লেখা: কবি বদরুল চৌধুরী
সন্ধ্যার পর মোহাম্মদপুর গেলাম। নূরজাহান রোডে যাবার পর একটা কমবয়সী ছেলে পাশাপাশি হাঁটা শুরু করল। কাঁধে হাত দিয়ে বলল, আজকে গরমটা একটু বেশি, না ভাই?
আমি আগ বাড়াইয়াই বললাম, ভাই সাইডে যাব নাকি হাঁটতে হাঁটতেই কাজ সেরে ফেলবেন?
ছেলেটা বলল, আপনি দেখি বুদ্ধিমান লোক। ক্লায়েন্টরা বুদ্ধিমান হলে জবে আরাম আছে। যাই হোক, সাইডেই আসেন। সাইডে নিয়ে যাওয়া আমাদের মোহাম্মদপুরের ঐতিহ্য।
আমি রাস্তার সাইডে গেলাম। সে তার পকেটে হাত দিল। আমি বললাম, ভাই বুঝতে পারছি ছুরি দেখাবেন। আপনার প্রতি বিশ্বাস আছে। দেখানোর দরকার নাই। এমনিই দিয়ে দিচ্ছি।
ছেলেটা বলল, বাহ ভাই! আপনি তো মহান মানুষ। যাই হোক, ছুরি দেখানোও আমাদের ঐতিহ্য। ঐতিহ্যকে সম্মান করা উচিত।
সে ছুরি বের করে আমার পেটে ধরল। আমি ততক্ষণে মানিব্যাগ বের করে ফেলেছি। তাও সে দাঁত খিঁচিয়ে বলল, খা*কির পোলা যা আছে সব বাইর কর।
আমি অবাক হয়ে বললাম, আমি তো বের করেই রেখেছি। হুদাই গালি দিচ্ছেন কেন?
ছেলেটা আমার হাত ধরে বলল, ভাই এইটাও ঐতিহ্য। ছিনতাই আমাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর গালি দেওয়াটা এক ধরনের শপথ বলতে পারেন। স্যরি কিছু মনে কইরেন না ভাই। এখন জিনিস তাড়াতাড়ি দিয়ে দেন। আপনার ফাইলের কাজ শেষ হলে আমরা চা খাব। আপনাকে ক্লায়েন্ট হিসেবে আমার অনেক পছন্দ হইছে।
নাভির উপরে ছুরির খোঁচা খেয়ে নির্ভার থাকা কঠিন। আমি দ্রুত মানিব্যাগ ও ফোন তার হাতে দিয়ে দিলাম। সে কেবল হাতে নিয়েছে এমন সময় দেখি একজন পেছন থেকে তার কলার ধরল। কলার টেনে ফিরিয়েই দিল এক থাপ্পড়।
থাপ্পড় দেয়া লোকটা মধ্যবয়সী। উনি চিৎকার করে বললেন, শু*রের বাচ্চা, তুই আবার এই কাজ করতেছিস? কতদিন বলছি এসব ভুল করবি না। বাপের কথা শুনতে ভালো লাগে না? তোকে আমি থানায় দেব।
ছেলেটা তখন অনুনয় বিনয় করে বলছে, আর ভুল হবে না আব্বা। আমি আর কোনোদিন এসব করব না। আজকের মতো মাফ করে দাও।
আরো কয়েকটা থাপ্পড় ও দুইটা লাত্থি মেরে ছেলেটাকে দৌড়ে পালিয়ে গেল। এসব ঝামেলার ফাঁকে ছেলের হাত থেকে মানিব্যাগ ও ফোন পড়ে গিয়েছিল। আমি সেগুলো তুলে হাতে নিয়ে নিলাম। ভদ্রলোকের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন ভরে গেল আমার। এমন বাবা এখনও আছে? একদম হাতেনাতে বিচার আমি এই প্রথম দেখলাম।
আমি বললাম, আংকেল আপনি অনেক ভালো মানুষ। আপনি এখন যা করলেন এটা খুব কম মানুষই করে।
ভদ্রলোক বললেন, আরে ওর বিচার তো শেষ হয়নি এখনও। বাসায় ফেরার পর খবর আছে ওর। এবার না শোধরালে থানায় দেব। আমার একটা নীতি আছে। নীতি মানলে আমার ঘরে থাকবে নইলে সোজা থানা।
আমি আরেকবার অভিভূত হলাম। পায়ে ধরে সালাম করতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু মহান মানুষটা তাতে বিব্রত হয় কিনা ভেবে করা হলো না। আমি বিনয়ের সাথে বললাম, আপনার কথা আমার আজীবন মনে থাকবে আংকেল। থ্যাংক ইউ। এখন যাই। জরুরি কাজ আছে।
আমি ফোন ও মানিব্যাগ পকেটে ঢুকাব, উনি আমার হাত ধরলেন। তারপর বললেন, ফোন মানিব্যাগ নিয়ে কই যাও বাবা? এইগুলা দিয়ে দাও।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, কী বলছেন আংকেল? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। একটু আগে বিচার... মানে...
আংকেল হাসতে হাসতে বললেন, আসলে এখন যাকে দেখলেন সে আমার ছোটো ছেলে। আমার ছেলে মোট তিনজন। ছিনতাইয়ের জন্য তাদের এলাকা ভাগ করা আছে। নূরজাহান রোড আমার বড় ছেলের আন্ডারে। ছোটটার শের শাহ রোড। ছোটোছেলেটা বেশি লোভ করে এখানে চলে এসেছিল। আমি বেঁচে থাকতে এক ভাইয়ের ব্যবসায় আরেকজন হাত ঢুকাবে এটা তো হয় না। সন্তানদের মধ্যে ইনসাফ না করা পাপ। যখন তুমিও বাবা হবা, ছেলে মেয়েদের প্রতি এই ইনসাফ করিও বাবা।
আমি মুখ হা করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
আংকেল বললেন, তোমার জিনিসগুলা উদ্ধার করে বড়টাকে দিয়ে দেব। বাবা হিসেবে এটা আমার দায়িত্ব। ছোটো ছেলেটা তোমাকে একবার ছুরি দেখাইছে। আমারও কি আবার দেখাইতে হবে বাবা? প্লিজ বাবা কোনো ঝামেলা করিও না... খা*কির পোলা বাবা শুনতেছ?
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন