কনিয়েতে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও লোকটার দেখা পায় না গুড়িয়া। আনাতালিয়ার সংগীত নৃত্য উৎসবে তবু তো একঝলক তাকে দেখা গিয়েছিল মনের ভুলে। কিন্তু কনিয়ে যেখানে শহরের এখানে ওখানে ছড়িয়ে তার পায়ের চিহ্ন; সেখানে এমনকি ঘূর্ণায়মান দরবেশ নৃত্যের রুপালি সাঁঝেও তার দেখা মেলেনি। কনিয়ে থেকে ফেরার পথে পেছনের দিকে তাকিয়ে পাহাড়ের ঢালে জলপাই বনের মাঝে জমে থাকা সাদা বরফ জ্যোৎস্নার সঙ্গে মাখামাখি করে অনঙ্গ আকাক্ষার দরবেশ নৃত্য করছিল। মাইক্রোবাসের মিউজিক সিস্টেমে তখন বাজছে রুমিরই নির্ঘুম গীতিকবিতা।
আমি যখন ঘুমাতে পারি না রাতে
তখন সংগীত সৃজন করি।
সেই একজন আমাকে বড্ড বিপদে ফেলেছে
যার মুখাবয়ব বসন্ত-ফুলের রঙ-এ রঙ্গিন।
আমার ঘুমও নেই ধৈর্য্যও নেই
সুনামও নেই, কুখ্যাতিও নেই
হাজারও জ্ঞানের আলখাল্লাও হারিয়েছি
সমস্ত শিষ্টাচার শত ক্রোশ দূরে চলে গেছে
হৃদয় ও মন একে অপরের সঙ্গে রাগারাগি করে বিচ্ছিন্ন
তারারা চাঁদের সঙ্গে শত্রুতা শুরু করেছে
এইসব বিচ্ছেদে পার্থিব যা কিছু কোমলতা হারিয়েছে।
চাঁদ জিজ্ঞেস করে, আমি আর কতকাল সূর্যের সঙ্গবিহীন থাকব!
ভালোবাসার জহরতহীন রিক্ত হৃদয়ে
পাথরে পাথরে আমার অস্তিত্বের বাজারটা বিনাশ হতে দাও
ও ভালোবাসা, তোমাকে হাজার নামে ডাকা হয়েছে
তুমি জানো কী করে দেহের পানপাত্রে খুশিজল ঢালতে হয়
তুমি সংস্কৃতি দাও হাজারও সংস্কৃতিকে
তোমার মুখাবয়ব নেই কিন্তু হাজারও মুখমণ্ডল আছে
ও তুর্কী, ও ইউরোপীয়, ও জাঞ্জিবারীয়
আমাকে তোমার বোতল থেকে একগ্লাস ঢেলে দাও।
অথবা তোমার শাখা প্রশাখা থেকে এক মুঠো দাও
আরেকবার বোতলের ছিপি খোলো
দেখবে হাজারও গোত্রপ্রধান নেশায় চুর
দেখবে বৃত্তাকারে কবিরা প্রেমের গীতিকবিতা মত্ত
তখন নেশাসক্তের নেশা ছুটে যাবে
পুনর্জাগরিত হয়ে সটান দাঁড়িয়ে থাকবে চূড়ান্ত বিচারের দিন অব্দি।
গুড়িয়া আনাতালিয়া থেকে ইস্তাম্বুল ফেরার আগে সেই ট্যারো কার্ড রিডারের কাছে যায়। ট্যারো কার্ড রিডার আরেকবার ট্যারো কার্ড ছড়াতেই গুড়িয়া চোখ বন্ধ করে একটা কার্ড তুলে বলে, দ্যা হারমিট। আমি জানি এটা সেই কার্ডটাই। ট্যারো কার্ড বিস্মিত হয়ে বিস্ফারিত চোখে তাকায়। গুড়িয়া তাকে জিজ্ঞেস করে, সেদিন তোমার কাছ থেকে ফিরে যাবার সময় কি কেউ আমার সঙ্গে ছিল! ঐ যে পকেট থেকে পয়সা বের করে দিল, আমাকে একটা মালা পছন্দ করে দিল।
ট্যারো কার্ড রিডার বলে, না তো; তুমি নিজেই তো ব্যাগ থেকে টাকা বের করে দিয়েছিলে। তারপর একা একাই ঝট করে উঠে চলে গিয়েছিলে।
গুড়িয়া সেই ইরানি গাড়িচালককে বলে তাকে সঙ্গে করে আবার সেই মারকুস আরলিউয়াসের এম্ফিথিয়েটারে নিয়ে যেতে। পথে জিজ্ঞেস করে, সেদিন এম্ফিথিয়েটারে যাবার পথে আমার সঙ্গে কি কেউ ছিল!
ইরানি ড্রাইভার বলে, আপনি একাই ছিলেন। আপনাকে একা একা কথা বলতে দেখে আমি ভেবেছিলাম বুঝি ফোনে কারো সঙ্গে কথা বলছেন।
এম্ফিথিয়েটারে ঢুকে কয়েকবার রুমি রুমি বলে ডাকলে প্রতিধনি হয়ে ফিরে আসে গুড়িয়ার সে ডাক। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে কাউকে ফিরে না পেয়ে গাড়ি করে বিমানবন্দরে যায়। সেখানে আইলিন ও দেরিয়া অপেক্ষা করছি ইস্তাম্বুলে ফেরার ফ্লাইট ধরার জন্য। গুড়িয়ার হানা চেহারা দেখে দেরিয়া জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে তোমার! এমন অপ্রকৃতিস্থ দেখাচ্ছে কেন তোমাকে!
: ও কিছু না।
ইস্তাম্বুলে নেমেই গুড়িয়া চলে যায় মশলাবাজারের সেই প্রত্ন সামগ্রীর দোকানে। দোকানদারকে জিজ্ঞেস করে, আমি সেদিন আপনাকে একজনের সঙ্গে দাবা খেলতে দেখেছিলাম। সে লোকটা কি প্রায়ই আসে!
: দাবা খেলার সঙ্গী পাব কোথায়! আমি তো একা একাই দাবা খেলি।
গুড়িয়া সে অটোমান আমলের কোর্ট ইয়ার্ডে কফির দোকানে যায়।
যে ছেলেটা নে বাজাচ্ছিল, তার বংশীবাদন একটু থামিয়ে জিজ্ঞেস করে, সেদিন আমি এখানে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে কফি খেতে এসেছিলাম, চেন কি তাকে!
: কতজন এল গেল কতজনই আসবে কফি হাউজটা তবু থেকে যায়।
গোলাপ বিক্রেতা ছেলেটার কাছে গিয়ে গুড়িয়া হন্তদন্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে, মনে আছে সেদিন তোমার কাছ থেকে একটা গোলাপ কিনেছিলাম। আমার সঙ্গে যে লোকটা ছিলো তাকে মনে আছে।
ছেলেটা মাথা নাড়িয়ে বলে, আপনি তো একাই ছিলেন ম্যাম। আর কাউকে তো দেখিনি আপনার সঙ্গে।
গুড়িয়া এবার হন্তদন্ত হয়ে দৌড়াতে থাকে সেই ট্রাফিক লাইটের কাছে যেখানে সিরীয় শরণার্থী মা আর তার সন্তানদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে হঠাৎ তাদের আসতে দেখে গুড়িয়া তাদের গিয়ে জিজ্ঞেস করে আরেকদিন দেখা হওয়ার কথা। সিরীয় মহিলা ঠিক মনে করতে পারে না। তার বড় মেয়েটি বলে, আপনি আপনার ব্যাগে যত টাকা আছে সব বের করে দিয়েছিলেন। আমি আপনাকে ফেরেশতা ভেবেছিলাম। তাই মনে আছে আপনাকে।
: আমি কি একা ছিলাম নাকি সঙ্গে অন্য কেউ ছিল!
: অন্য কাউকে তো মনে পড়ছে না।
গুড়িয়া এবার সে রাতের ক্রুজ স্টিমারে যায়। ঘাটে বাঁধা ছিল। ভেতরে গিয়ে স্টিমারের সারেং-এর সঙ্গে দেখা করে। যদি ডেকে ঐ লোকটার সঙ্গে গুড়িয়াকে দেখে থাকে এ আশায়।
সারেং কিছুই মনে করতে পারে না। অল্প বয়েসী একটি ছেলে বেশ খানিকটা মনে করার চেষ্টা করে বলে, আমি আপনাকে ডেকে একটা চেয়ারে বসে থাকতে দেখেছি। ও হ্যাঁ, আপনি একবার রেলিং-এর ওপর উঠে বসেছিলেন। কিন্তু আপনি তো একাই ছিলেন ম্যাম।
গুড়িয়ার অবিশ্বাস্য লাগে এই কয়েকদিনের চক্কর। রেস্ট হাউজে ফিরে দেখে দেরিয়া অপেক্ষা করছে। ওর রুমে গিয়ে প্যাকিং-এ সাহায্য করে। আইলিন আসে বিদায় জানাতে। ওর মা বেকিং করে কিছু কুকিজ দিয়েছেন। এবার দেশে ফিরতে হবে গুড়িয়াকে। ফ্লাইটের বেশি দেরি নেই। নেহাত দেরিয়া প্যাকিং করে দিয়েছে বলে কোনোমতে হন্তদন্ত হয়ে এয়ারপোর্টে পৌঁছায়। ইস্তাম্বুল থেকে ফেরার সময় এত মন খারাপ তার কখনও হয়নি। এবার কেন জানি মনে হচ্ছে নিজেকেই ইস্তাম্বুলে রেখে কেবল বাক্স-প্যাটরার মতো ফিরে যাচ্ছে সে। এয়ারপোর্টে শেষ বারের মতো তাকিয়ে চারপাশে দেখে; কোথাও যদি তার দেখা মেলে। বোর্ডিং অ্যানাউন্সমেন্ট চলছে দুবাইগামী যাত্রীদের জন্য।
পড়িমরি করে দৌড়ে কোনোমতে প্লেনে ওঠে গুড়িয়া। এয়ার হোস্টেসরা সাহায্য করে হ্যান্ডলাগেজ ওপরে রাখতে। একজন দৌড়ে এসে বলে, আপনি সিটে বসে সিটবেল্ট বেঁধে নিন প্লিজ। গুড়িয়া সিটবেল্ট বেঁধে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকে। প্লেন টেক অফ করে উড়াল দিয়েছে যখন, পাশে উইন্ডোসিটে বসা লোকটা বলে ওঠে, ভাবলাম আকাশের উড়াল পথে তোমাকে কিছু দূর এগিয়ে দিয়ে আসি। আবার কবে দেখা হবে কে জানে!
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না গুড়িয়া।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন