গ্ল্যাডিয়েটর-টু চলচ্চিত্রটি দেখতে গিয়ে মনে হলো, বৃটিশেরা রোমান মব বলে যে বাক্যবন্ধ চালু করেছিল; তা হচ্ছে বৃটিশ উপনিবেশগুলোতে গণঅভ্যুত্থানের পরিবেশ সৃষ্টি হলে তাতে বিরক্ত হয়ে বকে দেবার পন্থা। মব শব্দটি আসলে সাধারণ মানুষের অধিকার অস্বীকার করে তাদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করার অপকৌশল। গ্ল্যাডিয়েটর-টু ছবিতে রোমের সাধারণ জনগণ অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে প্রয়োজনের সময় ফুঁসে উঠেছে। গেটা ও কারাসালার মতো দুর্নীতিবাজ দুই শাসকের বিরুদ্ধে রোমানদের জনপ্রতিরোধ চিত্রিত হয়েছে এই চলচ্চিত্রে।
এই চলচ্চিত্র গেটা ও কারসালার প্রশাসনের দুর্নীতি, নির্যাতন ও বৈষম্যমুখর যে সমাজের ছবি আঁকে; অনায়াসে তা হয়ে ওঠে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসন আমলের প্রতিবিম্ব। জাঢ্য জরদগব প্রমোদে ঢালিয়া দিনু ধরনের সেনেট সদস্যদের দেখলে আওয়ামীলীগের মন্ত্রীসভার তেলাঞ্জলিপ্রবণ সদস্যদের কথাই মনে পড়ে।
দার্শনিক শাসক মার্কুস আরিলিয়াসের মৃত্যুর ১৬ বছর পরের রোমান পটভূমিতে বিস্তার লাভ করেছে এই চলচ্চিত্রের প্লট। উত্তর-পূর্ব আফ্রিকীয় উপকূলের রোমান প্রদেশ নুমিডিয়াতে রোমান সেনার জেনারেল আকিসিয়াস হামলা করলে সেখানে হান্নো পরিচয়ে বেড়ে ওঠা আরলিয়াসের নাতি লুসিয়াস ভেরাস আরলিয়াসের স্ত্রী আরিশাত নিহত হয়। যুদ্ধবন্দী দাস হিসেবে রোমে আসে লুসিয়াস। গ্ল্যাডিয়েটর হিসেবে শৌর্য প্রদর্শন করতে শুরু করে। ঘোড়াশালের গুরু ম্যাক্রিনাস আশা দেখায়, লুসিয়াস ভবিষ্যতে জেনারেল আকিসিয়াসকে হত্যা করে স্ত্রী আরিশাত নিহত হবার প্রতিশোধ নিতে পারবে।
লুসিয়াস গ্ল্যাডিয়েটর হিসেবে কলোসিয়ামে হিংস্র বেবুনকে হত্যা করে। শাসক গেটা ও কারসালা জেনারেল আকিসিয়াসের নুমিডিয়া বিজয় উদযাপন করে। আকিসিয়াস কিছুদিন তার স্ত্রী লুসিলার সঙ্গে কাটানোর সুযোগ প্রার্থনা করে। কিন্তু সম্রাটেরা তাকে নির্দেশ দেয় পারস্য ও ভারতবর্ষ অভিযানে যেতে। এই লুসিলা দার্শনিক সম্রাট মারকুস আরলিয়াসের মেয়ে। তার স্বামী কিংবদন্তীর গ্ল্যাডিয়েটর ম্যাক্সিমাসের মৃত্যুর পর তাদের সন্তান লুসিয়াসকে রোম থেকে দূরে পাঠিয়ে দেয় ছেলের প্রাণ বাঁচাতে। সেখানে সে হান্নো নামে বেড়ে ওঠে। সেই ছেলে যুদ্ধবন্দী দাস হিসেবে রোমে ফিরে এসে একজন নায়কোচিত গ্ল্যাডিয়েটর হয়ে ওঠে।
সেনেটর থ্রায়েক্স সম্রাটদের সম্মানে নিজ গৃহে একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করে। সেখানে পাপিয়া পরিবেষ্টিত হয়ে খুশিজলে চুর দুই তরুণ সম্রাট লুসিয়াসের মল্লযুদ্ধ দেখে আরেক যোদ্ধার সঙ্গে। তার পারদর্শিতায় মুগ্ধ হয়ে সম্রাট গ্রেটা তার পরিচয় জানতে চায়। লুসিয়াস ভার্জিলের কবিতার দুটি লাইন বললে বোঝা যায়, সে রোমান ভাষা-সাহিত্যের সঙ্গে খুবই পরিচিত। এর আগে কলোসিয়ামে পিতা ম্যাক্সিমাসের মতো দু'মুঠো মাটি হাতে নিয়ে বীরের ভঙ্গিতে প্রতিপক্ষকে হত্যা করেছিল। এই দৃশ্য দেখে তার মা লুসিলা তাকে চিনতে পারে।
কলোসিয়ামে নৌযুদ্ধে বিজয়ী দলকে নেতৃত্ব দেবার সময় লুসিয়াস তীর ছুড়ে গ্যালারিতে বসে থাকা জেনারেল আকিসিয়াসকে হত্যার চেষ্টা করে। তীর লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। এরপর তার মা লুসিলা এসে ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে। কিন্তু শিশুকালে তাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে নিজে বিলাসী জীবনে থেকে যাওয়ায়; লুসিয়াস তার মাকে প্রত্যাখান করে। আর তারই দ্বিতীয় স্বামী জেনারেল আকিসিয়াস নুমিডিয়া যুদ্ধে হত্যা করেছে লুসিয়াসের স্ত্রী আরিশাতকে হত্যা করেছে।
গ্ল্যাডিয়েটরদের চিকিৎসক রাভির সঙ্গে বন্ধুত্বসূত্রে কলোসিয়ামে তার পিতা ম্যাক্সিমাসের সমাধি দেখায়। কলোসিয়ামের বাইরের দেয়ালে উতকীর্ণ বীর এই যোদ্ধার নাম মুছে দিয়েছিল বর্তমান শাসক। ইতিহাস থেকে ম্যাক্সিমাসকে সরিয়ে দেওয়াই ছিল তাদের উদ্দেশ্য।
লুসিলা তার স্বামী আকিসিয়াসকে নিয়ে রোমের গৌরব পুনরুদ্ধারে সেনেটর থ্রায়েক্স ও গ্রাচ্চুসকে নিয়ে বর্তমান দুই শাসককে উৎখাতের পরিকল্পনা করে। আকিসিউয়াস সংকল্প করে, তার স্ত্রীর সন্তান লুসিয়াসকে দাসদশা থেকে মুক্ত করতে। সেই উচ্চাভিলাষী ঘোড়াশালের গুরু ম্যাক্রিনাস সেনেটর থ্রায়েক্সকে ঘুষ দিয়ে এই ক্যু পরিকল্পনা সম্পর্কে জেনে নেয়। এরপর সে দুই সম্রাটকে লুসিলা ও আকিসিয়াসকে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ গ্রেফতার করার পরামর্শ দেয়।
দুই সম্রাট তখন ম্যাক্রিনাসের হাতের পুতুলে পরিণত হয়। গ্ল্যাডিয়েটরে লুসিয়াসকে নির্দেশ দেয়, আকিসিয়াসকে হত্যা করার জন্য। লুসিয়াস লড়াই করে কিন্তু হত্যা করতে অস্বীকৃতি জানালে শাসকের অ্যালিটফোর্স প্রায়েটোরিয়ান গার্ডকে দিয়ে আকিসিয়াসকে হত্যা করা হয়।
ম্যাক্রিনাস গিয়ে লুসিয়াসকে জিজ্ঞেস করে, কেন সে আকিসিয়াসকে হত্যা করেনি। লুসিয়াস বলে, রোম এই স্বৈরাচারী অপশাসন মুক্ত হলে শ্রেয়তর হবে। ম্যাক্রিনাস দ্বিমত জানিয়ে লুসিলার কারাপ্রকোষ্ঠে যায়। তাকে জানায় কীভাবে সম্রাট মারকুস আর্কিলিয়াস তাকে যুদ্ধবন্দী দাস হিসেবে রোমে ধরে এনেছিলেন। এর প্রতিশোধ নিতে সে সেভেরান রাজবংশের পতন ঘটিয়ে রোমান সম্রাট হবে।
ম্যাক্রিনাস দুই সম্রাটের সম্পর্কে ফাটল তৈরি করে। প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে অপেক্ষাকৃত বোকা সম্রাট কারসালাকে দিয়ে তার ভাই সম্রাট গেটাকে হত্যা করায়। কারসালা তার পোষা বানরকে সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা নিয়োগ করলে; ম্যাক্রিনাস সেনেটরদের সম্মান অনুভূতি উস্কে দেয় সম্রাটের বিরুদ্ধে। কারসালাকে দিয়ে কলোসিয়ামে লুসিয়াকে হত্যা পরিকল্পনা করে। সেখানে তাকে বাঁচাতে টোপ হিসেবে রাখা হয় লুসিয়াসকে। মাকে বাঁচাতে গিয়ে ছেলে নিহত হলে; কারসালার পতন ঘটিয়ে ম্যাক্রিনাস সম্রাট হয়ে ওঠবে।
লুসিয়াস তার সহযোদ্ধা গ্ল্যাডিয়েটর নিয়ে বিদ্রোহ করে কলোসিয়ামে যুদ্ধ করে। এসময় গ্যালারি থেকে তীর ছুড়ে লুসিয়াকে হত্যা করে ম্যাক্রিনাস। লুসিয়াস আগেই তার বন্ধু চিকিৎসক রাভিকে মায়ের কাছ থেকে পাওয়া দাদা মারকুস আরলিয়াসের আংটি দিয়ে রোমের বাইরে অপেক্ষমান সেনাদলের কাছে পাঠায়। এই আংটি পর্যায়ক্রমে ম্যাক্সিমাস ও আকিসিয়াস পেয়েছিল বীরত্বের পুরস্কার হিসেবে। সেনাদল এই আংটি দেখে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসতে থাকে রোমের দিকে।
আকিসিয়াস ও ম্যাক্রিনাস সেনাদল তখন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। ম্যাক্রিনাস লুসিয়া ও সম্রাট কারসালাকে হত্যা করে ঘোড়ায় চড়ে সেখানে আসে। তাকে ধাওয়া করে সেখানে পৌঁছায় লুসিয়াস। সেখানে দ্বন্দ্বযুদ্ধে ম্যাক্রিনাসের মৃত্যু হলে উভয় সেনাদলের সামনে নিজের পরিচয় তুলে ধরে লুসিয়াস। সে একটি বৈষম্যমুক্ত ঐক্যবদ্ধ রোমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করে। লুসিয়াস কলোসিয়ামে গিয়ে দুমুঠো মাটি হাতে নিয়ে বাবা-মার মৃত্যুশোক প্রকাশ করে।
এই চলচ্চিত্রে রোমের জনগণ সবসময়ই ন্যায়ের পক্ষে ছিল। তারা আকিসিয়াস ও লুসিলার মৃত্যুতে বিক্ষোভ করে। তারা যখনই প্রয়োজন হয়েছে তখন প্রতিবাদ জানিয়েছে। তাদের এই বিক্ষোভ দৃশ্যগুলো জুলাই-অগাস্ট বিপ্লবের গণঅভ্যুত্থানের দৃশ্যগুলোর কথাই মনে করিয়ে দেয়। তার মানে জনগণ সবসময় ইতিহাসের সঠিক প্রান্তে থাকে; তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণে কখনোই ভুল করে না।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন