আনাতালিয়ার মানাভগাতে গোটা পৃথিবী থেকে নৃত্য শিল্পীরা এসেছে সংগীত-নৃত্যের এই উৎসবে। এখানে পূর্বের শিল্পজগত এসে পশ্চিমে মিশেছে। গুড়িয়া উৎসবকেন্দ্রে পৌঁছাতেই দেখে তার কালচালার ট্রুপের দেরিয়া অপেক্ষা করছে।
: কোথায় গুম হয়ে গিয়েছিলে! সেই ইস্তাম্বুল থেকেই দেখছি আমাদের কাছ থেকে এমন পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছ। কাকে এমন পেলে যে আমরা এমন পর হয়ে গেলাম।
: কাউকে পাইনি; আমি একটা ফ্যান্টমের পেছনে ঘুরছি; যে আসে আবার হারিয়ে যায়!
: সে কী সর্বোনেশে কথা। কী করে এই ভূত তাড়াই তোমার মাথা থেকে।
গুড়িয়াকে দেখেই ট্রুপের আরেক নৃত্যশিল্পী আইলিন গুন গুন করে গান করে,
তোমার আলোতে আমি শিখি
কী করে ভালোবাসতে হয়,
সুন্দর তুমি আমায় শেখাও
কবিতা লেখার কলা।
তুমি আমার হৃদয়ের মাঝে নাচো
কেউ দেখতে পায় না তা
কিন্তু কখনও কখনও আমি দেখি সে নাচ
আর অমনি তা শিল্প হয়ে যায়।
গুড়িয়া হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করে, মানুষ তো বুলগেরিয়া, রাশিয়া কিংবা ফ্রান্সের নাচ দেখে আকুল হবে; যে বিট ওদের মিউজিকে; যে দক্ষতা ব্যালেরিনার অনঙ্গ শরীর জুড়ে। আমাদের নাচ কি কেউ দেখবে!
দেরিয়া উত্তর দেয়, এমনকি হয়েছে কখনও যে ঘূর্ণায়মান দরবেশ মুদ্রায় আর মেভলানার কবিতার আবেশে মন্ত্রমুগ্ধ হয়নি কেউ!
আইলিন দুষ্টুমি করে বলে, যদি দেখো দর্শক মজছে না; আমাদের নাচে; তুমি না হয় বলিউড মুভির আইটেম নম্বরে একটা খেমটা নাচ নেচে দিও!
: ধুর তা কী হয়; ডান্স ফেস্টিভ্যালে পার্মানেন্টলি ব্যান করে দেবে আমাদের ট্রুপকে।
এক ভদ্রলোক উঁকি দেয় সাজঘরে। দেরিয়া জিজ্ঞেস করে, আপনি কি খুঁজছেন কাউকে!
: আমি কি গুড়িয়ার সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি!
আইলিন মজা করে বলে, অটোগ্রাফ নেবেন নাকি!
ভদ্রলোক হেসে বলে, পেলে অবশ্যই নেব।
গুড়িয়া সামনে এগিয়ে এলে ভদ্রলোক বলে, আমরা কনিয়েতে মেভলানার কবিতা-গান আর নাচ নিয়ে একটা আসর আয়োজন করছি। আপনি আপনার বন্ধুদের নিয়ে আমাদের আসরে এলে আমরা সম্মানিত বোধ করব। অবশ্য অন্যান্য জায়গার মতো অতো বড় সম্মানী আমরা দিতে পারব না!
: আপনাদের ওখানে যেতে পারি এক শর্তে।
লোকটা একটু অবাক হয়ে তাকায়। গুড়িয়া রহস্য করে বলে, আমরা যাব, যদি আমাদের কোনো সম্মানী না দেন। আমরা সবসময় সম্মানীর জন্য নাচি না; নাচি আনন্দের জন্য।
ভদ্রলোক মাথার ক্যাপ খুলে একটু ঝুঁকে বলে, সে তো সৌভাগ্য আমাদের। কিন্তু আমাদেরও তো ইচ্ছা হয়, শিল্পের সমঝদার হিসেবে শিল্পীকে তার প্রাপ্য সম্মানীর কিছুটা অর্থমূল্যে দিতে।
আইলিন বলে, আপনি চিন্তা করবেন না, গুড়িয়া আপনাদের সম্মানটুকু নেবে, আর আমরা আসব সম্মানীটুকু নিতে।
সবাই একসঙ্গে হেসে ওঠে। ভদ্রলোক, কাল ব্রেকফাস্টের পরে আমি আপনাদের নিতে আসব মারমারার রেস্ট হাউজে।
ডান্স ফেস্টিভ্যালের ম্যানেজার এসে তাড়া দেয়, ইটালির শিল্পীদের নৃত্যের পরেই আপনাদের ডাক পড়বে। প্লিজ দ্রুত প্রস্তুত হয়ে নিন।
মঞ্চের নীলাভ আলোর মাঝে শুভ্রবসনা গুড়িয়া নে বাঁশীর সুরে আর ঢোলের তালে তালে নিশ্চল থেকে সচল হয়ে ওঠে। আইলিন ও দরিয়ার মাঝে প্রাণ সঞ্চার হয়। মিরর লাইটে দর্শক দুলে ওঠে। বেজে ওঠে রুমির গান,
তালে তালে খুশিজলে উষ্ণ মানুষেরা এসে পৌঁছে
ধীরে ধীরে খুশিজল উপাসকদের খুশিজল পৌঁছে
তারা মন্দ্র লয়ে আসার পথে
বাগান থেকে যারান ফুল যেভাবে আসে
একটু একটু করে মৃত ও জীবিতের জগত থেকে
মৃতেরা হারিয়ে গেলেও জীবিতেরা এখানে আসবে শীঘ্রই
তারা আসবে হাত ভর্তি স্বর্ণ অথবা শুন্য হাতে
তারা পৌঁছাবে দরিদ্র ও ক্ষুধার্ত
ভালোবাসার পরীক্ষায় দীর্ণ মানুষেরা
পৌঁছাবে শক্তি ও স্বাস্থ্য নিয়ে
সূর্য রশ্মির মতো বিশুদ্ধ প্রাণেরা
তারা উপত্যকার উচ্চতা থেকে এসে পৌঁছাবে
মাতাল বেহুঁশ অবস্থা থেকে
তরতাজা ও সবুজ বিশুদ্ধ বাগান হয়ে পৌঁছাবে
তাদের নির্যাস ঔদার্য্য হবে
বাগান তাদেরকে অভ্যর্থনা জানাতেই।
রুমি যেভাবে চেয়েছিল ঠিক সেইভাবে ভালোবাসা নিজ নিজ ভাষায় পথ খুঁজে নেয়। ফলে গোটা পৃথিবীর মানুষ আকুল ও আচ্ছন্ন হয়; গুড়িয়ার হাতের মুদ্রা চোখের সমুদ্র তাদের নিমজ্জিত করে ভাবজগতে। গুড়িয়া ভীড়ের মাঝে রুমিকে খোঁজে যেখানে পৃথিবীর নানা রংগের নানা ঢঙ্গের মানুষ আকাশের দিকে হাত তুলে দরবেশের মতো ঘুরতে থাকে। হঠাৎ একবার গুড়িয়ার মনে হয় রুমিকে দেখেছে সে একঝলক। মিটমিট করে হাসছিল সে।
দর্শক নারী-পুরুষ প্রত্যেকের অভিব্যক্তিতে জীবন নবায়নের চিহ্ন। এমন নির্ভার অনুভব, এমনভাবে পা দুটো মাটিতে থেকেও মাটিতে নেই, এমন আধ্যাত্মিক উড়াল। মঞ্চে গুড়িয়ার পা দুটো কি করে শুন্যে থাকে; কী করে তাকে এমন মেঘের মধ্যে ভাসমান পরীর মতো লাগে; সে রহস্য দর্শকদের অভিভুত করে। কী করে জীবনদায়ী হয়ে ওঠে সে; কী করে বিচ্ছিন্ন হৃদয়গুলো জোড়া লাগে; কী করে কেবল গীতিকবিতার কথা আর সুর আত্মার এক বিশুদ্ধযাত্রা হয়ে ওঠে। গুড়িয়ার চোখের সমুদ্র অকস্মাৎ খুশিজলের সরোবরের মতো দেখায়। মঞ্চের চারপাশ থেকে হলুদ ও গেরুয়া যারান ফুলের পাঁপড়িরা এসে লুটিয়ে পড়ে গুড়িয়ার চারপাশে।
(চলবে)
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন