কট্টরপন্থী কুস্তিগীর জাহিদ মিয়ার মনটা আরেকটু হলেই তুলোর মতো নরম হয়ে যেত যদি না বউ চোখে চোখ রেখে মুখের উপর উত্তর না দিত। আজকালকার মেয়ে-ছেলেদের সাহস একটু বেশি। বেশি বোঝে, বাইরের মানুষদের সাথে হাসিহাসি মুখ করে কথা বলে, না জিজ্ঞাসা করে বাজারে চলে যায়। বলে কিনা, রান্নার তেল ফুরিয়ে গিয়েছিল। আসল ধান্দা কী আমি বুঝি না মনে করে! রাগে গজগজ করতে করতে ক্লান্ত শরীরকে চেয়ারে বসায়। লাঠিটা না ভাঙলে আরেকটু পেটানো যেত, তাও মহিলার চোখে পানি নাই, কীভাবে শক্ত হয়ে আছে! বড্ড ক্লান্ত লাগছে, না হলে আরেক দফা বুঝিয়ে দেওয়া যেত। আমার সাথে টাল্টুবাল্টু করা! হেহ!
বিকেলে পাশের গ্রামে মেলায় গিয়ে একটু নাচানাচি দেখে মনটা ঠান্ডা করতে হবে। মেলায় যাওয়া-আসার পথটাও কম আনন্দের না! স্কুল-কলেজের যত মেয়েরা আসে। সরু রাস্তাটায় ওদের পাশ ঘেঁষে দোকানে জিনিসপত্র দেখার মধ্যেও তো কত আনন্দ, বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে তার মুখে।
ফেসবুকে ঢুকে বউদের সীমা-পরিসীমা উল্লেখ করে কয়েকটি গ্রুপে সে স্ট্যাটাস দেয়। এখন একটু হালকা লাগছে। মেলায় ঘোরাঘুরি করে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত দশটা বেজে যায়। বাংলাটা মনে হয় পাকস্থলীতে বেশিই পড়ে গেছে। ঘরে ঢুকতেই আগে বউয়ের দিকে সে ভালো করে তাকায়। সকালের ডোজটা কাজে দিয়েছে, বউ নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। জাহিদ বিছানায় গিয়েই ঘুমিয়ে পড়ে।
জাহিদের স্ত্রী চোখের জল মুছতে মুছতে পাশের রুমে চলে যায়। পৃথিবীটা কি শুধু পুরুষদের? আমাদের চাওয়ার কি কোনো মূল্য নেই? একটু পড়াশোনা জানলে আজই চলে যেতাম। মোবাইলও নেই যে কাউকে দুঃখের কথা বলব—চোখের জল বারবার ছন্নছাড়া হয়ে ঝড়েই চলেছে তার। চোখও একসময় ক্লান্ত হয়ে যায়, ঘুমিয়ে পড়ে জাহিদের স্ত্রী সুমনা।
পরদিন সকালে উঠতে গিয়ে জাহিদ আবিষ্কার করে শরীর অসহ্য ভারী, পেটে ব্যথা। মাথাটাও হালকা ঘুরছে। উঠতে গিয়ে একবার তাল হারিয়ে শুয়েও পড়ে।
অনেক কষ্টে নিজেকে তুলে ব্রাশটা নিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দেয় গগনবিদারী চিৎকার। নিজের শরীরে হাত বুলায়! এসব কী! ছুটে বাথরুমে চলে যায়। দ্বিগুণ জোরে চিৎকার দেয় এবার।
আশেপাশের বাড়ি থেকে সবাই ছুটে আসে। কার চিৎকার শুনল? কেমন একটা মেয়েলী কন্ঠে পুরুষের টোনের চিৎকার ছিল।
এ বাড়িতে সুমনা ছাড়া আর কোনো মেয়ে নেই। সুমনা নিজেও হকচকিয়ে গেছে। টেনশনে ভুলে গেছিল স্বামীকে কোথাও দেখতে পাচ্ছে না।
'আপনি কই?' বউয়ের আতঙ্কিত ডাক। কোনো সাড়াশব্দ নেই। এবার অন্যরাও একটু চিন্তিত হয়ে আশেপাশের কক্ষে খুঁজতে লাগল। বাথরুমে ধাক্কা দিয়ে বুঝল ভেতর থেকে লকড।
: জাহিদ, দরজা খোল বন্ধু!
: বাবা, দরজা খোল, আমি তোমার চাচা, খোল বাবা।
কোনো সাড়াশব্দ নেই।
: আমি তোর কাকি, আরে ঝগড়া তো সব ঘরেই হয়, তোর জন্য আরও মেয়ে দেখব আমরা দরকার হলে, আমার ভাতিজির কথা তো আগেই তোকে বলেছিলাম...
: আহ, থামেন তো কাকি, এখন এসব বইলেন না। আগে ওকে বের করা দরকার, দরজা খোল, আমি রাকিব, গতকালই এলাম ইতালি থেকে, দেখা করবি না?
সুমনা কেঁদেই চলেছে, যেন এত শুভাকাঙ্ক্ষীর ভীড়ে সে উচ্ছিষ্ট কেউ যে দরজা খোলার অনুরোধটুকু করতেও আকাশ-পাতাল ভাবছে।
হঠাৎ খট করে দরজা খুলে গেল।
বের হয়ে এল যে সে দেখতে অনেকটা জাহিদের মতোই, পোশাকও জাহিদের কিন্তু এ তো একজন মেয়ে।
জাহিদের দৃষ্টি অবনত। সকলে পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। কী হচ্ছে এসব! কাকি বিলাপ করে উঠলেন, হায় হায়রে, জাহিদ তো মাতারি হইয়া গেছে!
সুমনা অজ্ঞান হয়ে পড়ল।
কে কী বলবে দিশে পেল না। এই খবর বাতাসের মতো আশেপাশের দশ গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। কেউ কেউ ফোনে ভিডিও করে তৎক্ষণাৎ রিলস বানিয়ে ছাড়ল, সাথে গান, আপাতা পাতে আপাতা পাতে আঃ আঃ আঃ!
ময়-মুরুব্বিরা, জাহিদের সব বন্ধু-বান্ধবসহ অনেকে আসলো ওদের বাড়িতে।
জাহিদ ওদের সামনে শার্ট-প্যান্ট পড়েই চলে এল। শার্টের উপরের বোতাম আবার খোলা।
সুমনা বারবার থামানোর চেষ্টা করছিল, কিন্তু জাহিদ শুনল না। সবাই ওর দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল।
একেকজনের দৃষ্টি একেকরকম। মুরুব্বি কয়েকজন ফিসফিস করতে লাগলেন, মেয়েরা মুখ টিপে হাসছে, ফিসফিস একটা শব্দ, ভালো হইছে! বন্ধুরা কয়েকজন এমনভাবে তাকিয়ে আছে... এই তাকানোর অর্থ জাহিদ খুব ভালো করেই জানে। কলেজের মেয়েদের দিকেও সে এভাবেই তাকাত। ও অনুভব করল ওর লজ্জা লাগছে। একটু পর অস্বস্তি লাগতে শুরু করল। দৌড়ে ঘরে চলে গেল। সুমনা নিজের থ্রি পিস বের করে দিল, ওড়না পড়া শিখিয়ে দিল।
সভায় এক মুরুব্বি বললেন, যা হয়ে গেছে তার উপর তো কারও হাত নেই। নাম তো এবার বদলাতে হবে। জাহিদ সবার সামনে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলেও তার ভেতর ভেঙেচুড়ে কান্না পাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত মেয়ে-ছেলে? নাম ঠিক হলো জাহেদা বেগম।
কয়েকজন বন্ধু সুমনার একটা ভালো জায়গা দেখে বিয়ের ব্যাপারে মুরুব্বিদের সামনে প্রস্তাব রাখল। জাহিদ ছ্যাঁ ছ্যাঁ করে চিৎকার করে উঠল। এত বড় বদমাইশ তোরা? ওর দিকে নজর ছিল তোদের?
এক চাচা দাবড়ি দিয়ে বললেন, এই মেয়ে-ছেলে, গলা নামিয়ে কথা বলো, মাইয়া মানুষের স্বর থাকবে নিচে!
সবাই রাকিবের অনুরোধে সুমনা রাজি থাকলে তাকে বিবাহ করতে চাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করল। সুমনাও নরক মুক্তির স্বাদ পেতে রাজি হয়ে গেল। ঠিক হলো এক সপ্তাহ পর তাদের বিয়ে। এই সাত দিন সুমনা এই বাড়িতেই জাহেদার সাথে থাকবে। জাহেদার নতুন জীবনে বড় চ্যালেঞ্জ নিজেকে ঢেকে রাখা। তার আগের মট লুঙ্গি পড়ে বাইরে কুস্তি খেলতে চলে যেতে ইচ্ছে করে। ফেসবুক ডিঅ্যাক্টিভ করেছে, মানুষ শুধু ট্রল করে। সুমনাকে আজকাল বউ কম বান্ধবী বেশি মনে হয়। মেয়েটা সারাক্ষণ আমায় ওড়না পড়াচ্ছে। সুমনা এত ভালো সেটা কেন আগে মনে হয়নি?
রান্না করা, বাসন মাজা, ঝাড় দেওয়া সব কাজ শিখতে শিখতে হিমশিম খেতে লাগল জাহেদা। সুমনা দুদিন বাদে চলে যাবে। তখন একা হাতে সব করতে হবে ভেবে ডুকরে ডুকরে সারাক্ষণ কাঁদে সে। একদিন বাজারে গেল তেল কিনতে। ওর পুরোনো এক বন্ধু দৌড়ে এসেই ওর হাত ধরল। জাহিদ অনুভব করল ওর ভালো লাগছে না। বন্ধু জোরাজুরি শুরু করল, আয় দোস্ত চা খাই, বন্ধুই তো তুই আমার, মেয়ে বন্ধু বলে কোমড়েও হাত দিল। মাইক্রো সেকেন্ডে ফোন বের করে সেলফি নিয়ে নিল। জাহিদের খুব কষ্ট হচ্ছিল। জোর করে গায়ে হাত দিলে এমন গা ঘিন ঘিন করে আগে তো সে টের পায়নি। বিয়ের পর সুমনাকেও প্রথম এমন জোর করেই স্পর্শ করেছিল ও। সুমনার চোখের জল কি এজন্যই ছিল? মেয়ে-মানুষ হবার এত যন্ত্রণা! চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিল সে। এরমধ্যে লোকজন চলে এলে বন্ধু কেটে পড়ল।
সুমনার বিয়ে হয়ে গেল। কিন্তু বাজারের ঘটনার অনুরূপ ঘটনা প্রায়ই নানান ক্ষেত্রে তার সাথে ঘটতে লাগল। বেশিরভাগই তার আগের বন্ধু-বান্ধব। নালিশ করতে সে এলাকার চেয়ারম্যানের কাছে গেল। চেয়ারম্যান তাকে আশ্বাস দিল এর বিহিত করা হবে, রাতে সময় করে জাহেদার বাসায় সে আসবে। জাহেদার ইচ্ছে করল এক দলা থু ওর মুখে মারতে। সাথে নিজের মুখেও।
'দরকার নেই' বলে চলে এল সে। জাহেদার পাশের গ্রামের দূর সম্পর্কের কিছু আত্মীয়স্বজন ওর এই অবস্থা দেখে ওর বিয়ে ঠিক করল। জাহেদা রাজি ছিল না। জোর করে বিয়ে দিয়ে দিল, মেয়ে মানুষদের জন্য সমাজ যেটা সিদ্ধান্ত নেয় সেটাই ঠিক।
যার সাথে বিয়ে হল সেও কট্টরপন্থী। প্রায়ই জাহেদাকে ধরে মারে ভীষণভাবে। সে কান্নাকাটি করে আর মনে মনে অভিশাপ দেয়, মেয়ে হলে বুঝতি কত কষ্ট ওরা সহ্য কর। একদিন সকালে উঠে জাহেদা খুব চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পেল। গিয়ে দেখল তার স্বামী মহিলা হয়ে গেছে!
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন