পররাষ্ট্রনীতিতে কখনও সব ডিম একটা বাস্কেটে রাখতে নেই। ভারত প্রতিবেশী হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশে বিংশ শতকে প্রায় সব সরকারের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক ধরে রাখে। একবিংশ শতকে ভারতের কংগ্রেস নেতা প্রণব মুখার্জি পররাষ্ট্রনীতির সব ডিম আওয়ামীলীগের বাস্কেটে রাখার আয়োজন করেন। উনি তার আত্মজৈবনিক ‘কোয়ালিশন ইয়ারস’-এ স্পষ্ট করে লিখে গেছেন: কীভাবে সেনা সমর্থিত এক-এগারোর সরকারের সময় সেনাপ্রধান মঈন উ আহমেদকে দিল্লিতে আমন্ত্রণ জানিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামীলীগকে ক্ষমতায় আনার বন্দোবস্ত করেন। এরপর একে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে রূপ দিতে কংগ্রেস আমলে ভারতীয় প্রতিনিধি সুজাতা সিং এসে প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ করেন ২০১৪-এর বিতর্কিত নির্বাচনে। জাতীয় পার্টির নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে বাধ্য করেন বিএনপি নির্বাচন বর্জনের মুখে আওয়ামীলীগের গৃহপালিত বিরোধী দলের ভূমিকা গ্রহণে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এ রকম অসৌজন্যমূলক হস্তক্ষেপ অন ক্যামেরা ঘটে গেলে বাংলাদেশের মানুষের মনে ভারতের ব্যাপারে নেতি তৈরি হতে থাকে।
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি দিল্লির ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশ নীতিতে স্থূল ঔপনিবেশিক মনোভঙ্গি আরও দৃষ্টিকটু হয়ে পড়ে। এরই মধ্যে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জনপ্রিয়তা হারালে ক্ষমতায় থাকার জন্য তিনি কার্যত ভারতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। ২০১৮ সালের ‘রাতের’ নির্বাচনের আগে ও পরে ভারতের কর্মকর্তারা ঢাকায় এসে একমাত্র হাসিনাতেই আস্থা রাখেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এমএ মোমেন তো চট্টগ্রামে প্রকাশ্য জনসভায় বলেই ফেলেন, আমি দিল্লি গিয়ে ভারত সরকারকে বলে এসেছি যেকোনো মূল্যে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশের গণতন্ত্রহীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুললে ভারতীয় প্রতিনিধি ওয়াশিংটন গিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আছে বলেই মৌলবাদকে নিয়ন্ত্রণ করে রেখেছেন। ভারতের মোদি প্রভাবিত মিডিয়াগুলো এই ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে, হাসিনা ক্ষমতায় না থাকা মানেই বাংলাদেশ মৌলবাদের খপ্পরে পড়ে যাবে।
ভারতের মোদি সরকারের প্রতিনিধি, থিংকট্যাংক ও মিডিয়ার ‘বাংলাদেশে আওয়ামীলীগ ছাড়া বাকি সবাই মৌলবাদী’ এই ন্যারেটিভ শুনলে মনে হবে ভারতে কোনো আয়না নেই; কারণ ২০১৪ সাল থেকে ভারতের ক্ষমতায় মৌলবাদী একটি রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে মৌলবাদীরা কখনও গড়ে ২-৩ শতাংশের বেশি ভোট পায়নি। ভারতে হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দলের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অত্যন্ত জনপ্রিয়। কিন্তু বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ কখনও কল্পনা করতেও পারে না ইসলামপন্থি একটি দলের নেতা প্রধানমন্ত্রী হবেন। এর কারণ বাংলাদেশে কখনও ইসলামি কট্টরপন্থা সক্রিয় হলে; সরকারগুলো তা অস্বীকার করেনি। বরং ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ার হামলার অভিঘাতে বিশ্বব্যাপী কট্টর ইসলামপন্থা সক্রিয় হলে; বাংলাদেশে এদের কিছু তৎপরতা ধরা পড়তেই; তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে গ্রেপ্তার ও সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভারতের ন্যারেটিভে ২০০১-এর পরে বাংলাদেশে ইসলামি কট্টরপন্থা সক্রিয় হয়। কিন্তু ২০০৬ সালের মধ্যেই ইসলামি সন্ত্রাসবাদবিরোধী অভিযান করে ও অপরাধীদের দ্রুতবিচারে শাস্তি দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়। ভারতের ন্যারেটিভের সিলেক্টিভ ট্রুথে এই অভিযান ও শাস্তির মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার উল্লেখ থাকে না। থাকে শুধু উত্থানের গল্প।
বাংলাদেশের মৌলবাদ নিয়ন্ত্রণে থাকার আরেকটি কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশ প্রশাসন ভারতের অভ্যন্তরে মৌলবাদের উত্থান, সংখ্যালঘু নির্যাতন ইত্যাদি ব্যাপারে অযথা নাক না গলিয়ে নিজের দেশের সমস্যায় পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে তার সমাধান খোঁজে। কিন্তু ভারত প্রতিবেশী দেশে মৌলবাদের উত্থান, সংখ্যালঘু নির্যাতনে স্বপ্রণোদিত অভিভাবকের বেশে এত ব্যস্ত থেকেছে যে, কবে কবে নিজের দেশে মৌলবাদ তার শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে বিষবৃক্ষে পরিণত হয়েছে; তা খেয়াল করতে পারেনি। এ কারণেই প্রবীণরা সবসময় নিজের চরকায় তেল দেওয়ার উপদেশ দেন।
ভারতে কোনো ইসলামপন্থি নেতা গ্রেপ্তার হলে বাংলাদেশ সরকার তা নিয়ে কোনো আগ্রহ দেখায় না। কিন্তু বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা অবমাননা করে এর ওপরে বিজেপির স্লোগান জয় শ্রীরাম লেখা গেরুয়া পতাকা ওড়ানোর অভিযোগে হিন্দুত্ববাদী নেতা চিন্ময় দাস গ্রেপ্তার হলে; শুধু ভারতের বিজেপি নেতাই নন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রতিবাদলিপি পাঠায়। ইসকনের আন্তর্জাতিক দপ্তর প্রতিবাদ করে। এদিকে ইসকন বাংলাদেশ শাখা দাবি করে, চিন্ময় ইসকন থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে আরও আগেই। বাংলাদেশের নাগরিক চিন্ময় আইনভঙ্গের অভিযোগে গ্রেপ্তার হলে তা নিয়ে ভারতে কেন মাতম উঠবে; তা বোঝা কষ্টকর। তাহলে কী ভ্রান্ত-অধ্যাসে বাংলাদেশকে কল্পনায় ছায়া উপনিবেশ ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল কোনো কোনো মহল! সে কারণেই কি পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিলেন। ছাত্র-জনতা গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত একজন পলাতক আসামিকে আশ্রয় দিয়ে ভারতীয় প্রশাসন নিজের নৈতিক অবস্থানকে নিজেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
ঢাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছালে ১৫ জুলাই থেকে ভারতের মোদি প্রভাবিত মিডিয়াতে ঢাকায় সাবেক ভারতীয় রাষ্ট্রদূতরা এই আন্দোলনে ‘মৌলবাদী ঢুকে পড়েছে’ বলে জীর্ণ রেকর্ড বাজাতে শুরু করেন। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় না থাকলে ক্ষমতায় মৌলবাদীরা এসে পড়বে জুজু-তোতাপাখির মতো আউড়াতে থাকে ভারতীয় মিডিয়া। ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী শাসক হাসিনার পতন হলে, ভারতের মিডিয়া ও প্রশাসন স্তম্ভিত হয়ে যায়। বাংলাদেশের ক্ষমতায় মনপছন্দ সরকার হারানোর শোক; নানাভাবে প্রকাশিত হতে শুরু করে।
যেকোনো অভ্যুত্থানের পরে দেশে দেশে নির্যাতিত মানুষেরা স্বৈরাচারের দোসরদের ওপর হামলা করে। এ রকম কিছু বিচ্ছিন্ন হামলা ঘটে যায় ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাময়িক অনুপস্থিতির কারণে স্বৈরাচারের দোসরদের ওপর অনভিপ্রেত জনহামলাগুলো ঘটে। হামলার স্বীকারদের মাঝ থেকে হিন্দুধর্মীদের পরিসংখ্যান তুলে এনে তাদের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী পরিচয় উহ্য রেখে ‘সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা’ বলে চিত্রায়িত করে ভারতীয় মিডিয়া। এই খবরের ভিত্তিতে পশ্চিমা দেশে বিজেপি-ইসকন ও অন্যান্য হিন্দু সংগঠন প্রতিবাদ জানায় পশ্চিমা মানবাধিকার সংস্থার নজর কাড়তে। ওই সময় বাংলাদেশে সনাতন জাগরণ মঞ্চ স্থানে স্থানে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ও সাধারণ মানুষ হিন্দু-এলাকা ও মন্দির পাহারা দিয়ে হিন্দু-জনগোষ্ঠীর মাঝে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করে। কিন্তু বাংলাদেশের হিন্দু জনগোষ্ঠীর স্বপ্রণোদিত অভিভাবক সেজে ভারতীয় মিডিয়া ও প্রশাসনের ‘কাঁদো হিন্দু কাঁদো’ ক্যাম্পেইন চলতে থাকে।
ভারতের সোশ্যাল মিডিয়ায় আওয়ামীলীগের এমপি ক্রিকেটার মাশরাফির গৃহে হামলার ছবিকে ক্রিকেটার লিটন দাসের বাড়িতে হামলা কিংবা রেস্টুরেন্টে অগ্নিসংযোগকে মন্দিরে আগুন অথবা রোহিঙ্গা শরণার্থীর ছবিকে হিন্দু শরণার্থীর ছবি হিসেবে প্রচার করে বাংলাদেশের হিন্দুদের মনে ট্রমা ছড়াতে শুরু করে। অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান ড. মুহম্মদ ইউনূস দুর্গাপূজার আগে হিন্দু জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বৈঠক করে আস্থা সঞ্চারের চেষ্টা করেন। স্পষ্ট করে বলেন, জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের যে নতুন বাংলাদেশের অঙ্গীকার; সেখানে বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করাই কর্তব্য। এখানে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান এসব আইডেন্টিটি পলিটিকসের প্রয়োজন কী। সবাই বাংলাদেশের নাগরিক; এই পরিচয় যথেষ্ট একটি আধুনিক রাষ্ট্রে।
ভারতের মিডিয়া মন পছন্দ সরকার শেখ হাসিনা ক্ষমতায় নেই; এই বাস্তবতার সঙ্গে কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারে না। ফলে নিয়মিত সাম্প্রদায়িক উসকানির ফাঁদ তৈরি করতে থাকে। সবশেষে চিন্ময় গ্রেপ্তার হলে ও চট্টগ্রাম আদালতে তার জামিন নামঞ্জুর হলে আক্রোশে ফেটে পড়ে তার সমর্থকরা। অভ্যাসবশত অন ক্যামেরা আওয়ামীলীগের স্লোগান দিয়ে জিভ কাটে তাদের কেউ কেউ। সেই আদালত পাড়ায় আইনজীবী আলিফকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। রয়টার্স আলিফকে চিন্ময়ের আইনজীবী হিসেবে বানোয়াট খবর ছেপে জিভ কাটে লজ্জায়। ভারতীয় মিডিয়া সেই বানোয়াট ন্যারেটিভ কাঁধে নিয়ে দৌড়াতে থাকে। এই অর্কেস্ট্রার উদ্দেশ্য পরিষ্কার; সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ। কিন্তু আলিফের জানাজায় তার বাবা সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানালে; ঘোলাটে পরিস্থিতির মাঝে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির আলোর উদ্ভাস ফুটে ওঠে। আবার সেই জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের ঐক্য সব বিভাজন ভুলে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেয় বাংলাদেশের জনমানুষকে।
বারবার ভারতের মিডিয়া প্রচারণার মাধ্যমে বিভিন্ন রকম উসকানির ফাঁদ তৈরি করা হয়; যাতে বাংলাদেশের মানুষ উত্তেজিত হয়ে ভুল করে। মৌলবাদী পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত রিপাবলিক বাংলা টিভি সাংবাদিকতা নৈতিকতার সব নিয়ম ভেঙে ১৫ জুলাই থেকে আজ অবধি বাংলাদেশকে মৌলবাদী রাষ্ট্রের তকমা দিয়ে চলেছে। নোবেল বিজয়ী সরকারপ্রধান ইউনূস ও তার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের ব্যাপারে ডিফেমেশন করে চলেছে। হিন্দুত্ববাদী মনোজগতের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে আনন্দবাজার পত্রিকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের ইসলামি সন্ত্রাসবাদী তকমা দিয়ে স্ল্যান্ডার করেছে। কিন্তু ভারতের তথ্য ও সম্প্রচার প্রশাসন অনুশীলিত নির্লিপ্ততায় এসব হতে দিয়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ডিজ ইনফরমেশন ও মিস ইনফরমেশন প্রচার হয় ভারতীয় মিডিয়ায়; এ রকম পশ্চিমা পর্যবেক্ষণকে তুড়ি মেরে সাংবাদিকতা নৈতিকতার অন্তর্জলী যাত্রা চলছে।
বিজেপি তার বাংলাদেশবিরোধী সেন্টিমেন্ট দিয়ে গত নির্বাচনী ফলাফলে দৃশ্যমান ক্ষয়িষ্ণু জনপ্রিয়তা ফেরাতে মরিয়া। ভারতে যেহেতু বহু ব্যবহারে জীর্ণ পাকিস্তানবিরোধী সেন্টিমেন্ট সেখানকার স্ট্যান্ড আপ কমেডি ও মিমের উপকরণ হয়েছে; তাই বাংলাদেশবিরোধী সেন্টিমেন্টের পালে হাওয়া দিতে পিছিয়ে থাকেনি কংগ্রেস। সেখানে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিই বা কী করে চুপ থাকেন। অ্যান্টি বাংলাদেশ সেন্টিমেন্টে তিনি যোগ করেন নতুন মাত্রা, বাংলাদেশে জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের পরামর্শ রেখে। এটা উনার লেখা এপাং ওপাং ঝপাং কবিতার মতো পরাবাস্তব প্রস্তাব হিসেবে হাসির খোরাক জুটিয়েছে।
১৫ জুলাই থেকে ভারতীয় মিডিয়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ‘ইসলামি সন্ত্রাসবাদী’ বলে তকমা দেওয়া আর বাংলাদেশ মৌলবাদীদের খপ্পরে; সুতরাং ইরান কিংবা মিসরের মতো বিপ্লব হাইজ্যাক হয়ে গেছে; এসব ট্র্যাশ-টক শুনে অপমানিত বোধ করায়; ঢাকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাদের প্রবেশপথে ভারতের পতাকা এঁকে দিলে; ভারতে পতাকা সেন্টিমেন্টে ঠক ঠক করে কাঁপতে থাকে কবি ও রাজনীতিক। যারা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার ওপর বিজেপির জয় শ্রীরাম লেখা গেরুয়া পতাকা ওড়ানোর যে অভিযোগ চিন্ময় দাসের বিরুদ্ধে; সে সম্পর্কে হয় স্পিকটি নট অথবা ওটা কোনো ব্যাপার নয় বলেছেন কদিন আগেই।
১৬ জুলাই থেকে অসংখ্য উসকানির বিপরীতে ঢাকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ পথে ভারতের পতাকা আঁকার ঘটনা পেয়ে কলকাতায় ‘ছ্যা ছ্যা’ পড়ে যায়। বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে গিয়ে পতাকা পুড়িয়ে; ড. ইউনূসের কুশপুত্তলিকা দাহ করেও শরীরের রাগ মেটে না। সেই ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদারি পূর্ববঙ্গে নেই। কিন্তু সেই জমিদারির টাকায় কলকাতায় গড়ে তোলা সেকেন্ড হোমগুলোর ভগ্নাংশ আছে; আর আছে ক্ষীয়মাণ জমিদারের আত্মশ্লাঘা। চার মাস ধরে শত মুখে বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও এর তরুণদের নিয়ে অশালীন ও অসাংবিধানিক সব বক্তব্য প্রচারের পরও মনে হয়, আরেকটু অপমান করা গেলে ক্ষতি কী! তাই আগরতলার ঘোড়াগুলোকে লেলিয়ে দিয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে হামলা করে বাংলাদেশের পতাকার আরও অবমাননা করতে হলো; ভাঙচুর হলো। জেনেভা কনভেনশন-টন নাত্থিং বাট ফান। আর কী কী করলে কর্নওয়ালিশের রাগ প্রশমন হবে তা ভগবানই জানেন!
এসব বিভাজন বিদ্বেষ; মনপছন্দ হাসিনা হারানোর উন্মাদনার মাঝেও; কলকাতা ও দিল্লির বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণরা বাংলাদেশের বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের পাশে থেকেছে ১৫ জুলাই থেকে আজ অবধি। সাংবাদিক ও গায়ক কবীর সুমন প্রশ্ন রেখেছেন, ফেলানি কাঁটাতারে ঝুললে কীসের অবমাননা হয়। চিন্তক সৌমিত্র দস্তিদার ও সাংবাদিক অর্ক ভাদুড়ি ভারত তোষক শেখ হাসিনা ও দিল্লি প্রশাসনের রসায়নের প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দিয়েছেন। যারা বিভাজন নয়, মানবিক ঐক্যের মানুষ; তারা এসব রাজনীতি ও ধনুক ব্যবসার ‘আমরা বনাম ওরার’ নরভোজি আয়োজনকে প্রত্যাখ্যান করে এসেছে সবসময়। চিন্তার অচলায়তনে আজও যারা পড়ে আছে; তারা উগ্র জাতীয়তাবাদ, উগ্র ধর্মবাদ, উগ্র প্রভুবাদের নেশায় বুঁদ হয়ে সাম্য ভ্রাতৃত্ব আর বন্ধুত্বের জগৎট খুঁজে পায়নি। ‘একদিন ঝড় থেমে যাবে; পৃথিবী আবার শান্ত হবে’ এই নিত্য সত্যটিতে আস্থা রাখে যারা; তারা আধুনিক বিশ্ববীক্ষার স্বাদ পায়। সেদিক থেকে জোনাথন সুইফটের গল্পের বিদ্বেষের লিলিপুটিয়ানের জগৎটি ভীষণ কৌতুক উদ্দীপক। একটা ডিমের কোন দিক থেকে ভাঙা উচিত; এই ইগো বিতর্কে সারাটি জীবন কাটিয়ে দিল ব্লেফুসকুডিয়ানদের সঙ্গে শত্রু শত্রু খেলায়।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন