ঘৃণা শব্দটি হিন্দু ধর্মের কাস্ট সিস্টেম থেকে আওয়ামী ধর্মে ঢুকে পড়েছিল। হিন্দু ধর্মে যেমন কল্পিত উচ্চবর্ণের লোকেরা কল্পিত নিম্নবর্ণের লোকদের অস্পৃশ্য ও ঘৃণ্য মনে করত; আওয়ামী ধর্মেও তেমনি প্রতিপক্ষের লোকদের ঘৃণ্য মনে করা হয়।
খেয়াল করে দেখবেন, আওয়ামী ধর্মের অনুসারীরা যখন বলে, অমুককে ঘৃণা করি; এর মাঝ দিয়ে সে তার কাস্টের উত্থান ঘটাতে চেষ্টা করে। দেখবেন অর্ধশিক্ষিত, আধাখ্যাঁচড়া সংস্কৃতি চর্চা করে আওয়ামী ধর্মের ইনফেরিয়র লোকটি এই ঘৃণা প্রকাশের মাধ্যমে নিজেকে সুপিরিয়র কিছু হিসেবে কল্পনা করছে।
ফেসবুকে দেখবেন কট্টর হিন্দুত্ববাদী ও কট্টর আওয়ামীবাদীরা ইতর, শুয়োর, ছাগল, জারজ ইত্যাদি শব্দ হরহামেশা ব্যবহার করছে। এগুলো তাদের ঘৃণা প্রকাশের ভাষা। যে হিন্দুত্ববাদী ও আওয়ামীবাদী অনেক করে রবীন্দ্র সংগীত শুনে ফেলেছে, সে একটু ইউফেমাইজ করে বরাহ, ছাগু, বাস্টার্ড ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে।
হিন্দুত্ববাদী ও তা ঘন আওয়ামীবাদী মূলত ঘৃণা করে মুসলমানদের। এই ঘৃণা এসেছে ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স থেকে। সে যখন সংস্কৃতি নিয়ে নানা ভং চং করেও সুলতানি আমল, মুঘল আমল ও নবাবী আমলের কবিতা, শাস্ত্রীয় সংগীত, শিষ্টাচার, নান্দনিকতাকে অতিক্রম করতে পারে না; তখন মুসলমান মানেই মৌলবাদী বলে ঘৃণা প্রকাশ করে। এ কারণে ভারতের উচ্চ শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনা হিন্দুরা সংকীর্ণ হিন্দুদের এই মুসলিম বিদ্বেষকে প্রত্যাখান করেন। আপনি আজকের শান্তি নিকেতনের ছাত্র-ছাত্রী, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বললেই বুঝবেন, তারা কারও প্রতি কোনো বিদ্বেষ প্রকাশ না করে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সমাজকে দেখে। হিন্দু-মুসলমান দুটো সংস্কৃতিকেই উদযাপন করে।
কিন্ত হিন্দুত্ববাদ প্রশিক্ষিত আওয়ামী সংস্কৃতি সমাজ শিখেছে, মুসলমানের প্রতি ঘৃণা প্রকাশই, সেকুলারিজমের পূর্ব শর্ত। এরা মুসলমানদের ‘জামায়াত’ ও ‘পাকিস্তান’ শব্দ দিয়ে গুণ করে আদৃত হয় উদারপন্থী সমাজে।
ধরুন আপনি গ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছেন; অথবা ঢাকায় একটি টেনেকষে নিম্নমধ্যবিত্তের জীবন যাপন করেন; দ্রুততার সঙ্গে আপনি উচ্চবর্ণ হতে চাইলে আপনাকে পাঞ্জাবি ও ফতুয়া পরে ঝোলায় দুটি বই নিয়ে ঘুরতে হবে। আওয়ামীলীগের সংস্কৃতি পুরোহিতদের সঙ্গে ছবি তুলে ফেসবুকে দিতে হবে। ললিতাদি ও আনারকলি আপাকে আইকন হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। শিবব্রত দাদার কাছ থেকে রামায়ণ ও মহাভারতের গল্প শুনে তা থেকে রেফারেন্স দিতে শিখতে হবে। দিল্লিতে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পালিয়ে যাওয়াকে সীতার বনবাস বলে অভিহিত করতে করতে হবে। ফেসবুকে লিখে দিতে হবে, সীতার অগ্নিপরীক্ষা শেষে বুবু ঠিকই ফিরবেন।
ঢাকার সংস্কৃতি মামা-খালারা ঊনবিংশ শতকে জোড়াসাঁকোর পরিবারের সদস্যদের মতো পোশাক পরে ঘুরে, কল্পনায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদার ও জমিদার গিন্নী হয়ে উঠেছেন। এই কারণে ফেসবুকে উনারা যখন কথা বলেন, ওপর থেকে নীচের দিকে তাকিয়ে কথা বলেন। কথা বলার এই টোনটা আপনি ভারতের মিডিয়ার অর্ণব গোস্বামী, ময়ূখ, পালকি শর্মাসহ বেশ কিছু উপস্থাপকের মাঝে পাবেন। এরা হচ্ছেন ভারতের ব্যাকডেটেড লোক। আর ভারতের আধুনিক মানুষেরা কেমন হন, তা তো দেখেছেনই, কবীর সুমন, অর্ক ভাদুড়ী, বিশ্বেন্দু নন্দ, সৌমিত্র দৌস্তিদার, অত্রি ভট্টাচার্যের বাক-সক্রিয়তায়। এরাই হচ্ছেন ভারতীয় সমাজের মূলধারা। যারা কোনো কিছুকে জামায়াত কিংবা পাকিস্তান দিয়ে গুণ করে মুসলিম বিদ্বেষ প্রকাশকে অশালীন আচরণ বলে মনে করেন।
বাংলাদেশের আওয়ামী ধর্ম হচ্ছে কাস্ট সিস্টেম নির্ভর একটি আদিম ধর্ম; যার স্বপ্ন জুড়ে লর্ড কর্নওয়ালিশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদার হবার ভ্রান্ত অধ্যাস। এই ধর্মের প্রধান উপাদান ঘৃণা চর্চা। ঘৃণার ন্যারেটিভে তৈরি এদের রাজনৈতিক মতবাদ। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে সম্মুখসমরে অংশ নিয়েছেন নতুন স্বাধীনতা ঘোষণা করা বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ও পুলিশের লোকেরা, কৃষক-শ্রমিক-মেহেনতী মানুষেরা। আর আওয়ামীলীগের লোকেরা দেশ স্বাধীন হলে কীভাবে নতুন জমিদার হতে হবে, তার প্রশিক্ষণ নিয়েছে কলকাতায় পূর্ব বঙ্গের সাবেক বৃটিশ কোলাবরেটর জমিদারদের সেকেন্ড হোমে বসবাসরত উত্তর পুরুষদের কাছে। ফাঁপা অভিজাত লোকেরা কীভাবে মুখে সুপারি পুরে ভস ভস করে ইতিহাসের ন্যারেটিভ বানায় ঐটা শিখে আওয়ামীলীগের নতুন বুর্জোয়ারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা করেছে। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী, পুলিশ বাহিনী, কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষ লেখালেখি করেন না। ফলে মুক্তিযুদ্ধে তাদের বীরত্বের ইতিহাস অধরা থেকে যায়। আর আওয়ামীলীগের ইতিহাস লিখিয়েরা লেগে পড়ে ইতিহাস রচনায়। যুদ্ধে যাবার বয়সে মামা ও চাচার বাসায় লুকিয়ে থাকা বীরেরা বেরিয়ে এসে ইতিহাস রচনার বাতিঘর হয়ে পড়েন। আওয়ামীলীগের ফিল্টারে সবাই তখন রাজাকার হয়ে যায়। ১৯৭১ সালে সাড়ে সাত কোটি মানুষের মাঝে মাত্র ৮০ হাজার রাজাকারকে জামায়াত ও পাকিস্তান দিয়ে গুণ করে; আওয়ামী ধর্মে অবিশ্বাসী সবাইকে রাজাকার বানিয়ে দেয় তারা।
ঐ যে সংস্কৃতি মামা-খালা ও তাদের ঘৃণাশীলনের তরুণ-তরুণীরা তারা শতমুখে আওয়ামী ধর্মের রিচুয়াল পালন করে ঘৃণা ও বিভাজনের নরকে পরিণত করে বাংলাদেশকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের অগমে দুর্গমে সাধারণ মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছে; বিপুল সংখ্যক মানুষ শরণার্থী হয়েছে; পরিবারে মুক্তিযোদ্ধা নেই, শহীদ হয়নি, বাড়ি ঘর আগুনে পোড়েনি; এমন পরিবার বাংলাদেশের প্রত্যন্তে পাওয়া কঠিন। কিন্তু ঢাকা শহরে আরামে নয় মাস কাটিয়ে ১৬ ডিসেম্বর সিক্সটিন্থ ডিভিশনে যোগ দিয়ে বিরাট মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন যারা তাদের ছেলে-মেয়েরাই সাড়ে পনেরো বছর ফেসবুকে লোকজনকে ইতস্তত রাজাকার ট্যাগ দিয়ে বেড়িয়েছে। নিজের পরিবারের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ না থাকায়, শহীদ না থাকায় ও যুদ্ধে বাড়ি ঘর পুড়ে যাবার ইতিহাস না থাকায় অনেক বেশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পূজা করতে হয়েছে এই কাজল রেখা গল্পের কাঁকনদাসীদের। অল্প কিছু সংখ্যক শহীদ সন্তানকে আওয়ামীলীগের জমিদারি দিয়ে চেতনার দোকানকে অথেনটিসিটি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের লাখো শহীদ পরিবারের সদস্যরা আওয়ামী ধর্মের মোল্লা ও পুরোহিতদের দ্বারা লাঞ্ছিত হয়েছে। তাদেরকে পাকিস্তানে চলে যেতে নির্দেশ দিয়েছে হিন্দুত্ববাদী ও আওয়ামী বাদীরা।
অবশেষে ছাত্রজনতার ধাওয়া খেয়ে ৫ আগস্টে দিল্লির কর্মচারি হাসিনা ও তার চাকর-বাকরেরা ভারতে পালিয়ে গেলেও লজ্জা হয়নি ২০০৯-২৪ মানবতাবিরোধী অপরাধের দোসর আওয়ামী ধর্মের লোকেদের। ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট ফেসবুকে ছাত্র-ছাত্রীদের হত্যার উস্কানি দিয়েছে এই ক্যানিবালেরা। তবু অনুশোচনাহীন দম্ভে তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও বিপ্লবী ছাত্র-ছাত্রীদের কলতলার ভাষায় গালি দিয়ে চলেছে। পুরোনো অভ্যাসে ভারতের প্রমাণিত সেবাদাসেরা জামায়াত ও পাকিস্তান দিয়ে গুণ দিয়ে তাদের হিন্দুত্ববাদী ঘৃণা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। ১৭৯৩ সাল থেকে ডিএনএ প্রবাহে যে মুসলিম বিদ্বেষ তৈরি হয়েছে; তা এত সহজে দূর হবার কথা নয়। এদের ঘৃণা বিদ্বেষ ও বিভাজন, শান্তিপ্রিয় হিন্দু ও মুসলমানদের সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে সদা সক্রিয়।
এদের লজ্জাও নেই। বাংলাদেশে বারবার বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও একবার বিএনপি জোটে থেকে জামায়াত রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে সরে গেলেও; এসব রাজনৈতিক দলের একজন নেতাকেও পাকিস্তানে গিয়ে আশ্রয় নিতে দেখা যায়নি। এ থেকে আওয়ামী ধর্মের মোল্লা-পুরোহিতদের ‘পাকিস্তান চইলা যাওয়া’-র কল্পনা যে বানোয়াট ও অসাড় তা প্রমাণিত হয়েছে। আর আওয়ামী ধর্মের লোকেরা ক্ষমতা হারিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ায় প্রমাণিত হয়েছে; যারা নিজেরা অন্য দেশের দালালি করে তারাই কল্পনায় দেশের সব মানুষকে অন্য দেশের দালাল বলে মনে করে। যুদ্ধের সময় রাজাকার মামা ও পাকিস্তান সরকারের সেবক সরকারি কর্মকর্তার বাড়িতে লুকিয়ে থাকায়, দেশের সব মানুষকে যেমন রাজাকার মনে হয় আওয়ামী ইতিহাস লেখিয়েদের।
আওয়ামীলীগ ও তার মনিব দিল্লি প্রশাসনের বিরুদ্ধে অপছন্দ প্রকাশ করতে গিয়ে নতুন প্রজন্মকে আওয়ামী ঘৃণা মডেল ও বিভাজন-বিদ্বেষের রিচুয়াল এড়িয়ে যেতে হবে। নতুন বাংলাদেশের হ্যান্ড বুক হচ্ছে আওয়ামী কালচারাল বয়ানে ব্যবহৃত শব্দ-বাক্য-অভিব্যক্তি বাদ দিয়ে দেওয়া। আওয়ামী আচরণ বর্জন করা। আওয়ামীলীগ যা যা করেছে; তা তা না করলেই আপনি নতুন বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতিশীল নাগরিক।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন