দক্ষিণ এশিয়ায় স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার নির্মাণের চেয়ে বেশি মনোযোগ মন্দির ও মসজিদ নির্মাণে। হাসপাতাল নির্মাণের চেয়ে বেশি মনোযোগ স্মৃতিসৌধ নির্মাণে। দেশের জন্য শহীদের পরিবারের ভাত-কাপড়ের নিশ্চয়তা দেবার চেয়ে বেশি মনোযোগ শহীদ মিনার নির্মাণে। সে কারণেই বাংলাদেশের জুলাই-অগাস্ট অভ্যুত্থানে হাজার হাজার তরুণের রক্ত-ত্যাগকে ভারতীয় মৌলবাদি মিডিয়ায় গত ১৫ জুলাই থেকে আজ অবধি মৌলবাদিদের অভ্যুত্থান বলে অপমান করার চেয়ে কলকাতার একজন খ্যাতিমান কবির কাছে বড় হয়ে দাঁড়ায় ভারতের পতাকার অপমান।
বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে, পাকিস্তান বিরোধী মুক্তিযুদ্ধ হয়ে স্বাধীন দেশ হিসেবে মাথাউঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বাংলাদেশে প্রণব মুখার্জি নগ্ন হস্তক্ষেপ করে ভারত তোষক শাসক হাসিনাকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেশের সার্বভৌমত্বকে ম্লান করলেও; ভারতের খ্যাতিমান কবির চোখে তার পতাকার অপমান এতোই বড় হয়ে যায় যে, তিনি মনে করিয়ে দিতে চান, লিখে রাখো একফোটা দিলেম শিশির। বৃটিশের দেয়া জমিদারিতে পূর্ববঙ্গ থেকে সম্পদ লুট করে নিয়ে গিয়ে কলকাতা নগরী গড়া হয়েছিলো; ধুতি-ফতুয়ার জায়গায় নাইট গাউন পরে পাইপ মুখে দোতলা থেকে গোলাকার সিঁড়ি বেয়ে বৈঠকখানায় নেমে আসার কথিত আভিজাত্যকে রাঙ্গানো হয়েছিলো পূর্ববঙ্গের কৃষকের রক্ত ও ঘামে। এই কৃষকের জমি কেড়ে নিয়ে বৃটিশেরা তাদের কোলাবরেটরদের জমিদারি দিয়েছিলো। কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে ১৭৭০-১৭৭৬ প্রায় এককোটি মানুষ হত্যা করেছিলো বৃটিশ ও তার সুতানুটির কোলাবরেটরেরা।
তবু বাংলা ভাষা ও সাংস্কৃতিক ঐক্যের দিকে তাকিয়ে পূর্ববঙ্গের মানুষ প্রথমে অখণ্ড বাংলার স্বাধীনতা চেয়েছিলো ব্রিটিশের কাছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের শ্যামাচরণের মতো ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেয়েছিলেন ভারতের সঙ্গে মিশে যেতে। তখন বাধ্য হয়ে পূর্ববঙ্গের মানুষ পাকিস্তানের অংশ হয়ে স্বাধীনতা নেয়। ভারতের পতাকা উড়েছিলো ১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট। পাকিস্তানের পতাকা উড়েছিলো ১৪ অগাস্ট। ফলে ভারতের পতাকা কখনো পূর্ববঙ্গের পতাকা ছিলো না। ভারতীয় কবি হয়তো তার ইকো চেম্বারের সতত আধিপত্যবাদী মনস্তত্বের কারণে ইতিহাসের পরম্পরা গুলিয়ে ফেলেছেন।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হলে ভারত তা মেনে নিতে পারেনি। সে আসলে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদটাকেই বড় করে দেখেছে ওপরে অসাম্প্রদায়িকতার বেশমি ফতুয়া পরে। বয়ান নির্মাতারা বৃটিশের সঙ্গে মিলেমিশে সুলতানি, নবাবী ও মুঘল আমলকে ডিফেম করেছে। মুসলিম শাসকের ওপর জাতক্রোধ ১৭৫৬ তে পলাশী বিজয়ের পর থেকে আজ অবধি মুসলিম হননের ধণুক ভাঙ্গা পণে রয়েছে। অথচ সুলতানি আমলে বাংলায় হিন্দু ধর্মকে পরম ভালোবাসায় পৃষ্ঠপোষকতা করেছে মুসলিম শাসকেরা। নবাবী ও মুঘল আমলে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি অক্ষুণ্ণ ছিলো। হিন্দু-মুসলমান বিদ্বেষ ও বিভাজন তৈরি হয় বৃটিশ আমলে; আর তা তৈরি করে বৃটিশ প্রণোদিত কলকাতার লেখক-সাহিত্যিক ও ইতিহাসবিদ।
এই যে বৃটিশ আমলে জমিদারি পেয়ে ঈশ্বরের আসনে বসে পূর্ববঙ্গকে অধস্তন ভাবার যে ব্যামো; নতুন আভিজাত্যের অহম; তা কি করে ভুলে গেলো সুলতানি আমলের অভিজাত পূর্ববঙ্গের কথা। পূর্ববঙ্গ গানের দেশ কবিতার দেশ; মানুষ এখানে সরল ও আতিথেয়তাপ্রবণ। তাই তো তারা কখনো তাদের পাল-সেন-সুলতানি-মুঘল-নবাবী যুগের আভিজাত্যের গল্পটা বলে না। অথচ অনেক পরে পাওয়া বৃটিশের দেয়া জমিদারির গপ্পোটাই কলকাতার সাহিত্য-চলচ্চিত্র-ইতিহাসের মনোজগতের নিটশের উবারম্যান কল্পনার উৎস।
শিল্প বিপ্লব পরবর্তী ইউরোপের ফিলিস্টাইন্স বা নতুন বড়লোকের গল্পগুলোকে ব্যাঙ্গ বিদ্রুপে উড়িয়ে দিয়েছে পশ্চিমা সাহিত্যিকেরা। আর কলকাতায় বৃটিশ আমলের ফিলিস্টাইন্স নিয়ে গর্বের অন্তহীন গল্প। কলকাতার আধুনিক মানুষের চোখে নতুন ধনী অবাঙ্গালি ব্যবসায়ীদের যেরকম কৌতুককর উপস্থিতি, পূর্ববঙ্গের আধুনিক মানুষের চোখে বৃটিশ আমলের জমিদার সেই একইরকম রসউদ্দীপক ম্যাগালোম্যানিয়ার বাগান।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ভারত বাংলাদেশকে সাহায্য করেছে। এটা ভারত ও বাংলাদেশের জন্য উইন উইন সিচুয়েশান। বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেলো। ভারত সেই ১৯৪৭ সাল থেকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যে প্রতিশোধ স্পৃহা নিয়ে ঘুরছিলো; তা সফল হলো। তাই বলে বাংলাদেশকে পাপোষ বানিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারত শাসন, বাংলাদেশে মনপছন্দ লেন্দুপ দর্জি বসিয়ে রেখে আরেকটি সিকিমের আনন্দ নিতে হবে।
বাংলাদেশের দিল্লি সমর্থিত ফ্যাসিস্ট শাসক হাসিনা পতনের পর পালিয়ে দিল্লিতে গেছেন। ১৯৮১ সালে তিনি দিল্লির রাজনৈতিক আশ্রয় থেকে বাংলাদেশে এসেছিলেন। বাংলাদেশের ছায়া উপনিবেশ হারানোর শোক ভুলে যাওয়াই ভারতের জন্য শ্রেয় হবে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মিডিয়া, সেমিনারে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বার বার মৌলবাদি বলে ডিফেম করা, ভারতীয় সেনা প্রধান ভিডিও কলে কথা বলার সময় নিজের পেছনে একাত্তরের ছবি ঝুলিয়ে রেখে বুঝিয়ে দেয়া, লিখে রাখো একফোটা দিয়েছিলাম শিশির; এইসমস্ত আচরণ সেই বলিউডের 'ডর' মুভির শাহরুখ খানের মতো। যে "জাদু তেরি নজর বলে" জানালায় উঁকি দিত।
আচ্ছা ভারতে কি আয়না নেই! ২০১৪ সাল থেকে জনপ্রিয় ভোটে মৌলিবাদি দল বিজেপি ক্ষমতায়। অথচ যে বাংলাদেশে মৌলবাদিরা কখনো ২-৩ শতাংশের বেশি ভোট পায়নি; তাকে কি করে মৌলবাদি দেশ বলে তকমা দেবার চেষ্টা করে ভারতের মৌলবাদিরা।
ভারতের নাগরিক সমাজে আমাদের অনেক বন্ধু ও আত্মীয় রয়েছে। আলোচ্য কবিও দীর্ঘদিনের পরিচিত; আমাদের সখ্য ছিলো একবিংশের শুরুর দিকে। আমি উগ্রজাতীয়তাবাদ তীব্র অপছন্দ করি। রবীন্দ্রনাথের বিশ্বনাগরিক হবার চারুপাঠ প্রভাবিত করেছে সবসময়। তবে বিতার্কিক বলেই অনাকাংক্ষিত উগ্র জাতীয়তাবাদী কবিতাটির সমালোচনা প্রসঙ্গে কিছু কথা বললাম।
ইউরোপে দেখেছি কল্যাণরাষ্ট্রগুলোতে রাষ্ট্র অন্ন বস্ত্র বাসস্থান চিকিতসা শিক্ষার দায়িত্ব নেয়। সামাজিক সুবিচার , প্রতিটি নাগরিকের সমমর্যাদা ও সাম্যভাবনার বাতাবরণ রয়েছে সেখানে। ফলে সেখানে পতাকা অনুভূতি দেখিনি। জাতির সম্মান যেখানে "স্বাধীনতার অর্থ প্রতিটি নাগরিকের জীবনে অনুদিত" হবার মাঝে নিহিত থাকে; সেখানে সমুদ্র সৈকতে কেউ জাতীয় পতাকার বিকিনি পরে ঘুরলেও গেল গেল রব ওঠে না।
দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতিটি দেশে স্বাধীনতার সুফল কুড়িয়েছে সুযোগ সন্ধানীরা। আর জাতীয় দিবসে পথে ঘাটে পতাকা বিক্রি করে বেড়ায় ধুলোমলিন অনাহারী শিশুরা। সুযোগ সন্ধানীরা দেশ লুন্ঠন ও ক্ষমতা কাঠামোর বিদূষক হয়ে চর্বি জমিয়ে জাতীয় দিবসে এসে পতাকার মর্যাদা নিয়ে কাঁদাকাটি করে। জাতির অসম্মান যে ফুটপাথে গৃহহীন মানুষের নিয়ন বাতির নীচে ঘুমিয়ে থাকাতে; ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া কৃষকের আত্মহত্যায়, কতিপয়ের হাতে সম্পদ পুঞ্জীভুত হলে বৈষম্যে বিশীর্ণ হয় দারিদ্রের অগমে দুর্গমে কষ্টে সৃষ্টে বেঁচে থাকা মানুষের দুর্ভাগ্যের মিছিলে। তখন পতাকা অনুভূতি দিয়ে অকল্যাণরাষ্ট্রকে ঢেকে রেখে চালিয়ে যেতে লুণ্ঠন ও শোষণের রাষ্ট্রযজ্ঞ।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন