চলচ্চিত্রের বাবা-মাকে ভালো লাগে

৮৯ পঠিত ... ১৬:৪৬, ডিসেম্বর ০১, ২০২৪

10

বিতর্ক চর্চা থেকে এটুকু জানি; পৃথিবীর যে কোনো ন্যারেটিভের বিপরীতে বিতর্ক করা সম্ভব। যে কোনো প্রোপাগান্ডাকে বিতর্ক দিয়ে পরাস্ত করা যায়। যে কোনো অশালীন খিস্তিকে স্যাটায়ার দিয়ে পরাজিত করা সম্ভব।

জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা ফ্যাসিজমের সঙ্গে বিতর্ক করেছে; একে নিয়ে স্যাটায়ার করেছে; মিম ও গ্রাফিতিতে। যে মেথড সফল হয়েছে সেটাকেই ধরে রাখা বুদ্ধিমানের কাজ।

ভারতের মিডিয়ায় ১৫ জুলাই সাবেক রাষ্ট্রদূত বীণা সিক্রি প্রথম, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে মৌলবাদিদের আন্দোলন বলে ডিফেম করেন। সেই মিথ্যা ও অশালীন ন্যারেটিভটাই তারা চালু রেখেছে। এর বিপরীতে বাংলাদেশের মিডিয়া বিতর্ক করেছে। এ নিয়ে স্যাটায়ারও চালু রয়েছে।

কিন্তু ভারতের মিডিয়ার প্রোপাগান্ডা ও সোশ্যাল মিডিয়ায় অশালীন মন্তব্য বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য এতই অমর্যাদাকর যে ঢাকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ভারতীয় পতাকাকে ডোর ম্যাট হিসেবে ব্যবহার করে। ভারতীয় মিডিয়ায় বাংলাদেশকে উত্তর-পূর্বের ভারতীয় সাতটি রাজ্য শাসনের ডোরম্যাট হিসেবে ব্যবহারের কথা অসংখ্যবার আলোচিত হয়েছে। সে কারণেই বাংলাদেশের তরুণ ভেবেছে, আমাদের রাষ্ট্রকেই যারা ডোরম্যাট বানিয়েছিল; সেখানে তাদের পতাকা ডোরম্যাট হিসেবে ব্যবহার করলে ক্ষতি কী!

এইখানেই ভুল চিন্তা করেছিল তরুণেরা। স্বাধীনতার ৭৮ বছর পরেও কল্যাণরাষ্ট্র হতে পারেনি ভারত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি অল্প সময়ে কল্যাণরাষ্ট্র হয়ে উঠেছে। ফলে সেখানে জাতীয়তাবাদ, জাতীয় পতাকা নিয়ে অনুভূতি প্রদর্শনের প্রয়োজন পড়ে না। এই প্রয়োজনটি ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তান সবগুলো বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রেরই রয়েছে। এই দেশগুলোতে যেহেতু নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকার পূরণের নিশ্চয়তা নেই; তাই আছে ভীষণ দেশপ্রেম ও ধর্মপ্রেম প্রদর্শন। গরিব মানুষের মান অপমান বোধ ও সেন্টিমেন্ট অত্যন্ত প্রখর হয়। তাই এই দেশগুলোর গরিব ও দরিদ্র মনের নাগরিকদের দেশপ্রেম ও ধর্মপ্রেম অনুভূতি খুব টনটনে। এসব জায়গায় আর যাই করুন; জাতীয়তাবাদ-জাতীয় পতাকার মতো আলংকারিক বিষয়গুলো আর জাতীয় দিবস পালনের রিচুয়াল মেনে চলতে হবে। নাগরিকের মর্যাদা না থাকলে কী হবে দেশকে পুজো করা ও সেজদা করার কাজগুলো করতে হবে নিয়মিত।

জেনজিদের বুঝতে হবে, তারা একটি ব্যর্থ অচল পুরোনো চিন্তার অচলায়তনে জন্ম নিয়েছে। চারপাশে ভাত দেবার মুরোদ নেই কিল দেবার গোঁসাই দেশানুভূতির মোল্লা-পুরোহিত আর ধর্মানুভূতির মোল্লা-পুরোহিত। সুতরাং আর যাই হোক এদের এই দুটি অনুভূতিতে কোনো আঘাত দেওয়া যাবে। এই অনুভূতির দোকানে নানারকম রিচুয়ালের পসরা সাজিয়ে এরা করে কম্মে খায়। অযোগ্য অদক্ষ লোককে নেহাত বয়সে বড় বলে যেখানে সমীহ করে চলতে হয়; একই কারণে তাদের এইসব দেশানুভূতি ও ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেওয়া যাবে না।

ওদের নিয়ম হচ্ছে শতমুখে আপনাকে অপমান করবে; মৌলবাদি ও হিজবুত তাহরির বলবে; কিন্তু উনাকে আপনি কিছু বলতে পারবেন না। বললেই তাদের স্থানীয় মুখপাত্ররা শতমুখে আপনার সমালোচনা করবে।

লক্ষ্য করে দেখুন, ভারতীয় মিডিয়ায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে হিজবুত বলা মাত্র, স্থানীয় মুখপাত্ররা তোতা পাখির মতো হিজবুত বলতে থাকে। শেখ হাসিনা এই আন্দোলনের তরুণদের রাজাকারের নাতিপুতি বলা মাত্র যেমন এরা শতমুখে রাজাকার বলতে শুরু করেছিল। ৫ অগাস্টের পর কিছু সংখ্যক আওয়ামীলীগের নেতা কর্মী বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে নিঃগৃহীত হলে; তাদের মাঝ থেকে হিন্দু নেতা-কর্মীদের নিঃগৃহীত হবার কেসস্টাডি তুলে নিয়ে ভারতীয় মিডিয়া ‘সংখ্যালঘু নির্যাতন’-এর অভিযোগ তুললে; স্থানীয় মুখপাত্ররাও সেটা সাবস্ট্যানশিয়েট করতে লেগে পড়ে। নেহাত সাধারণ হিন্দু-মুসলমান ওদের উস্কানিতে পা না দেওয়ায় বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সংঘাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।

বিজেপি সমর্থিত হিন্দুত্ববাদী নেতা চিন্ময়, বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার ওপর, জয় শ্রীরাম লেখা গেরুয়া পতাকা ওড়ালে; ভারতের মিডিয়া বলে, এটা কাউকে গ্রেফতার করার মতো ব্যাপার নয়। অথচ কয়েকজন তরুণ ভারতের পতাকাকে ডোরম্যাট বানালে; ভারতের বিজেপি কর্মীরা বাংলাদেশের পতাকা পোড়ায়। আর স্থানীয় মুখপাত্ররা শতমুখে ভারতের পতাকার মর্যাদা নিয়ে বেচায়েন হয়ে ওঠে।

আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে স্থানীয় মুখপাত্ররা অত্যন্ত শালীন মানুষ; তাই বাংলাদেশের ঐ তরুণদের সমালোচনা করছে। ১৫ জুলাই থেকে এরা বাংলাদেশের তারুণ্যের হত্যা দেখে নিশ্চুপ থেকেছে; অথবা উস্কানি দিয়েছে, ৫ আগস্টের পর প্রতিদিন বুড়ো ভামেরা ব্যস্ত থেকেছে বাংলাদেশের বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ভুল ধরতে; আর সেন্স হিউমার না থাকলে যেরকম রস হয়, সেরকম তির্যক মন্তব্য করে চলেছে।

শেখ হাসিনা ও তার দলীয় অনুসারীরা নাহয় রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকার প্রয়োজনে ভারতের স্থানীয় মুখপাত্র হয়ে উঠেছেন; কথিত সংস্কৃতি মামা-খালারা কেন ভারতের স্থানীয় মুখপাত্র হলেন!

এর জেনেসিস খুঁজতে গেলে যা পাওয়া যায়; তা হচ্ছে ভারতে মৌলবাদী বিজেপি ক্ষমতায় থাকলেও তা প্রগতিশীল বলে বিশ্বাস করে এই সংস্কৃতি মামা ও খালারা। বিশ্ব সংস্কৃতি সম্পর্কে এদের ধারণা অত্যন্ত কম। বাংলা ছাড়া এরা আর কোনো ভাষা তেমন বোঝে না। ফলে হলিউড তো দূরে থাক, বলিউডের মুভি দেখা হয় না তাদের। আর এরা নিজের সাদাসিধে বাবা-মা নিয়ে ভীষণ কুঞ্চিত। কলকাতার চলচ্চিত্রের বাবা ও মায়ের চরিত্রকে খুব ভালো লেগে যায়। সে কারণে নিজের বাবা-মাকে ফিল্মি কস্টিউমে সাজিয়ে ফেসবুকে ফ্যামিলি ফটো দেয়। আধুনিক নারীর সংজ্ঞা এদের কাছে অপর্ণা সেন। আর আধুনিক পুরুষের সংজ্ঞা অঞ্জন দত্ত। আর আধুনিক ফিল্ম মেকার মানে সৃজিত। মোটামুটি উনাদের কপি করে আমাদের সংস্কৃতি মামা-খালারা আধুনিক হয়ে উঠেছেন। অনেকে দেখবেন ঠেস ও ধাক্কা দিয়ে দিয়ে বাংলা বলেন। এ পর্যন্ত থাকলেও চলত, কিন্তু ২০১৪ সাল থেকে ঢাকা ছায়া উপনিবেশ হলে সংস্কৃতি মামা-খালাদের পোশাক ও জীবন চর্যা বিজেপির লোকেদের মতো হয়ে যায়। হাতে একটি রাখি বেঁধে ফেলে। এটা বিজেপির ফ্যাশন।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি অনেক সংস্কৃতি মামা-খালার বাবা-মা একটু বেশি ধর্মপ্রাণ। তাই সংস্কৃতি মামা-খালা লর্ড কর্নওয়ালিশের জমিদার সাজার পূর্বশর্ত হিসেবে দাড়ি টুপি নিয়ে হাসাহাসি করে থাকে। অনুসন্ধান করলে দেখবেন, এসব সংস্কৃতি মামা-খালার পূর্ব পুরুষের বৃটিশ বিরোধী ও পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনে রক্ত-ত্যাগ নেই। তাই এরা তোতাপাখির মতো যাকে তাকে ‘রাজাকার’ ডেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সনদ বিলি করে বেড়ায়।

এখন ভারত মানেই তো বিজেপি নয়, প্রোপাগান্ডা টিভির অর্ণব গোস্বামী-ময়ূখরঞ্জন নয়। ভারত মানে কবীর সুমন ও অর্ক ভাদুড়ীও। কবীর সুমনের জীবনের সেরা দুই বন্ধু ঢাকার। আবদুল্লাহ আল ফারুক ও সাজাহান ফারুক। কলকাতা ও ঢাকার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য নিয়ে তারা বন্ধু হয়েছিলেন ডয়চে ভেলেতে কাজ করার সময়। ফলে ট্র্যাডিশন ও ইনডিভিজুয়াল ট্যালেন্ট নিয়ে একে অপরের শহরের সংস্কৃতিকে পছন্দ করেন। পরের প্রজন্মে সেই ডয়চে ভেলেতে কাজ করতে গিয়ে আমার বন্ধুত্ব হয় দিল্লির মৃদুলা সিং ও সুনন্দা রাওয়ের সঙ্গে। ঢাকা ও দিল্লির সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য নিয়ে আমরা দীর্ঘসময় কাটিয়েছি। পরস্পরের সংস্কৃতিকে অ্যাপ্রিশিয়েট করেছি।

সংস্কৃতি হচ্ছে বিনিময়ের বিষয়। কালচারাল কলোনিয়ালিজমের যুগ সেই কবেই শেষ হয়েছে। আধুনিকতাকে যারা মননে ধারণ করতে পারেনি; তারা সাংস্কৃতিক দাদা বা দিদি হতে চেষ্টা করে। ফলে সাংস্কৃতিক বন্ধুত্বের সৌন্দর্য তারা উপলব্ধি করতে পারে না।  

৮৯ পঠিত ... ১৬:৪৬, ডিসেম্বর ০১, ২০২৪

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top