প্রেম বৃক্ষের মতো, যুগল তার ছায়া

৮৯ পঠিত ... ১৭:১৩, ডিসেম্বর ৩১, ২০২৪

28

আজকের সকালটা জীবনের অন্যান্য সকালের চেয়ে একটু অন্যরকম লাগে। অদ্ভুত একটা লোকের সঙ্গে দেখা হলো কাল রাতে। বসফরাসের ক্রুজ শেষ হতেই স্টিমার বন্দরে ভিড়তেই লাফ দিয়ে নেমে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল সে। একবারও সে পিছে ফিরে তাকায়নি। গুড়িয়া গাড়িতে চেপে হোটেলে ফেরার আগে অনেক খুঁজেছে তাকে। কিন্তু ইস্তাম্বুলের জনসমুদ্রে হারিয়ে গেছে সে। হানা চোখে সে ভীড়ের দিকে তাকিয়ে থাকার মুহূর্তে একজন বাদ্যযন্ত্রী এসে বলে, আমাদের গাড়ি ছেড়ে দিচ্ছে, চলুন হোটেলে ফিরতে হবে।

গুড়িয়ার ইচ্ছা করেছিল সারা শহর এফোঁড় ওফোঁড় করে খুঁজবে তাকে। কিন্তু আরেক নৃত্যশিল্পী এসে তাকে হাত ধরে গাড়িতে তোলে। বন্দর থেকে হোটেলে ফেরার পথে উৎসুক চোখে আঁতিপাতি করে খুঁজেছে সে রহস্যময় লোকটাকে। হোটেলে ফিরে নাচের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লেও সারারাত সাংতুদা নদীর ধারে ঘুড়ি ওড়ানোর স্বপ্ন দেখেছে। আরেকটি বালক পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ঘুড়ি ওড়াচ্ছিল। সে একবারও ঘুড়ির সুতো কেটে দেয়নি। তারপর দুজন দৌড়াতে দৌড়াতে ওয়াজিরস্তানের সবুজ পাহাড়ের ঢালে পৌঁছে গিয়েছিল।

হোটেল কক্ষের লাগোয়া ছাদে গিয়ে গুড়িয়া গোলাপি রোদে বসে। কফি খেতে খেতে বসফরাসের ওপর সীগালের ওড়াওড়ি দেখে। একটা সীগাল মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাবার সময় দুবার যে শব্দ করে, তা মশলা বাজার, মশলা বাজার শোনায়।

চট করে সে রুম লক করে হোটেলের বাইরে বেরিয়ে যায়। হন হন করে হাঁটতে হাঁটতে ব্লু মস্কের সামনে গিয়ে একটু দাঁড়ায়। সামনে আরেকটু এগিয়ে গেলে হায়া সোফিয়া। একটা ট্যাক্সিতে উঠে বসে বলে, স্পাইস মার্কেট। ট্যাক্সির জানালায় চোখ রেখে প্রতিটি মানুষকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে সে। ট্যাক্সি ড্রাইভার যথারীতি মিটার নষ্ট দেখায় এবং ভাড়া বাড়িয়ে বলে। এখন দরদস্তুর করার সময় নেই। তাই ভাড়াটা দিয়েই মশলা বাজারে ঢুকে পড়ে।

মশলা বাজারে তিল ধারনের জায়গা নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে পর্যটকেরা এখানে আসে নানা রুপ-রস-গন্ধের মশলা সংগ্রহ করতে। দূর থেকে জাফরানি রঙ উজ্জ্বল রোদের সঙ্গে মিশে এক নয়নাভিরাম দৃশ্য রচনা করে। দারুচিনি, এলাচ, লবঙ্গ, গোলাপের শুকনো পাঁপড়ির সুগন্ধ মিলেমিশে একাকার চারপাশে। কিন্তু গুড়িয়া যাকে খুঁজছে তার দেখা নেই

মশলাবাজারে ঢুকে ডানদিকে একটা প্রত্নসামগ্রীর বাজার। একটু ভেতরে গিয়ে গুড়িয়া আনন্দবিহবল হয়ে দেখে লোকটা একজন দোকানীর সঙ্গে বসে দাবা খেলছে আর ক্যাহবা পান করছে স্মিতমুখে। গুড়িয়া গিয়ে দাঁড়াতেই সে বলে, ও তুমি এসে গেছ, দাঁড়াও এই তো আর তিনটা চাল দিলেই কিস্তিমাত। গুড়িয়া শো পিস আর প্রত্ন সামগ্রী দেখতে থাকে। বেশ কিছু পুরোনো পেইন্টিং-ও আছে দোকানটার মধ্যে। সেখানে মেভলানা রুমির পেইন্টিঙ আছে, তুরস্কের কোথায়ই বা মেভলানার ছবি নেই।

লোকটার দাবা খেলা শেষ হয়। দোকানি এসে জিজ্ঞেস করে, নেবেন নাকি মেভলানার প্রতিকৃতি। লোকটা হেসে বলে, জীবন্ত কবির যে দেখা পেয়েছে, সে কী মৃত কবির ছবি কেনে নাকি! রাখো তোমার দোকানদারি। আমরা এখন কোথাও কফি খেতে যাব। খুব কফির তেষ্টা পেয়েছে।

দুজন পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। গুড়িয়া কিশোরীর মতো মিট মিট করে তাকায়। সাংতুদা নদীর তীরে ঘুড়ি ওড়ানোর স্বপ্নটার কথা বলে। ফুটপাথে দাঁড়িয়ে কফিশপ খোঁজার সময় হিজাব পরা এক মা দুটি ফুলের মতো সুন্দর শিশুর হাত ধরে এসে দাঁড়িয়ে বলে, আমরা সিরিয়ার শরণার্থী, আলেপ্পোতে আমাদের ঘর ছিল, সাজানো বাগান ছিল, আজ আমরা পথের ভিখিরি।

লোকটা পকেটে হাত দিয়ে যতগুলো টাকা উঠে আসে তা সিরিয়ার মায়ের হাতে গুঁজে দিয়ে বলে, আমিও শরণার্থী, সাংতুদা নদীর ধারে ছবির মতো এক গ্রামে জন্ম হয়েছে। এরপর সমরকন্দে যাই। মোঙ্গলেরা হানা দিলে আমরা বাগদাদ, সিরিয়া হয়ে তুরস্কে এসে পৌঁছি। আমাদের জীবনে হানাদারেরা নানারুপে আসে। তারা আমাদের মাতৃভূমি থেকে উদবাস্তু করে; আমরা শরণার্থী হয়ে পড়ি। দুঃশ্চিন্তা করবেন না। মানুষ যেখানে যায়, সেখানেই মাথার ওপর আকাশ থাকে; এই একই আকাশ তো মাতৃভূমির ওপরেরও আকাশ। ভূমি থেকে উৎখাত হলেও আমরা উদার আকাশের নীচে থাকি। তারারা আমাদের আত্মীয় হয়ে আলো দেয়। চাঁদ আমাদের জীবনের সুন্দরতম স্মৃতিগুলোকে এক জায়গায় করে।

একটা প্রাচীন গৃহের কোর্টইয়ার্ডে দৃষ্টিনন্দন এক কফি শপ। এ গৃহের প্রাচীন কড়িকাঠ, নকশা করা দরজা, প্রবেশ পথে লেখা, অটোমান এম্পায়ারের কালে বহিঃশত্রুর আক্রমণে গৃহটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, পরে মূল নক্সা অক্ষুণ্ণ রেখে একে পুনর্জীবন দেওয়া হয়েছে।

কফি খেতে খেতে গুড়িয়া বলে, আমার আব্বা শরণার্থী হবার পর আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। খাইবার পাখতুন খোয়া থেকে উতখাত হয়ে আমরা লাহোরে এসে প্রাচীন এক মুঘল গৃহে ছোট্টো একটা ঘর ভাড়া করে থাকতাম। আব্বা একটা স্কুলে পড়াতে শুরু করেন। রাতে একা একা বসে গান গাইতেন। ধীরে ধীরে মানুষটা ক্ষয়ে যেতে থাকলেন; তারপর একদিন নিভে গেলেন। মাতৃভূমি হারানোর কষ্ট কোমল মানুষেরা নিতে পারেন না, জানি না ঐ সিরীয় শরণার্থী পরিবার আর কখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কিনা!

লোকটা আবৃত্তি করে, মুহাম্মদের আলো একজন ইহুদি কিংবা জরোয়াস্ট্রিয়ানকে বঞ্চিত করে না। তার সৌভাগ্যের ছায়ায় সবার জীবন উজ্জ্বল হোক। যারা মরুভূমিতে পথ হারিয়ে বিলয়ের মুখে, তিনি তাদের সব এনে দিয়েছেন।

গুড়িয়া উত্তর দেয়, প্রেমিকার বেঁচে থাকা, অন্যসব বেঁচে থাকা থেকে আলাদা, ভালোবাসা হচ্ছে সৃষ্টিরহস্য মাপার জ্যোতির্বিদ্যা।

একটা গোলাকার স্তম্ভের পাশে দাঁড়িয়ে নে বাঁশি বাজাচ্ছিল এক তরুণ। বাঁশির সুর চারপাশের বারান্দার ছাদে দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে কোর্ট ইয়ার্ড জুড়ে এক মোহময় দুপুর রচনা করে।

একজন গোলাপ বিক্রেতা আসে টেবিলের পাশে। গুড়িয়া একটা কালো গোলাপ কিনে লোকটার হাতে দেয়। লোকটা উচ্ছ্বসিত হয়ে জিজ্ঞেস করে, আমি তাহলে তোমাকে কী দেব বলো!

তোমার কাছে দেবার মতো যা আছে; আমাদের কারোরই তো তা নেই রুমি। তাই তো গোলাপ কিনতে হয়।

রুমি ফিস ফিস করে বলে,

প্রণয় বসন্ত এসেছে

ধূলিপাত্র এখন বাগান

স্বর্গ ঘোষণার সময় এসেছে

হৃদয়ে পাখির এখন উড়ালকাল।

সাগর এখন মুক্তো টইটম্বুর

ভেজা লবণে স্বর্গনদীর স্বাদ

পাথরেরা আপনাআপনি রুবি হয়

শরীর এখন পুরোটাই আত্মা।

পণ্ডিতেরা প্রদর্শনে মত্ত

প্রেমিক নিজেকে হারাতেই চায়

ডুবে যাবার ভয়ে পণ্ডিতেরা পালায়

আর ভালোবাসা ব্যাপারটাই যে

সমুদ্রে ডুবে যাওয়া।

পণ্ডিতেরা বিশ্রামহত

প্রেমিক বিশ্রামবিমুখ।

প্রেমিক মূলত একা

এমনকি জনারণ্যে

তেল ও জল যেমন পৃথক

যে প্রেমিককে উপদেশ দেয়

আবেগ তাকে উপহাস করে

প্রেম সুগন্ধীর মতো মনযোগ পিয়াসী

প্রেম বৃক্ষের মতো, আর যুগল তার ছায়া।

(কুলইয়াত -ই শামস-২১)

গুড়িয়া (পর্ব-১)

(চলবে)

৮৯ পঠিত ... ১৭:১৩, ডিসেম্বর ৩১, ২০২৪

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি


Top