দ্য হারমিট

৬৬ পঠিত ... ১৫:৫৫, জানুয়ারি ০৪, ২০২৫

20

আনাতালিয়ার মারমারাতে একটি রেস্টহাউজে উঠেই গুড়িয়া কালেইচির প্রাচীন নগরীতে হাঁটতে বের হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ১২০ থেকে দুটি শতাব্দিতে রোমান থেকে অটোমান সাম্রাজ্য, বাইজেনটাইন থেকে তুর্কী স্থাপত্যের ক্রমবিকাশের চিহ্ন নিয়ে কালেইচির সমুদ্রমুখো প্রাচীন গৃহগুলো জেগে আছে। রোমান সাম্রাজ্যের সময় থেকে কালের আলোকসরণি বেয়ে প্রধান বাইজেনটাইন নগরী হিসেবে গড়ে উঠেছিল এই জনপদ। তেরশো শতকে সেলজুক রাজবংশের শাসনকালে আরব পর্যটক ইবনে বতুতা এ নগরীতে এসেছিলেন; তিনি সে সময়ের সবচেয়ে গোছানো নগরী হিসেবে আত্তালিয়ার এই মোহময় স্থাপত্য আর রাত জেগে আড্ডা দেওয়া পুরবাসীর প্রশংসা করেছিলেন। কফি পরিবেশন করতে করতে কফিশপের মালিক মহিলা গুড়িয়াকে পরিচয় করিয়ে দেন এই জনপদের সঙ্গে। একটা টেবিলে বসে সিগেরেট খেতে খেতে ভদ্রমহিলার স্বামী বলেন, পনেরো শতকে অটোমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হবার পর বিংশ শতকে তাদের পতন পর্যন্ত এই নগরীর জৌলুস একইরকম ছিল। এখন সবই স্মৃতি। রেনোভেশনের নামে কত টাকা সরকারি লোকেদের পকেটে যায়, আর কত টাকা খরচ হয় তা আল্লাহই জানেন।

কফিশপের মালিক গুড়িয়াকে বলেন, ওর কথা শুনবে না; বুড়োদের সব আলাপ এসে রাজনীতিতে আর হতাশায় শেষ হয়। তুমি বর্তমানকে উদযাপন করো; অতীতের যতটুকু অক্ষুণ্ণ আছে সেই সোনালি রেখা ধরে হাঁটতে থাকো। ঐ মার্বেল বসানো আকাবাঁকা পথ আর সরু গলিতে দুটো শতাব্দী বেঁচে আছে নানা রহস্যে নানা লাস্যে।

ইস্তাম্বুলের মশলাবাজারের প্রত্ন কফিশপে আড্ডা দেবার পর লোকটা আবার হুট করে উঠে হন হন করে হেঁটে চলে যায়। একটা প্রেমের কবিতা বলে তারপর একটা মানুষ এভাবে যে উঠে যেতে পারে; তা কল্পনা করতে কষ্ট হয়। কবি এতটা এন্টি রোমান্টিক হয় কী করে। গুড়িয়া আনাতালিয়ায় একটা ডান্স ইভেন্টে এসেছে; কিন্তু মনের মধ্যে থেকে কিছুতেই তাড়াতে পারেনি লোকটাকে।

কালেইচি নামটা গুড়িয়াকে কোলাইচির কথা ভাবায়। কোলাইচি বন্দরেও সে রোমানদের প্রাচীন সরাইখানা দেখেছে। কালেইচির লাল টালির ছাদ আর শ্বেত পাথরের মেঝের গৃহগুলোর সঙ্গে হুবহু মিলে যায় তা কোলাইচি বন্দরের নাবিকদের বিশ্রাম গৃহ। রোমানরা যেখানেই গেছে স্থাপত্যের মাঝে নিজেদের সিগনেচার রেখে গেছে; যাতে হাজার বছর পরেও তাদের পায়ের চিহ্ন ঠিকই খুঁজে পাওয়া যায়। ইতস্তত অনেক কিছু ভাবতে ভাবতেই একটা গৃহের বাইরে একটা লোক এসে বলে, নানানরকম গয়না, রোমান, বাইজেনটাইন, অটোমান, তুর্কী নারীরা যেসব গয়না পরত; সব পাবে তুমি। এস আমার করা কিছু পেইন্টিং দেখাব তোমাকে। তুমি চাইলে তোমার একটা পোট্রেট করে দিতে পারি। ভূমধ্যসাগরের নীল এসে মিশেছে তোমার চোখে; তোমাকে বড্ড আঁকতে ইচ্ছা করছে।

ভেতরে ঢুকতেই দেখে একজন মহিলা সামনে প্রশস্ত টেবিল নিয়ে চেয়ারে বসে সিগ্রেটের ধোয়া ছাড়ছে। খ্যাসখেসে গলায় সে স্বাগত জানায়, কাউকে কি হন্যে হয়ে খুঁজছ তুমি; আর কখনও দেখা হবে কিনা সে আশংকা তোমার চোখে মুখে, আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো গুড়িয়া গিয়ে তার সামনে বসে। মহিলা সিগ্রেটের প্যাকেট এগিয়ে দেয়। গুড়িয়া উত্তর দেয়, আমি অনেক চেষ্টায় সিগ্রেট ছেড়েছি।

মহিলা জিজ্ঞেস করে, কোথা থেকে এলে তুমি!

: ইস্তাম্বুল থেকে।

: তা তো বুঝতে পারছি; পূর্ব না পশ্চিম কোথাকার মেয়ে তুমি!

: পূর্বের। কিন্তু উদবাস্তু হয়ে পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণে ঘুরে বেড়াই।

: সেই তো ভালো। দেখছ না আমার কেমন শেকড় গজিয়ে গেছে; ঐ অলস আঁকিয়ের পাল্লায় পড়ে।

চিত্রকর ততক্ষণে আঁকতে শুরু করেছে গুড়িয়াকে, বিড় বিড় করে বলে, এমন ফিচার খুব রেয়ার; খাড়া নাক, বাতাসে ফুলে ওঠা নৌকার পালের মতো ঠোঁট, চোখে সমুদ্র, মুখমণ্ডল জুড়ে পূর্বের মায়া, ঘাড়ে কাঁধে পশ্চিমের সটান ঋজুতা; নির্ঘাত ব্যালেরিনা কেউ।

গুড়িয়া কী বলবে ঠিক পায় না। ভদ্রমহিলা টেবিলে ট্যারো কার্ড বিছানোর আগে গুড়িয়াকে কার্ডের গোছাটাকে এক দুবার কেটে দিতে দিতে বলে, দেখেছ শয়তান বুড়োটা আমার সামনেই কীরকম ফ্লার্ট করছে। আমি না থাকলে কি করে তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ। আচ্ছা তোমার দেশের পুরুষেরাও কি এমন!

গুড়িয়া উত্তর দিতে বিব্রত বোধ করে, তবুও বলে, নারীকে তো অলরাউন্ডার হতে হয়; দশহাতে কাজ করতে হয়। নারী শব্দের প্রতিশব্দই তো দায়িত্ববোধ। তাই খোদা পুরুষকে অমন সৌখিন প্রেমিক করে সৃষ্টি করেছেন হয়তো।

শিল্পী ভদ্রলোক হো হো করে হেসে ওঠে। ভদ্রমহিলা টেবিলে উলটো করে ট্যারো কার্ড স্প্রেড করে গুড়িয়াকে তিনটি কার্ড তুলে নিতে বলে। গুড়িয়া তিনটা কার্ড তুলে আলাদা করে রাখে। প্রথম কার্ডটা খুলে টেবিলের ওপর রাখে।

খ্যাসখেসে গলায় ট্যারো কার্ড রিডার মহিলা বলে, দ্য লাভারস। প্রেম তোমাকে টানছে। তুমি একটি পবিত্র সম্পর্কের ওমের মাঝে রয়েছ। প্রেম মানেই স্যাক্রিফাইস। একজনের জন্য আরেকজনের লাইফস্টাইলে পরিবর্তন আসে। একজন  পুরোপুরি প্রেমে নিমজ্জিত হয়। কিন্তু আরেকজন যে নিশ্চিতভাবেই এতে আছে তা কখনোই নিশ্চিত নয়। তবে আমি বলি কি, অনেকসময় মুহূর্তের প্রেম, জীবনব্যাপী প্রেমের চেয়েও সিগ্নিফিকেন্ট হতে পারে।

এর পরের কার্ডটা তুলে খুলে রাখে গুড়িয়া। সেটা হাতে নিয়ে কার্ড রিডার বলে, দ্য হারমিট। তুমি এখন নিজের গভীরে ডুব দিয়ে নিজেকে খুঁজছ। এতদিন নিজেকে যতটুকু চেন তুমি তার চেয়ে বেশি চিনতে এই যে অন্তর্গত ভ্রমণ সেখানে একজন গাইড পেয়েছ তুমি। সে তোমাকে দুটো চোখের বাইরে তৃতীয় চোখের খোঁজ দেবে।

তৃতীয় কার্ড দেখে ভদ্রমহিলা বলে, দ্য মুন। ইলিউশন, মিস্ট্রি, ড্রিম। তুমি দ্বিধান্বিত, সামনের পথ জানা নেই। এখানে নিজের ইনটুইশন কাজে লাগাতে হবে।

এমন সময় অটোমান আমলের নকশায় তৈরি একটি গলার চিক যা রুপোর তৈরি; মাঝে মোতি বসানো তা গুড়িয়ার হাতে কেউ দিয়ে বলে, এটা তোমাকে অনেক মানাবে!

গুড়িয়া লোকটার হাত চেপে ধরে, তুমি এরকম হাওয়া হয়ে যাও কেন! এটা কি কোনো হিচ হাইকিং গেম চলছে নাকি আমার সঙ্গে।  

লোকটা পকেটের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে যা উঠে আসা সব ট্যারো কার্ড রিডার ভদ্রমহিলাকে দেয়। শিল্পী ভদ্রলোক গুড়িয়ার পোট্রেট মুড়িয়ে রেশমী সুতোয় বেঁধে দেয়।

খ্যাসখেসে গলায় ট্যারো কার্ড রিডার গুড়িয়াকে জিজ্ঞেস করে, তোমার বয়ফ্রেন্ডের নাম বললে না যে। 

খরগোশের মতো ব্যস্ত পা ফেলে লোকটার হাত ধরে বেরিয়ে যাবার পথে পেছন দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি হেসে বলে, রুমি।

গুড়িয়া (পর্ব-২) 

(চলবে)

৬৬ পঠিত ... ১৫:৫৫, জানুয়ারি ০৪, ২০২৫

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি


Top