আজ মাসুদের কথা খুব মনে পড়ছে। ছিপছিপে গড়নের ছেলেটি যেমন গান গাইত, তেমনি ছবি আঁকত, তেমনি অভিনয় করত। আমার গ্রুপে যোগ দেবার পর, প্রথম দিকে ছেলেটাকে ভালোই লাগত। কিন্তু যখনই সে আমার থিয়েটার ডিরেকশনের ভুল-ভ্রান্তি নিয়ে কথা বলা শুরু করল; তাকে বিদ্রোহী কর্মী হিসেবে ধীরে ধীরে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিতে শুরু করলাম। ছোটোখাটো ভাড়ের রোল দিয়ে তাকে শায়েস্তা করলাম।
মাসুদ তখন অন্যদল করল; থিয়েটার জগত থেকে ছিটকে পড়ল। ম্রিয়মাণ হয়ে গেল। আমি তখন বিখ্যাত থিয়েটার নির্দেশক, টিভিতে অভিনয় করি। খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে আমিও কি তবে ছোটোখাটো হাসিনাতে পরিণত হয়েছিলাম। আমাদের প্রত্যেকের মাঝে কি তবে একজন স্বৈরাচারি মানুষ বসবাস করে!
নব্বই-এর গণঅভ্যুত্থানে এরশাদ পতন হলে টিএসটিতে ঢোল বাজিয়ে নেচেছিলাম। রামপুরা টিভি ভবনে ঢুকে শিল্পীদের কালো তালিকা করেছিলাম। আমি কি তখন বেছে বেছে ভালো ভালো শিল্পীদের বাদ দিয়েছিলাম। কারণ ওরা তো এরশাদের কাছ থেকে কোনো পদ-পদবী-প্লট-পদক নেয়নি; ওরা তো কেবল এরশাদ আমলে অভিনয় চালিয়ে গিয়েছিল টিভিতে; ঐটুকু অপরাধের জন্য তাদের টিভিভবন থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিলাম। এত দম্ভ কেন এসেছিল আমার মাঝে!
অথচ আমি তো পাক্কা মার্ক্সিস্ট ছিলাম। থিয়েটারের মাঝ দিয়ে সমাজ পরিবর্তনের গল্প বলতাম। মগবাজারের ছোট্টো ঘরটাতে সোনালী যুগের কবিদের নিয়ে ভালোবাসার যৌথ খামারের স্বপ্ন দেখতাম। সেই আমি কী করে ঘৃণার খামারের হিংস্র নেকড়ে হয়ে উঠলাম!
তিল তিল করে থিয়েটার গ্রুপ গড়ে তোলার সময় আমরা প্রতিটি সদস্যের অভিমতকে গুরুত্ব দিতাম। অথচ বেইলি রোডে কয়েকটা প্রোডাকশন হিট হয়ে যাবার পরেই আমি সেই শীর্ণ তরুণ মাসুদের টুটি চেপে ধরলাম। কবে কবে এত বদলে গেলাম আমি!
যে আমি প্রান্তিক মানুষের দুঃখ গাথা নিয়ে নাটক লিখতাম; সেই আমি ইউটিউবে প্রান্তিক মানুষের অভিনয় প্রচেষ্টা দেখে ভীষণ বিরক্ত হয়ে রুচির পুরোহিত হয়ে উঠলাম। আমি কি তবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদার বাবুদের মতো প্রবল অহংকারী হয়ে উঠেছিলাম; যারা নিম্নবর্গের মানুষকে নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করত। অথচ আমি নিম্নবর্গের মানুষের ভাগ্যপরিবর্তনের রাজনীতি করেছি; তাদের অধিকারের কথা নাটকে তুলে ধরেছি।
কোনটা আমি, সমাজতন্ত্রী নাকি জমিদারতন্ত্রী! আমার কি দরকার ছিল হাসিনার জমিদারতন্ত্রে পদ ও পদক নেবার! আমি কি কম মানুষের ভালোবাসা পেয়েছিলাম। কোনো ছোট শহরে কোনো থিয়েটার আসরে অতিথি হয়ে গেলে; মানুষ কত ভালোবাসার ফুল নিয়ে আসত; অটোগ্রাফ নিত তরুণ-তরুণীরা। আশীর্বাদ নিত থিয়েটার অভিনেতা হবার জন্য। সেই ভালোবাসার সাম্রাজ্য কি কোনো সরকারি পদে আছে।
ভেতরে ভেতরে কতটা স্বৈরাচারি হয়ে উঠলে আশৈশব অরণ্যপ্রেমী এই আমি, অরণ্যবিনাশী প্রকল্প নিয়ে প্রতিবাদ সভার বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলাম।
দেয়ালে গ্রুপের নাটকের প্রথম দিককার ছবিতে মাসুদকে দেখে চমকে উঠি। মাসুদ এই চালাক চতুরের শহরে মিস ফিট ছিল। যে শহরে গীতিকার গায়ক পাখিদের ভিক্ষুক পাগল আর উন্মাদ বানানো হয়। আমি কি তবে মাসুদের মতো তিলে তিলে ক্ষয়ে যাওয়া নিভে যাওয়াকে ভয় পেয়ে সাফল্যের ইঁদুর দৌড়ে যোগ দিয়েছিলাম!
ভেতরে ভেতরে অসংখ্যবার দ্রোহী হয়ে উঠেছি আমি হাসিনার ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে; কিন্তু শিল্পজগতে প্রাসঙ্গিক থাকতে প্রতিবাদী হইনি। আমি তবে দেখতে পাচ্ছিলাম না যে, আওয়ামীলীগ মুসলিম লীগের মতোই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে। ১৯৪৭-এর স্বদেশী যোদ্ধা ১৯৭১ সালে যেভাবে দেশের মানুষের বিপক্ষে চলে গেল; ১৯৭১-এর যোদ্ধা কি সেই একইভাবে ২০২৪-এ দেশের মানুষের বিপক্ষে চলে গেল!
১৯৭১ সালে, ১৯৯০ সালে ইতিহাসের রাইট সাইডে ছিলাম; ২০২৪-এ ইতিহাসের রঙ সাইডের রঙ কেন মেখে গেল আমার মুখমণ্ডলে।
আয়নার সামনে গিয়ে বার বার মুখ ধুলেও কেন সেই নায়কের মুখ খুঁজে পাই না আর; কেন নিজেকে খলনায়ক মনে হয় বারবার।
আজ তরুণদের মুখে ভাসানির পালনবাদের গল্প শুনতে হয়; অথচ পালনবাদের কথা আমি ভাসানির নিজ মুখ থেকে শুনেছি। আমি আর কতটুকুই বা ক্ষয়ে গেছি; ১৯৭১ সালে যারা দেশপ্রেমের কথা বলেছিল; ১৯৯০ সালে যারা গণতন্ত্রের কথা বলেছিল; আমি তাদের দেশ বিক্রি করতে দেখেছি, গণতন্ত্র হত্যা করতে দেখেছি। তাই বিপ্লবীর ভাষণ শুনলে অজানা আশংকায় বুক কেঁপে ওঠে।
ব্যালকনিতে পায়চারি করি, আর যদি কোনোদিন থিয়েটার মঞ্চে ওঠা না হয়; তবু আমি এই ছায়াডাকা-পাখিডাকা ব্যালকনিতে মঞ্চের মতো হেঁটে হেঁটে সংলাপ বলব। নিসর্গ আমার দর্শক হবে। আমি আমার পদকগুলোকে ধানমণ্ডি লেকে ফেলে দিয়ে নির্ভার। কথাকলির আসর আমার আর ভালোও লাগে না। শুধু একটা কথা মনে রেখ, আমি একদল শিল্পীকে কালো তালিকা করে বাদ দিয়েছিলাম, তোমরা আমাকে কালো তালিকা করে বাদ দিলে, একদিন পরের প্রজন্ম তোমাদের কালো তালিকায় ফেলবে। এমনি হরণ-পূরণের খেলায় শিল্পকলার বাতিগুলো নিভে যাবে। প্রতিভাকে গুরুত্ব না দিয়ে পিঠ চুলকানির আসর করে এমনিও শিল্প-সাহিত্য অস্তাচলের পথে। শিল্পকলার পোড়োবাড়ি রিক্ত মাঠ থেকে মুক্তি পেয়ে বরং ভালোই লাগছে।
আজ আবুল হাসানের কথা বড্ড মনে পড়ছে, ও আমার মগবাজারের ঘরে আসত, সিগরেট প্যাকেটের উল্টোদিকে কবিতা লিখত। কি করে সে বুঝে গিয়েছিল এটা উদিত দুঃখের দেশ। ত্রিকালদর্শীর মতো করে বলেছিল, ফুল ফুটবে না, ফুল আর কখনোই ফুটবে না!
আমি ঠিকই মধুপুর গড়ে লালমাটির পথে হেঁটে, সবুজ গজারি বনের মাঝে রাজবংশীদের বাঁশীর সুর শুনে ঠিকই খুঁজে নেব আমার শেকড়। হয়তো কোনো সাঁওতাল গ্রামে শিশুদের থিয়েটার শেখাব; ওদের কাছ থেকে শিখব। খুঁজে বের করব সভ্যতার স্রোত টেমস থেকে যমুনার দিকে; নাকি যমুনা থেকে টেমসের দিকে।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন