কনিয়ে রুমীর আনন্দনগরী হয়ে জেগে থাকে দিনরাত। গোটা পৃথিবীর পর্যটকেরা এখানে আসে। ইহুদি, খৃষ্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম এরকম নানা বিশ্বাসের মানুষ; এমনকি অবিশ্বাসের মানুষ পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসে রুমীর ভালোবাসার টানে। রুমী আমৃত্যু রোজা রেখেছেন, নিয়ম করে নামাজ পড়েছেন। আর কবিতায় ধর্মের কঠোর অনুশাসনকে ভালোবাসার মখমলে অনুবাদ করেছেন। ফলে তার কবিতা ও গান পৃথিবীর সবগুলো ধর্মের মানুষের মিলনমোহনা রচনা করেছে।
কনিয়ে যাবার পথে মাইক্রোবাসে গুড়িয়াকে কনিয়ের রুমির গল্প বলতে থাকেন মাঝবয়েসী ভদ্রলোক; যিনি রুমী মিউজিয়ামের কিউরেটর ছিলেন। অবসর নেবার পর এখন ফুলটাইম বাম রাজনীতি করেন।
গুড়িয়া জিজ্ঞেস করে, সোভিয়েত পতনের পর আর কি বাম রাজনীতির কোন ভবিষ্যত আছে! সর্বত্র তো পুঁজিবাদের লোভের দাঁত কামড় দিয়ে বেড়াচ্ছে। এমন বৈষম্যময় পৃথিবী কি আর কেউ কখনো ভেবেছিল!
: আমরা আসলে সমাজতন্ত্রের সুসময়টাকে নিজ হাতে নষ্ট করেছি; এই শতকে লিবেরেলেরা ঠিক যেরকম করে গণতন্ত্রের সুসময়টাকে নষ্ট করলো। ক্ষমতা হাতে পেলেই নিজেকে অভিজাততন্ত্রের অংশ ভাবার যে অহম; তা সাধারণ মানুষকে দূরে সরিয়ে দেয়। ফলে শেষ পর্যন্ত মানুষকে মানুষের মর্যাদা দেয় ধর্মগুলো। ফলে ইজম হিসেবে ধর্মই বারবার ফিরে আসে। পুঁজিবাদী শাসকেরা তখন ধর্মের পিঠে সওয়ার হয়; আর গোলমাল হয় সেইখানেই।
: পলিটিকস ইজ আ টিডিয়াস আর্গুমেন্ট; সাম্যের ও শান্তির পৃথিবী ইউটোপিয়া হয়ে রয়ে যায়।
ভদ্রলোক আবৃত্তি করেন,
বন্ধু আমার সহযাত্রী আমার
আমাকে জিজ্ঞেস কোরোনা আমার গন্তব্য
তাতে বরং আমাকে অসহযোগিতাই করা হবে।
আমি যে আমার গন্তব্যই জানিনা।
কলম শুধুই একটা যন্ত্র
সে জানেনা কি করে লিখতে হয়
একটি গোলক কি কখনও জানে
তার উড়ালের পেছনের ক্রিয়ার কথা?
মাতাল ও পুলিশ যেমন নাটকের চরিত্র
দাবার ছকে নেহাত গুটি
সীমাবদ্ধ তাদের চলাফেরা!
গুড়িয়া জানালার বাইরে চোখ রেখে পাহাড়ের ঢালে জলপাই বৃক্ষের ভাঁজে ভাঁজে সাদা বরফের কাশফুলের মতো ফুটে থাকা দেখে; সূর্যের আলো পড়ে তা রুপোর গয়নার মতো ঝকঝক করে। আজ গলায় সেই রুপোর মালাটা পরেছে; সেই যে রুমির পছন্দ করে দেয়া অটোমান রাজকুমারীর গয়নার নক্সায় বানানো।
ভদ্রলোক বলেন, রুমির মারা যাবার পর কনিয়ের সুলতান যিনি কনিয়ে থেকে পুরো আনাতালিয়া শাসন করতেন, সেই সুলতানের স্ত্রী; আরেক রাজ্যের রাজকুমারী নিজ উদ্যোগে রুমির সমাধি সংলগ্ন মিনারটি নির্মাণ করেন। তিনি নিজে এই নির্মাণ কাজ তদারক করতেন। অশ্রুজলে রুমির সমাধিতে গিলাফ চড়িয়েছেন তিনি। এমনকি রুমি সংগ্রহশালা নির্মাণের কৃতিত্বও তার। জনশ্রুতি আছে রুমির কবিতা শুনতে তিনি তার কাব্য আসরেও আসতেন। সুলতান তার প্রাসাদেও রুমিকে আমন্ত্রণ জানাতেন কবিতা শুনতে। সুলতানের স্ত্রী রুমির কবিতা লিখে রাখতেন।
গুড়িয়া মুচকি হেসে বলে, রুমি লোকটা দেখছি বিশ্বপ্রেমিক ছিলেন!
ভদ্রলোক আবৃত্তি করেন,
এসো এসো
গোলাপেরা ফুটতে শুরু করেছে
প্রেমিকা এসে পৌঁছেছে
এখন সম্মিলনের সময়
আত্মা তার পৃথিবীর সঙ্গে মিশবে।
এখন সূর্যালোক দেখার সময়
দুজনে এক হয়ে ছায়ার সঙ্গে নৃত্যের সময়
হাসো প্রেমে অবিশ্বাসীদের নিয়ে
যারা উচ্চকন্ঠ তাদের অবিশ্বাসের ব্যাপারে
কাঁদো সে বন্ধুদের নিয়ে যারা বন্ধুত্ব ছেড়ে গেছে
পুরো নগরী এখন ভয়ে থর থর করে কাঁপছে
যে তার শেকল ছিঁড়েছে
আহা কি দিন
অভ্যুত্থানের দিন, বিদ্রোহের দিন
আকাশ থেকে পড়ছে এতোদিনের কীর্তির নথি
ঢোল বাজাও
আর কথা বোলো না
হৃদয়, মন, আত্মা সবাই চলে গেছে
প্রেমিকার কাছে।
দূর থেকে রুমীর সমাধির ওপরের সোনালী সবুজ গম্বুজ দেখা যাচ্ছে। চৌমাথায় রুমির ভাস্কর্যের চারপাশ ঘিরে প্রেমিক প্রেমিকার তীর্থ উতসব। পৃথিবীর সমস্ত অপ্রেম, প্রত্যাখান, হৃদয়হীনতা, বিষণ্ণতা থেকে ছুটি নিয়ে ভালোবাসার নগরীতে ছুটে এসেছে নানা রঙের মানুষ। পার্থিব হিসাবের খাতা বন্ধ করে; বিভাজন বিদ্বেষের মিডিয়া ছেনালি থেকে চোখ ফিরিয়ে, হিংসা লোলুপ বয়ান নির্মাতাদের অকবিতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে; রুমির তুরীয় আকাশে রহস্যময় উড়ালের স্বপ্ন বুকে নিয়ে মানুষ ছুটছে মসনবীর পান্ডুলিপির গন্ধ নিতে। কয়েকজন শুভ বসন দরবেশ ভালোবাসার সৈনিকের বেশে মার্চ পাস্ট করছে; কতগুলো শিশু হাতে রঙ্গিন গ্যাস বেলুন উড়িয়ে স্বাগত জানাচ্ছে তাদের।
গুড়িয়ার চোখ খুঁজতে থাকে রুমিকে। আজ নিশ্চয়ই দেখা হবে একবার।
(চলবে)
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন