বাংলা একাডেমি পুরস্কারের মনোনয়ন ঘোষণা করলেই পুরস্কার না পাওয়া লেখকরা পুরস্কার মনোনীতদের পিন্ডি চটকাতে শুরু করে। আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় থাকলে অভিযোগ ওঠে, পুরস্কার মনোনীত মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি, ওনার চাচার শ্যালক বিএনপি করেন। বিশুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এত লেখক থাকতে, অন্ধ আওয়ামীলীগার কবি থাকতে কেন উনি মনোনীত হলেন। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে পুরস্কার মনোনীত লেখকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, উনার মামার শ্যালক আওয়ামীলীগ করে, উনি ঘন ঘন ভারতে যান। বিশুদ্ধ জাতীয়তাবাদী এত কবি ও লেখক থাকতে উনাকে কেন পুরস্কার দিতে হবে।
সুতরাং অন্তর্বতীকালীন সরকারের সময় পুরস্কারের মনোনয়নের ঘোষণা এলে; লেখক ফ্যাসিজমের দালাল ছিলেন, আওয়ামীলীগের গুম, খুন, জুলাই ছাত্রগণ হত্যায় সমর্থন দিয়েছিলেন ইত্যাদি অভিযোগ ওঠে। তখন বাংলা একাডেমি সিদ্ধান্ত নেয়, জুরিদের মনোনয়ন যখন যথেষ্ট হচ্ছে না; তখন গোয়েন্দা সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া যাক; লেখকের ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করার জন্য।
গোয়েন্দা সংস্থার যাদের একটু গল্প উপন্যাস কবিতা পড়ার বাতিক আছে; তাদের নিযুক্ত করা হয় পুরস্কার মনোনীত লেখকদের ব্যাকগ্রাউন্ড খতিয়ে দেখার জন্য। ফলে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা গাদা গাদা বই পুস্তক নিয়ে পড়তে শুরু করে। এক গোয়েন্দা কর্মকর্তার স্ত্রী ভ্রু কুঁচকে বলে, আঁতেল হয়ে পড়লা নাকি, সারাক্ষণ বই মুখে বসে থাকো।
এক গোয়েন্দার তো এসব বই পড়তে পড়তে একটা কবি ভাব চলে আসে। ফেসবুকে কবিতা লিখতে শুরু করে। মন্তব্যে অসাধারণ, মাইন্ড ব্লোয়িং, দারুণ লিখেছেন, আপনি কবিতার বই বের করেন না কেন! এসব প্রশংসা আসতে শুরু করলে গোয়েন্দা ফতুয়া পরে রবীন্দ্র সংগীত শুনতে শুরু করে। আগের চেয়েও গম্ভীর হয়ে যায়; সব সময় ভাবের জগতে বুঁদ হয়ে থাকে।
গোয়েন্দা প্রধান মিটিং ডাকলে লক্ষ্য করে, গোয়েন্দারা সব ফতুয়া পরে, ঝোলা কাঁধে, তাতে বই নিয়ে হাজির হয়। জিজ্ঞেস করে, পুরস্কার মনোনীতদের ব্যাকগ্রাউন্ড চেক কেমন চলছে! ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ফেসবুকে কী লিখেছেন তারা; তা কি চেক করা হয়েছে!
—এ সময়টা কবিরা প্রধানত নীরব ছিলেন। কেউ লিখেছেন, এত মৃত্যু, এত প্রাণক্ষয়, ওরে কে দেবে ধরণীকে বরাভয়। আবার কেউ প্রোপিকটা একবার কালো একবার লাল করেছেন। কেউ আলতো করে লিখেছেন, আর নিতে পারছি না। কেউ কলম দিয়ে পুলিশের গাড়িতে এক তরুণী ঠেলা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার স্কেচ করে কিছু একটা বুঝিয়েছেন। ঠিক ধরা যায় না, কবি লেখকেরা হাসিনা নাকি বিপ্লবী তরুণ-তরুণীদের জন্য কাঁদছেন। সবই ভাসা ভাসা, সবই অব্যক্ত। আসলে শিল্প ব্যাপারটাই তো বিমূর্ত।
আরেকজন গোয়েন্দা চশমাটা চোখে দিয়ে বলে, কবি-সাহিত্যিকেরা ফুল খুব ভালোবাসেন। তাই তারা ফেসবুকে ফুলের ছবি বেশি দেন। এত কোমল পেলব লোকেরা এই কংক্রিটের জঙ্গলে কী করে বেঁচে আছেন, সেটাই বিস্ময়কর।
–লক্ষ্য করলাম, প্রত্যেক বছর পুরস্কারের মনোনয়ন ঘোষণার পর; তারা বাদে অন্য সব লেখক ও কবিরা শ্রেয়তর হয়ে যান ফেসবুকে। যা বুঝলাম কোমল মানুষেরা অত্যন্ত ঈর্ষাকাতর হয়ে থাকেন। কে মনে রাখে কে কবে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছে; তবু প্রত্যেকবার তা নিয়ে এত ঝামেলা। কাকে রেখে কাকে খুশি করবেন স্যার!
গোয়েন্দা প্রধান জিজ্ঞেস করে, এদের লেখা বই পুস্তকে কোনো দলীয় স্তব সংকীর্তন কি রয়েছে! কিংবা কোনো ব্যক্তি বন্দনা!
—যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে সেই দলের একটু প্রশস্তি, একটু মহাপুরুষ বন্দনা ছাড়া আমরাই কি চাকরি ধরে রাখতে পেরেছি স্যার।
গোয়েন্দা সংস্থায় এসে হাজির এক ভদ্রমহিলা। সে গোয়েন্দা প্রধানকে বলে, আমি অনেকদিন ধরে সন্দেহ করি আমার হাজব্যান্ডের অনেকগুলো প্রেম আছে। দেশে তো বিশ্বাসযোগ্য প্রাইভেট ডিটেকটিভ নেই; তাই আমার অনুরোধ, আপনারা যদি একটু সাহায্য করেন।
–দেখুন আমাদের দায়িত্ব কবি-লেখকের পলিটিক্যাল এফিলিয়েশন খুঁজে বের করা। তার প্রেম ভালোবাসা খুঁজে বের করার দায়িত্ব আমাদের নয়। আর প্রেম ছাড়া কাব্যকলা হয় নাকি! শুধু জলপান করে কবিতা লিখেছে কে কবে! তার তো খুশিজলও চাই!
তবু লেখকের স্ত্রীর চাপাচাপিতে তাকে একটি গোয়েন্দা টিমের সঙ্গে ‘অপারেশন: পিওর রাইটার’-এ যুক্ত করা হয়। লেখক সকাল সকাল সেজেগুঁজে সুগন্ধী মেখে বের হলে গোয়েন্দা দল তাকে অনুসরণ করতে থাকে। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো লেখক আওয়ামীলীগ অফিসের পোড়োবাড়ির দিকে এগোতে থাকে। সেখানে কিছুক্ষণ দেয়ালে আঁকা স্লোগান ও গ্রাফিতির ছবি নেয়, নোটবুকে কী কী যেন লেখে। গোয়েন্দাদের মনে এই সন্দেহ তীব্র হয়, লোকটা আওয়ামীলীগ। এরপর লেখক বিএনপি অফিসের দিকে এগোয়। সেখানে লোকজনের কোলাহলের ছবি তোলে। নোটবুকে কী যেন লেখে। গোয়েন্দারা কনফিউজড হয়ে যায়। লেখকের স্ত্রী বলে, একটা রাজনৈতিক উপন্যাস লিখতেছে সে। মনে হয় ঐটা নিয়া গবেষণা করতেছে।
এরপর লেখক শাহবাগের আজিজ মার্কেটে আসে। নতুন বইয়ের প্রুফকপি প্রকাশককে দিয়ে বের হতেই একটা নীলাম্বরী শাড়ি পরা তরুণী এসে পথ আগলে ধরে তার। দুজনে হেঁটে এগিয়ে আইসক্রিম খেতে খেতে গল্প করে। একজন গোয়েন্দা গিয়ে তাদের পাশ দিয়ে হেঁটে এসে বলে, খুবই হাইথটের আলাপ চলতেছে, লেখক খালি মার্কেজ মার্কেজ করতেছে। লেখকের স্ত্রী ক্ষেপে হ্যাং হয়ে যায়, মার্কেজরে চিনিনা আমি! নেটফ্লিক্সে দেখছি তো, কথায় কথায় প্রেম লীলা তার। লেখক সেখান থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সংস্কার বিষয়ক সেমিনারে যায়।
এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলে, সংস্কারের সেমিনারে ঢুকল যেহেতু; তাহলে পুরস্কারটা সে পাইতে পারে, কি বলেন!
আরেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলে, ক্লিয়ারেন্স দিয়া দেওয়া যায় মনে হয়।
লেখকের স্ত্রী বলে, ঐ দ্যাখেন একটা স্কার্ফ পরা সুন্দরী মেয়ের পাশে বসেছে সে! আরও কত চেয়ার খালি ছিল, কিন্তু তারে ঐখানে ঘন হইয়া বসতে হবে। যান একটু ঘুরে শুনে আসেন ভাই, দেখেন কী ফিসফাস করতেছে।
গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলে, আমরা তো স্যাটিসফায়েড; লেখক সংস্কারে আগ্রহী।
লেখকের স্ত্রীর চাপাচাপিতে গোয়েন্দা কর্মকর্তা গিয়ে লেখকের পেছনের চেয়ারে বসে শুনে আসেন তার কথাবার্তা। তিনি নতুন বন্দোবস্তের আলাপটা কার্ল মার্ক্সের দোহাই দিয়া করতেছেন। অবশ্য তালাল আসাদের নামটাও বলছেন। ব্যালেন্স হইয়া গেছে।
লেখকের স্ত্রী রেগে গিয়ে বলে, আমার সঙ্গেও ঐ কার্ল মার্ক্সের গপ্পো দিয়া প্রেম করছিল। এটাকে বলে স্যাপিও সেক্সুয়াল। বড় বড় মনীষীর নাম বলে ইমপ্রেস করা। বুইড়া বয়সেও তার একই অভ্যাস।
এমন সময় লেখকের পাশে বসা তরুণী উঠে গিয়ে তার জন্য এক কাপ কফি আর একটি গোলাপ নিয়ে আসে। লেখকের স্ত্রী এ সময় তাকে ফোন করে। লেখক ফোন কেটে দেয়। মেসেজ করে, সেমিনারে আছি।
লেখকের স্ত্রী উঠে গিয়ে লেখককে শায়েস্তা করতে চাইলে গোয়েন্দা কর্মকর্তা নিবৃত্ত করে, ভাবি বিয়ে করেছেন একজন লেখককে। তার তো নারী ভক্ত থাকবেই। বিয়ে করতেন একজন ব্যাংকারকে; সারাদিন কাজ করে কূল পেতেন না তিনি। ভুল তো আপনিই করেছেন ভাবি। ভুলই বা কেন বলছি, লেখকের স্ত্রী হওয়া তো গর্বের ব্যাপার।
গোয়েন্দাদের গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে বাংলা একাডেমি লেখকের মনোনয়ন চূড়ান্ত করে।
সন্ধ্যাবেলা লেখক আইসক্রিম, পেস্ট্রি এসব নিয়ে বাসায় ফেরে। স্ত্রীকে লাল গোলাপ দিয়ে বলে, পদ্য জানো আমি গদ্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছি। এই নাও তোমার জন্য গোলাপ এনেছি। স্ত্রী ফোন থেকে তরুণীর গোলাপ উপহার আর এক নীলাম্বরী নারী সঙ্গে দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খাওয়ার ছবি দেখিয়ে বলে, এই দ্যাখো মার্ক্স আর মার্কেজের ছবি।
লেখক বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে। বাসায় এরকম বিগ সিস্টার ইজ ওয়াচিং-এর সঙ্গে এতদিন ধরে বসবাস করছে তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় তার।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন