে তিনি জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। চোখের সামনে ছাত্রগণহত্যা দেখে সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষের যেটা করা উচিত; তিনি ঠিক তাই করেছেন। কিন্তু ফেসবুকে ফ্যাসিজমের দোসরেরা এসে চোখ রাঙ্গাতে থাকে। চিলমারী ও কুড়িগ্রামের মতো জায়গায় বসে জনদাবি নিয়ে নিরন্তর সক্রিয় থাকাতে জনগণের বিপক্ষে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে যারা; তাদের চক্ষুশূল হয়েছিলেন তিনি।
অবশেষে কথিত তৌহিদি জনতা নামে একটি গ্যাং ধর্ম অবমাননার মনগড়া অভিযোগ এনে ফ্যাসিজমের কালের কালো সাইবার নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছে নাহিদের বিরুদ্ধে। তৌহিদি জনতা নামটি ধারণ করলেও ফ্যাসিজমের কালো আইন ব্যবহার দেখে বোঝা যায়; দীর্ঘদিনের পুষে রাখা আক্রোশ প্রকাশ করেছে; কথিত ধর্ম অবমাননার ছুঁতো ধরে।
নাহিদ কথা বলা ও লেখার ক্ষেত্রে তার পারিবারিক শিক্ষার কারণে অত্যন্ত সংযত। তার প্রতিবাদের ভাষা শালীন। তিনি প্রতিটি বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ান যৌক্তিক ভাষায়। এই যে অতীতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর অধুনা ইসলামের চেতনা অবমাননার নামে সমাজ ও মানুষের অধিকারের পক্ষে সচকিত মানুষদের শিকারের প্যাটার্ন; এটি আমাদের অজানা নয়। কিন্তু ৫ আগস্টের পর বেছে বেছে ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে সচকিত কবি্ গবেষক ও জনবুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগ এনে মামলা ও হামলার হুমকি; এতো স্পষ্টতই পতিত শক্তির প্রতিশোধ স্পৃহা।
যে ঘোড়াগুলো দাবড়ে বেড়াচ্ছে ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে সংগ্রামশীল পরিচিত মানুষদের পিষ্ট করতে; এই ঘোড়াগুলোর চাবুক কার হাতে; তা খতিয়ে দেখা অত্যন্ত জরুরী। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের কট্টর ইসলামপন্থী ও কট্টর হিন্দুত্ববাদী গ্যাং পুষেছিল; ভিন্নমত প্রকাশকারীদের শায়েস্তা করতে। ৫ অগাস্টের পর কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের কাজ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ছিদ্রান্বেষণ ও ভারতীয় মিডিয়ায় তথ্য সরবরাহ
আর কট্টর ইসলামপন্থীর কাজ ভারতীয় মিডিয়ার প্রোপাগান্ডাগুলো ধরে ধরে বাস্তবায়ন আর ধর্ম অবমাননার ধুপ্পু তুলে ফ্যাসিজম বিরোধী বুদ্ধিজীবীদের শিকার।
ফ্যাসিজমের বিদায়ে জুলাই অভ্যুত্থানের স্পিরিটে পরিচালিত পুলিশ ও প্রশাসনের দায়িত্ব এই অশুভ শক্তিকে থামানো। তাদের মনগড়া অভিযোগ কানে তুলে সাড়ে পনেরো বছর হাসিনাশাহীর অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ব্যক্তিদের শাস্তি দিলে; তা হবে বাংলাদেশকে ঘিরে পতিত শক্তির কালো পরিকল্পনা সফল হতে দেওয়া।
আল্লাহ ও মহানবী মুহাম্মদ (সা)-কে অনুসরণ করেন পৃথিবীর অসংখ্য মানুষ। ইসলাম প্রচারের সূচনালগ্ন থেকে যেসব জনপদে এই ধর্ম ও দর্শন চর্চা হয়; সেখানে ঐতিহ্যগতভাবে অনেক জ্ঞানী ও যোগ্য মানুষ রয়েছেন ইসলামের সোনালি সূত্রগুলো উপস্থাপনের জন্য। ইসলামের সম্মান রক্ষা করে চলেছে অর্থনীতিতে সমৃদ্ধ সৌদি আরব ও মালয়েশিয়া, ইসলামের দর্শনকে পৃথিবীব্যাপী পৌঁছে দিতে সক্রিয় রয়েছেন তুরস্ক, মিশর ও ইরানের প্রজ্ঞাবান দার্শনিক ও ইসলামবেত্তারা। দক্ষিণ এশিয়ার প্রান্তিক জনগণ যাদের অন্ন বস্ত্র বাসস্থান চিকিতসা ও শিক্ষার সংস্থান নেই; মুসলিম জ্ঞান বিশ্বে তাদের কোন উজ্জ্বল উপস্থিতি নেই। এরকম জনপদে ইসলামি চেতনার মালিকানা দাবি আসলে আকাশ-কুসুম কল্পনা।
সেই আকাশ-কুসুম কল্পনাকে সম্বল করে ইসলামের স্বপ্রণোদিত ম্যানেজার হয়ে পেশীপ্রদর্শনকে বোঝাতে হবে; ইসলামের যে সুবিশাল জ্ঞানজগত, এখানে তাদের কার্যত কোন গুরুত্ব নেই। বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান এই দেশগুলোর হিন্দু কিংবা মুসলমান আসলে অকল্যাণ রাষ্ট্রের ফাঁদে পড়ে থাকা তুচ্ছ মানব। গেরুয়া বা আলখাল্লা পরে, দলভারী করে কয়েক মুহূর্তের জন্য নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ হয়তো ভাবা যায়; কিন্তু সেই ভুল আত্মবিশ্বাস আসলে কৌতুককর দাবি। গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস বলেছেন, খুব ভালো করে জেনেছি যে আমি কিছুই জানি না। তুরস্কের মওলানা জালালুদ্দিন রুমি বলেছেন, ধর্ম অন্যকে ঠিক করার জন্য নয়, নিজেকে ঠিক করার জন্য। সুতরাং কুড়িগ্রামের কোনো জগলুল কিংবা চট্টগ্রামের কোনো জগন্নাথ যে জ্ঞানের আকাশের নিচে চিত হয়ে শুয়ে থাকা চড়ুই, যে কল্পনা করছে, সে তার দুটো পা দিয়ে আকাশ ভেঙ্গে পড়া ঠেকিয়ে রেখেছে।
রাষ্ট্রের কাছে আবেদন, চড়ুই পুলিশির হাত থেকে দেশের মানুষকে নিষ্কৃতি দিন। চড়ুই-এর কাল্পনিক অভিযোগের ভিত্তিতে সমাজে সক্রিয় মানুষজন, যারা সমাজ উন্নয়নে ভূমিকা রাখে; তাদের থামিয়ে দেবার হীন পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দিন। সমাজকে চড়ুই বিলাস থেকে মুক্তি দিন।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন