নারী হচ্ছে খোদার রশ্মি

৬১ পঠিত ... ১৬:০৪, জানুয়ারি ০৪, ২০২৫

21

রোমান শাসক ও দার্শনিক মারকুস আরলিউয়াস আনাতালিয়া থেকে কিছু দূরে আসপেনডোস একটি অ্যাম্ফিথিয়েটার নির্মাণ করেছিলেন। সেখানে আজও নানান কনসার্ট ও থিয়েটার হয়। লোকটা গুড়িয়াকে সেখানে নিয়ে যায়। অ্যাম্ফিথিয়েটারের ভেতরে ঢুকেই বলে, এ জায়গাটা এমনভাবে তৈরি, সামান্য ফিসফিস শব্দ পুরো গ্যালারিতে ছড়িয়ে পড়ে। শোনা যায়, এর স্থপতির গুনমুগ্ধ হয়ে মারকুস তার রাজকন্যাকে তার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। এমন কত উপকথাই তো ছড়িয়ে থাকে জনপদে।

গুড়িয়া হেসে বলে, তোমার সঙ্গে আমার যে দেখা হওয়া; সে তো একটা উপকথাই। কত নাম শুনেছি তোমার। তুমি কি জানো শুধু তুরস্ক, ইরান নয়; দক্ষিণ এশিয়ায় পাশতো, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, বাংলা ভাষার কবিরা তোমার চিন্তায় প্রভাবিত হয়েছে।

: আমি পূর্ব কিংবা পশ্চিম নই, আমার হৃদয়ের ভেতরে বাইরে কোনো সীমান্ত রেখা নেই। ভালোবাসা নিজ নিজ ভাষায় এর পথ খুঁজে নেয়।

: আচ্ছা নারীকে তুমি কী চোখে দেখ?

: নারী হচ্ছে খোদার রশ্মি, সে পার্থিব নয়, সে সৃষ্টিশীল, তাকে সৃষ্টি করা যায় না।

: সৌন্দর্য্য কী?

: আমাদের চারপাশে সৌন্দর্য্য ছড়িয়ে থাকে। কিন্তু জীবনের বাগানে হেঁটে তাকে খুঁজে দেখতে হয়।

: তুমি কি নিজেকে চেন!

: আমি খ্রিস্টান নই, ইহুদি নই, জরোস্ট্রিয়ান নই, এমনকি মুসলিমও নই।

: তুমি কি প্রেমিক?

: ভালোবাসা ছাড়া আমার আর কোনো সঙ্গী নেই; শুরু নেই, শেষ নেই, ভোর নেই। আমার আত্মা ভেতর থেকে বলে, ওহে নির্বোধ ভালোবাসা, আমাকে মুক্ত করে দাও।

: তুমি কি সুখি?

: কেন অসুখি হব বলো, আমার অস্তিত্বের পুরোটা জুড়েই তো ফুল ফোটার বসন্ত।

: আচ্ছা ভালো-মন্দ কী?

: আমাদের সবার মধ্যেই ভালো ও মন্দের চেতনা থাকে, আছে এরমধ্যে থেকে বেছে নেবার শক্তির আকাঙ্খা।

: তুমি কি এক আধটু আমায় ভালোবেসেছ!

: আমি যখনই প্রথম ভালোবাসার কথা শুনেছি; আমি আমার আত্মা-হৃদয় ও চক্ষুযুগল বিসর্জন দিয়েছি।

: এ আবার কেমন কথা!

: আমরা ভালোবাসার জন্য জন্মেছি; ভালোবাসা আমাদের মা।

: আচ্ছা খোদা কোথায় আছেন?

: খোদাই তো গোলাপকে হাসতে বলেছিলেন, তাই সে তার পুরো সৌন্দর্য নিয়ে ফুটেছিল। তিনিই তো আমার হৃদয়ের সঙ্গে কথা বলেছিলেন; একে শতগুণ সুন্দর করেছিলেন।

: আমাদের প্রেমের গন্তব্যকে তুমি কোথায় দেখতে পাও?

: আমি প্রেমকে যতই ব্যাখ্যা করি না কেন, যখন আমি প্রেমের মুখোমুখি হই; আমার ব্যাখ্যা নিয়ে লজ্জিত হই। প্রেম কেবল নিজেই প্রেম ও যুগলের রহস্য ব্যাখ্যা করতে পারে।

: আমি যখন তোমায় ছেড়ে যাব; কেমন লাগবে তোমার!

: তুমি ছেড়ে গেলে আমার চোখ ফেটে রক্ত অশ্রু গড়িয়ে পড়বে। তুমি ছেড়ে গেছ বলেই শুধু এ ব্যথা নয়, তুমি সঙ্গে করে আমার চোখ দুটোকে নিয়ে গেছ, আমি কাঁদব কেমন করে!

এমন সময় গাড়ির চালক এসে গুড়িয়াকে মনে করিয়ে দেয়, সাঁঝের নৃত্যানুষ্ঠানের আর বেশি সময় বাকি নেই। ফোন সাইলেন্ট করা ছিল। সেখানে অনেকগুলো মিসকল। কালচারাল ট্রুপের বন্ধুরা অনেকগুলো ফোন করেছে। একজনের সঙ্গে কলব্যাক করে কথা বলে ফিরে এসে আর কোথাও লোকটাকে খুঁজে পায় না। লোকটার অদ্ভুত এক প্যাটার্ন। প্রত্যেকবার দেখা হবার পর এমনভাবে হারিয়ে যায়; যেখানে এরপর আর কখনও দেখা হবে কিনা তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

সূর্যাস্তের লাল আলোয় দ্রুত চলতে থাকে গাড়িটা। গাড়ি চালক ইরানি। সে নিজে থেকেই ভেতরে জমা হওয়া কথাগুলো গুড়িয়াকে বলতে থাকে, আমি একটু ফ্রি উইল এজেন্ট টাইপের লোক। অতিরিক্ত রাষ্ট্রীয় বা ধর্মীয় অনুশাসনে আমার দমবন্ধ হয়ে এসেছিল। তাই তুরস্কে শরণার্থী হয়েছিলাম। কিন্তু যতদিন যাচ্ছে সবজায়গাতেই রাষ্ট্র আর ধর্মের বাড়াবাড়ি বাড়ছে। এ সমাজে তবু মেভলানা রুমির প্রভাবের কারণে এখনও মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নেবার একটা পরিবেশ আছে। কিন্তু মুশকিল হলো আরব বিশ্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার যত দুর্নীতিবাজ এখানে এসে সেকেন্ড হোম কিনে বাড়িঘরের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। ওদের তো হারাম কামাই, দুহাতে দেশলুণ্ঠনের মোহর উড়ায়; মাঝখান থেকে সমস্যা হয়ে যায় আমাদের মতো সীমিত আয়ের লোকজনের। বাধ্য হয়ে দেখবে অনেক ট্যাক্সি ড্রাইভার আজকাল মিটার নষ্ট দেখিয়ে টুরিস্টদের লুটতে চায়। এরকম আগে কখনও ছিল না।   

গুড়িয়া উত্তর দেয়, দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনীতি মানেই দেশটাকে টাকা বানানোর মেশিন হিসেবে ব্যবহার করা। মুখে দেশপ্রেমের কথা বলে দেশ ডাকাতি করে সম্পদ বিদেশে পাচার করে দেশগুলো ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। দেশ ও আমলাতন্ত্র নিয়ে জুয়া খেলা ঐ জুয়াড়িরা যেখানেই যায়; সেখানকার সমাজটাকে নষ্ট করে।

: আনাতালিয়ার বনেদি ধনী যারা, যারা তিল তিল পরিশ্রমে কিছু সম্পদ গড়েছিল; তারা এখন ক্ষয়িষ্ণু, সেইখানে বড় বড় গাড়ি হাঁকিয়ে ঘুরছে দেশ ও বিদেশের আলীবাবা ও চল্লিশ চোরেরা। জানি না আমরা সামান্য আয়ের লোকেরা কতদিন বেঁচে বর্তে থাকব!

ট্রাফিক লাইট লাল হলে গাড়ির চারপাশ ঘিরে ধরে সিরিয়ার শরণার্থী শিশুরা। তারা সাহায্য চায়। ফুলের মতো সুন্দর এই শিশুদের মুখ শুকনো; ক্ষুধা-আশ্রয়হীনতা-অনিশ্চয়তার ধুলোবালি লেগে তাদের জীর্ণ পোশাকে। শীতে ঠক ঠক করে কাঁপছে তারা। গুড়িয়া তাদের সবাইকে জানালা খুলে কয়েন দেয়। ট্রাফিক লাইট সবুজ হলে গাড়িটার পেছনে কিছুক্ষণ দৌড়াতে থাকে সিরিয়ার উদবাস্তু শিশুরা।

গুড়িয়া (পর্ব-৩)

(চলবে) 

৬১ পঠিত ... ১৬:০৪, জানুয়ারি ০৪, ২০২৫

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি


Top