অন্তর্গত ভ্রমণই তো পৃথিবী ভ্রমণ

৫৭ পঠিত ... ১৬:৫৬, জানুয়ারি ০৬, ২০২৫

26 (2)

মেভলানা রুমির সমাধি আর তা সংলগ্ন মিউজিয়ামে তার কাব্যগ্রন্থগুলোর পাণ্ডুলিপি, ব্যবহৃত পোশাক দেখে কিছুটা সময় সেখানে কাটায় গুড়িয়া। এরপর রুমি মিউজিয়ামের সাবেক কিউরেটর ভদ্রলোক তাকে একটা রেস্তোরায় খেতে নিয়ে যান। সেখানে যোগ দেন এক চিত্রকর ও কনিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিনি রুমির কবিতা পড়ান। রুমির কবিতার থিম সামনে রেখে ছবি আঁকেন। আপাদমস্তক শিল্পীর জীবন তার।

গুড়িয়া তাকে রুমির কবিতার অনুপ্রেরণা শামস তাবরেজ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে।

 শিক্ষক ভদ্রলোক বলেন, রুমি ইসলামি আইন ও ধর্মতত্ত্বের পাঠ নিতে একবার সিরিয়ায় গিয়ে কিছুকাল ছিলেন। সেখানেই এক বয়স্ক পর্যটকের সঙ্গে দেখা দেয়। তিনিই তাবরেজ যিনি রুমির সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিতর্ক করেন ধর্মতত্ত্বের নানা বিষয়ে। এই কাজটা অনেকটা প্যাঁচ লেগে যাওয়া উলকে (সুফ) গুছিয়ে আনার মতো। সাফা বা বিশুদ্ধতা অর্থেও চিন্তাজগতের এই ক্ল্যারিটিকে ব্যাখ্যা করেন অনেকে। এই যে তাবরেজ ও রুমির ধর্মতত্ত্ব আলোচনা; তা থেকে সত্য, সুন্দর, মঙ্গল, বন্ধুত্ব, প্রেম অর্থে ধর্মচর্চা প্রতিভাত হয় উভয়ের কাছে। তার মানে ধর্মকে নেহাত কঠোর অনুশাসন হিসেবে না রেখে একে সহজিয়া ভালোবাসার অর্থে গ্রহণ করলেই তা বরং অধিকাংশের জীবনে অর্থবহ হয়। ধর্মকে দার্শনিকতা দিয়ে ব্যাখ্যা করলে; ভিন্নমত গ্রহণের ঔদার্য তৈরি হয়। নইলে ধর্ম একগুঁয়ে একমত ও একপথের ফ্যাসিজম হয়ে দাঁড়ানোর ভয় থাকে। ধর্মকে আক্ষরিক অর্থে না নিয়ে এর অন্তর্নিহিত রহস্যভেদের  আলোর ঠিকানা পেয়ে রুমি ভীষণ আনন্দিত হন। তাবরেজের সঙ্গে তৈরি হয় তার শ্রেষ্ঠতম বন্ধুত্ব। তাবরেজ রুমির আমন্ত্রণে কনিয়েতে এলে দুজনে কাব্যচর্চায় মেতে ওঠেন। তাবরেজ বলেন, পরিবর্তনকে বাধা না দিয়ে তাতে আত্মসমর্পণ করো। জীবন হোক তোমার সঙ্গে, তোমার বিরুদ্ধে নয়। আমার জীবন হয়তো এতে ওলট-পালট হয়ে যাবে; কিন্তু কে বলেছে ওলট পালট হয়ে যাওয়া শ্রেয়তর কিছু নয়!

গুড়িয়া জিজ্ঞেস করে, রুমির সঙ্গে তাবরেজের বন্ধুত্ব নিয়ে তার পরিবার ও সমাজের এতো আপত্তি ছিলো কেন!

: তাবরেজ সমাজের বেঁধে দেয়া নিয়মগুলো একেবারেই মানতেন না। তিনি ছিলেন বোহেমিয়ান। তিনি বলছেন, প্রত্যেকের প্রার্থনার নিজস্ব নিয়ম থাকে, কে কিভাবে খোদাকে ডাকছে তা নিয়ে বিচার বসিয়ো না। খোদা আমাদের উচ্চারিত শব্দকে গুরুত্ব দেননা। তিনি আমাদের হৃদয়ের মধ্যে উঁকি দিয়ে দেখেন। আনুষ্ঠানিকতাতে কিছু এসে যায় না। বরং হৃদয়ের বিশুদ্ধতাটাই বেশি জরুরি।

রুমি মিউজিয়ামের সাবেক কিউরেটর বলেন, ভাবতে পারেন এতো আগেই কত অগ্রসর চিন্তার মানুষ ছিলেন তাবরেজ। এই আধুনিক ভাবনাকে আসলে হজম করতে পারেনি কনিয়ের গড়পড়তা লোকেরা। আর বোঝেন তো, আড্ডা কেবল মনের মানুষদের সঙ্গেই জমে। সে কারণে রুমি জীবনের গভীরের জীবন নিয়ে যে আলাপ কেবল তাবরিজের সঙ্গে করতে পারেন; তা উনার পরিবারের সদস্য কিংবা অন্য অনুসারীদের সঙ্গে সম্ভব ছিলো না। ফলে তাবরেজ চক্ষুশূল হয়ে পড়েন অনেকের। একবার তিনি কনিয়ে ছেড়ে চলে যান। তিনি যেমন বলছেন, 'প্রতিটি প্রশ্বাসই আধ্যাত্মিক পুনর্জন্মের সম্ভাবনা; কিন্তু নতুন এ জীবন লাভ করতে গেলে, মৃত্যুর আগেই মরতে হয়।' পরে তিনি কনিয়ে ফিরে আসেন। কিন্তু একরাতে তাকে কিছু লোক ডেকে নিয়ে যায়; আর তিনি ফিরে আসেননি।

গুড়িয়ার মন খারাপ হয়, কি আশ্চর্য! দুজন কবির বন্ধুত্বে অকবিদের এ কোন ফাঁপা ঈর্ষা!

শিক্ষক বলেন, মানুষ তার অভিজ্ঞতার সমান। পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষিত  লোকেরাই তাদের স্টেরিওটাইপিং-এর অভ্যাসে কত গল্প ফেঁদেছে রুমি-তাবরেজের বন্ধুত্ব নিয়ে। দেখবেন, নিজামউদ্দিন আউলিয়ার সঙ্গে খসরুর বন্ধুত্ব নিয়েও এরকম স্টেরিওটাইপিং আছে। আসলে অধিকাংশ মানুষই বোঝে না যে, অরণ্যে ঝড়ের সময় গাছের দুটি ডালের ঘর্ষণে যে আলো জ্বলে ওঠে তাকে দ্যুতি-অরণী বলে। দুজন কবির আড্ডাও তেমনি এক দ্যুতি-অরণীর সৃষ্টি করে। এই যে কিউরেটর সাহেবের সঙ্গে আমার যে নিরন্তর সাহিত্য-দর্শনের আলাপ; এই বন্ধুত্বই তো জীবনদায়ী। চলুন আপনাকে তাবরেজের সমাধি দেখিয়ে আনি।

তিনজন হাঁটতে হাঁটতে কনিয়ে বাজারের মাঝ দিয়ে তাবরেজের সমাধিতে গিয়ে উপস্থিত হয়। কিউরেটর আবৃত্তি করেন তাবরেজ থেকে,

আসল আবর্জনা বাইরের জগতে নয়

থাকে আমাদের হৃদয়ের ভেতরে।

যে কোন দাগ পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলা যায়

কিন্তু মনের গহীনে প্রতিহিংসা ও অসত উদ্দেশ্যের দাগ

কিছুতেই ধুয়ে ফেলা যায় না।

গুড়িয়া জিজ্ঞেস করে, আমরা কি এখন অনুষ্ঠানস্থলে যাবো?

শিক্ষক উত্তর দেন, তাবরেজ বলেছেন, তুমি উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম যেদিকেই যাও, একে হৃদয়ের গভীরে ভ্রমণ বলে মনে করো।  নিজের মধ্যে ভ্রমণই তো পৃথিবী ভ্রমণ।

(চলবে)

 

৬ষ্ঠ পর্বের লিংক 

৫৭ পঠিত ... ১৬:৫৬, জানুয়ারি ০৬, ২০২৫

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি


Top