স্কুলে থাকতে একবার আমাকে পাঁচটা ফলের নাম বলতে বলেছিলেন এক স্যার। আমি শুরুতে আপেলের কথা বলি। তারপর আরও চারটা ফলের নাম বলতে বলায় আমি বললাম আরেকটা আপেল, আরেকটা আপেল—এইভাবে পাঁচটা আপেলের নাম বলে দিলাম। প্রশ্নের ঠিকঠাক উত্তর দেবার পরও সেদিন ক্লাসে কেন মার খেয়েছিলাম, তা আমি টিফিন পিরিয়ডে এক ঘণ্টা ভেবেও বোঝে ওঠতে পারিনি। পরে অবশ্য বুঝেছিলাম গোলমালটা কোথায় ছিল।
স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শেষ হলে বন্ধুদের সঙ্গে ক্যাফেটেরিয়া বা অন্য কোথাও বসে আড্ডা মারতে সবাই উন্মুখ থাকে। এসব আড্ডা যেমন দিনের ক্লান্তি দূর করে তেমনি হাসি-ঠাট্টায় নিজের মনটাকেও চাঙ্গা করা যায়।
কিন্তু একটা বিষয় লক্ষ্য করেছেন কি? আপনি যাদের সাথে আপনার চিন্তাধারা মেলে, তাদের সাথেই বেশি কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। আপনার পছন্দের গানের সঙ্গে যাদের রুচি মেলে, তাদের সঙ্গেই হয়তো কনসার্টে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। ভ্রমণের আগে তাদেরই খবর দেন যাদের সঙ্গে আগেও ভালো ট্যুর কাটিয়েছেন। স্কুল জীবনের বন্ধুত্বও বেশিরভাগ সময়ই ছোটোবেলার পরিচিত মুখগুলোর সঙ্গেই গড়ে ওঠে।
আপনার ফেসবুক বা অন্য সামাজিক মাধ্যমেও একই চিত্র। বন্ধুদের তালিকায় মূলত তাদের নামই থাকে যাদের মতামত আপনার সাথে মেলে বা যারা আপনার লাইনের মানুষ। গভীর ভেবে দেখলে বুঝবেন, আপনি এমন লোকদের সঙ্গেই বেশি সময় কাটান, যাদের আপনি নিজের মতো মনে করেন।
এইভাবে অনলাইন বা অফলাইন যাদের সঙ্গে সংযোগ রাখেন, তাদের দিয়েই গঠিত হয় আপনার ‘সোশ্যাল বাবল’। এই বাবলে যারা থাকে, তাদের সঙ্গে মেলামেশা যেমন আরামদায়ক হয়, তেমনি স্বস্তিদায়ক। এর পেছনে দুই গুরুত্বপূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক কারণ কাজ করে।
প্রথমত, মানুষ স্বাভাবিকভাবেই ভিন্ন মতকে সহজে গ্রহণ করতে পারে না। ভিন্ন মতের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করা অনেক সময় অস্বস্তিকর হয়। দ্বিতীয়ত, মানুষের মধ্যে এমন একটি প্রবণতা কাজ করে যেখানে নিজের মতকে অন্য কেউ সমর্থন বা গ্রহণ করছে দেখলে মানসিক সান্ত্বনা পাওয়া যায়।
এই কারণে আপনার দুনিয়ার পরিধি মূলত তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ যাদের চিন্তাভাবনা, রুচি বা পছন্দ-অপছন্দ আপনার সাথে মেলে। যাদের সাথে মেলে না তাদের খুব যত্ন করে পাশকাটাতে আপনি কিংবা আমি, আমরা সবাই পটু।
আমেরিকান উদ্যোক্তা ও লেখক জেমস রোহন বলেছেন, আপনি আসলে আপনার আশেপাশের পাঁচজন মানুষের গড়। যদি আপনার আশেপাশে সবাই একই ধরনের হয়, তাহলে আপনি মূলত একটি ইনফিনিট লুপের মধ্যে আছেন যেখানে নতুনত্বের কোনো সম্ভাবনাই নেই।
সোশ্যাল বাবল অনেকটা আপনার পড়া বইয়ের মতো। যত বেশি বই পড়বেন, তত বেশি গল্প, দৃশ্যপট, কথোপকথন ও ইমোশন আপনার ভেতরে জন্ম নেবে। জীবনেও একই ব্যাপার। এক একজন মানুষ এক এক বইয়ের মতো; যাদের সঙ্গে কথা বলবেন, তাদের জীবনের কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে কানেক্ট করতে পারবেন।
চায়ের টেবিলে বসে প্রতিদিন একই বিষয় নিয়ে কথা বলা ছাড়া, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ শুরু করতে পারেন। ২৪ ঘণ্টায় এক দিন কেন হয়/ মরিচ খেলে ঝাল লাগে কেন? বা বাথরুমে গেলে মজার আইডিয়া আসে কেন? এসব অবান্তর প্রশ্ন দিয়েই না হয় শুরু করলেন। তবে আপনার জীবনে চিন্তার কলুর বলদ থেকে নিজেকে বের করার জন্য আপনি ছাড়া আর কেউ নেই
এছাড়া নতুন কাউকে নক দিতে পারেন, চা খেতে গেলে পাশের টেবিলে গিয়ে তাদের সঙ্গে পরিচিত হতে চেষ্টা করতে পারেন, তাদের কাছে জীবনের মানে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। আপনি এসবকে অর্থহীন মনে করলে একটু ভুল ভাবছেন।
জীবনের সত্যিকার শুরু হয় তখনই যখন আপনি আপনার নিজের বাবল থেকে বের হয়ে আসেন। বিভিন্ন ধরনের মতের সঙ্গে পরিচিত হন, আপনার সাথে মেলে না এমন মতপোষণকারীদের সঙ্গেও এক টেবিলে বসে থাকতে পারেন। আপনি জানেন আপনার বাবলের ভেতর কী আছে কী নেই, কিন্তু বাইরের দুনিয়া ইনফিনিটলি বড়। সেটা জেনেও কী আপনি নিজেকে কুয়োর মধ্যেই আটকে রাখতে চান?
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন