বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সমাজ মনস্তত্বের প্রথম ক্ষতিটি করে এর সিপি গ্যাং। সোশ্যাল মিডিয়ায় এরা চ-বর্গীয় গালাগাল করে সমাজের পরিবেশ দূষিত করে। সিপি গ্যাং-এর কার্যকলাপের ডমিনো এফেক্টই ইতিহাসের নিকৃষ্ট ফ্যাসিজম জন্ম দেয়। এই সিপি গ্যাং-এর আদলে গড়ে উঠতে থাকে নতুন ধরনের এক আওয়ামী লীগ। দলটির যে সংস্কৃতিপ্রবণ লোকেরা সারাজীবন সুরুচি চর্চা করেছেন, তারা সিপি গ্যাং-এর চ-বর্গীয় গালিতে ভিন্নমতের মানুষের অপমানের দৃশ্য উপভোগ করতে শুরু করেন। কালচারাল হারিকিরি করেন।
আওয়ামী লীগের প্রচলিত কর্মীরা, যারা মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, উন্নয়ন সম্পর্কে সুন্দর ভাষায় সোশাল মিডিয়া পোস্ট দিতেন; তাতে সামান্য কটি লাইক পড়ে। অথচ হাইব্রিড সিপি গ্যাং-এর কলতলার সংলাপ ভিত্তিক ফেসবুক পোস্টে লাইকের বন্যা বয়ে যায়। ফলে কৈশোরে যারা কলতলার নায়ক ছিলো, তারা ফেসবুকের নায়ক হয়ে ওঠে। সুরুচি সম্পন্ন আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীরা তখন ঐ চলিষ্ণুগালিকল্পদ্রুমদের জন্মদিনে উইশ করতে শুরু করে। পুলিশ-প্রশাসনের লোকেরাও এদের সঙ্গে সখ্য রেখে চলতে শুরু করে। সিপি গ্যাং তখন ভিন্নমত পোষণকারী নির্দলীয় ব্যক্তি, প্রতিপক্ষ বিএনপি, জামায়াত ও বিভিন্ন দলের প্রতিবাদী মানুষের তালিকা তৈরি করে পুলিশের হাতে তুলে দিতে শুরু করে। শুরু হয় ৫৭ ধারা ও ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্টে নির্যাতন। আওয়ামী লীগের মন্ত্রীসভার দু'একজন সদস্যকে আমি বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম, ফেসবুকে একটি ভিন্নমত প্রকাশ সরকারের যতটা ক্ষতি করে; তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হয় তাকে ক্রসফায়ারে দিলে অথবা কারাগারে প্রেরণ করলে। কিন্তু সিপি গ্যাং তখন কেউ গ্রেফতার হলেই "ঐ ব্যাডারে ডিম দেও", "অরে নিয়া অস্ত্র উদ্ধারে যাও" টাইপের হিংস্র শ্লোগান এতো জনপ্রিয় করে তুলেছে যে তাতে আওয়ামী লীগের বন্দনা ভেসে যায় জলে। ওটাই হয়ে দাঁড়ায় আওয়ামী সংস্কৃতি। সিপি গ্যাং-কে তাই আওয়ামী লীগের হামারশিয়া বা হুব্রিস বললেও ভুল হবে না।
আওয়ামী লীগের এই চিন্তা ও ভাষা-সংস্কৃতিদূষণ শুধু দলটির মাঝে সীমাবদ্ধ থাকেনি। আমাদের সমাজে কলতলার খিস্তি, ধরে ধরে ব্যক্তিকে অপমান করা আর তা দেখার নেশা ছড়িয়ে পড়েছে জনমানসে। খুব আজগুবি একটা ব্যাপার তৈরি হয়। যা মুখে আসে তা বলাটাই ফ্যাশানে পরিণত হয়।
আমি সবসময়ই সাম্যবাদী চিন্তার মানুষ। কাস্ট সিস্টেম নির্ভর নিষ্ঠুর সমাজ যাদের দলিত বলে সুইপারের জীবনে ঠেলে দিয়েছে; মর্যাদাহীন-অধিকারবঞ্চিত সেই সমাজের মানুষ নেশা করে উন্মত্ত হয়ে সুবিধাবাদী শোষক সমাজকে গালি দিলে; আমার কাছে তা কবিতার মতো শোনায়।
কিন্তু সুবিধাবাদী সমাজে বসবাস করে, শার্ট-প্যান্ট-কোট পরে চর্বি দুলিয়ে কেউ নেশা করে সুইপার কলোনির খিস্তি করলে; সেই লোকটাকে আমি অপরাধী বলে চিহ্নিত করি। তার সংশোধনের প্রয়োজন আছে বলে মনে করি।
৫ অগাস্ট ছাত্রজনতার গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে নতুন সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বপ্ন যাত্রা শুরু করেছে; সেখানে সিপি গ্যাং-এর আদলে চ-বর্গীয় খিস্তি বেমানান। সেখানে অপমান দেখার নেশা অসুস্থতা। সেরকম প্রবণতা ইউটিউব কিংবা ফেসবুক কোথাও দেখতে চাইনা। সেই সিপি গ্যাং-এর সময় থেকে তদের অজস্র গালাগালের বিপরীতে অজস্র স্যাটায়ার লিখেছি। তাদের কলতলার সুইপার পল্লীর খিস্তির বিপরীতে নিজস্ব ভাষারীতিতে গল্প লিখেছি। সিপি গ্যাং-এর সেসব গালি হারিয়ে গেছে বিস্মৃতির অতলে। কিন্তু আমার রম্য গল্পগুলো ঠিকই টিকে আছে। আবার নতুন কোন খিস্তি গ্যাং তৈরি হলে; তাদের জন্য এই গল্পগুলো প্রাসঙ্গিক হবে। তাই মনে রাখতে হবে, খিস্তিক্ষেত্রের যুদ্ধের চেয়ে রসক্ষেত্রের যুদ্ধ অনেক বেশি শক্তিশালী।
জুলাই-অগাস্ট বিপ্লব হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আকাংক্ষার আত্মপ্রকাশ। ফলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারটি নির্বাচনের মাধ্যমে দেশ শাসনের দায়িত্ব পাওয়া কোন রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে তুলনীয় নয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ম্যান্ডেট জন অভ্যুত্থান। সুতরাং পতিত স্বৈরাচার ও এর দোসর ছাড়া বাকি সবার নিজস্ব সরকার এটি। এর ভুল-ত্রুটি সংশোধনের জন্য বলা ভাষার মধ্যে সিগনেচার থাকে; কে শুভাকাংক্ষী হিসেবে সমালোচনা করছে; কে শেখ হাসিনার ফ্যাসিজমের বিরহে পাগলপারা হয়ে উঠেছে।
ভাষা মানুষের মনের আয়না। ভাষাই বলে দেয়, কে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারটিকে সুশাসনের পথে পরিচালিত করতে চায়, কে এর পতন ঘটিয়ে মোদির ভারতের বি'টিম আমদানি করতে চায়।
কেউ যদি বাংলাদেশের প্রচলিত নিয়মে বিপ্লবের সুফল কুড়াতে না পেরে বিক্ষুব্ধও হয়; তবু সে চাইবে না; দেশটি আবার ভারতের ছায়া উপনিবেশে পরিণত হোক।
১৫ জুলাই থেকে ৫ অগাস্ট পর্যন্ত যা ঘটেছে; সব আমাদের চোখের সামনেই ঘটেছে। তাই হাতের কংকন কারো আর্শিতে দেখার প্রয়োজন পড়ছে না। বাঘ এসেছে বাঘ এসেছে বলে রাখাল বালকের আর্তনাদের বাস্তবতা আর নেই। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সদস্যদের বিরুদ্ধে "মুখে যা এলো তাই বলে ফেলার" অভিব্যক্তিতে সিপি গ্যাং-এর ছায়া দেখলে তো বরং আর যাই হোক দেশের শুভাকাংক্ষী বলে মনে হবে না সেই ছায়াকে।
আমার তো বরং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সদস্য, সেনাপ্রধান, বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল, জামায়াত নেতা ডা শফিকুর রহমানের ভাষা ও মনোভঙ্গি দেখে মনে হয়েছে; বাংলাদেশ অনেকদিন পর তার সুসংস্কৃতিতে প্রত্যাবর্তন করেছে। ড ইউনুসের বাক-সক্রিয়তায়, হাসিনার "প্রশ্ন নয় প্রশংসা করতে এসেছি"-র হাস্নাহেনার সুবাস নেই; টিভি টকশোগুলোতে সাড়ে চুয়াত্তর জার্নালের মতো পঞ্চায়েত বৈঠকের ভাটিয়ালি সুর নেই। গোয়েন্দাসংস্থার অতীন্দ্রিয় পিং পং বলের খেলা নেই। সোশাল মিডিয়ায় সরকারী কর্মকর্তার পোস্টে ভাওয়াইয়া ফ্যানফেয়ার নেই। একটি জাতির জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ও সংস্কৃতি। এই দুটো জায়গায় শক্তিশালী হয়ে উঠলে অন্য জায়গাগুলো আপনা আপনি একটি সুন্দর হয়ে ওঠে।
পৃথিবীর ইতিহাসে কোন দেশে বিপ্লব বা অভ্যুত্থানের পরে কোন ম্যাজিক সলিউশান আসেনি। কাজেই ড ইউনুসের কাছ থেকে ম্যাজিক সলিউশানের প্রত্যাশা সোনার পাথর বাটি। সাড়ে পনেরো বছরের নরভোজি রাষ্ট্রব্যবস্থাকে জনস্বার্থে পরিচালিত ব্যবস্থা করে তুলতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সময় তো দিতেই হবে।
রাষ্ট্রের কাছে নানারকম প্রত্যাশা থাকবে নতুন প্রজন্মের। তাদের শিক্ষা-কর্মসংস্থান ইত্যাদি নানা বিষয়ে তাদের আবেদনে সাড়া দিতে হবে সরকারকে। আজকের বাংলাদেশ তারুণ্য নির্ভর রাষ্ট্র। তারাই সভ্য দুনিয়ার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রত্যাশিত কল্যাণরাষ্ট্র গড়ে তুলবে বলে আশা রাখি।
আমরা যারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কৃষক-শ্রমিকের অর্থে শীর্ষ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার সুযোগ পেয়েছি; রাষ্ট্রের বিভিন্ন রকম স্বীকৃতি পেয়েছি; রাষ্ট্র আমাদের এমন যোগ্য করে তুলেছে যে অনায়াসে একটি সুন্দর জীবন পেয়েছি; তাদের তো প্রয়োজন নেই পকেটে সিভি নিয়ে উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের পাশে ঘুর ঘুর করার। বাংলাদেশের পাওয়ার করিডোরে সাড়ে ছয় বছর গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা লোকেদের চব্বিশ ঘন্টার টেনশনের জীবন দেখে; আমার মনে হয়েছে; যারা পাওয়ার করিডোরে যেতে চায়; তারা জানে না কি খুঁড়োর কল সেটা; কি এক চক্কর যেখানে ব্যক্তিগত জীবন বলে কিছুই থাকে না।
জীবন একটাই; একে উদযাপন করতে শেখাই বুদ্ধিমত্তা। এই যে পদ-পদবী-ক্ষমতা দেখানোর ঊনবিংশ শতকের স্বপ্ন; এ যে কতটা আউটডেটেড স্বপ্ন; তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।
আমরা দেশের নাগরিক হিসেবে শুধু চাই প্রতিটি নাগরিকের মর্যাদাপূর্ণ জীবন। সরকারি অফিসে গিয়ে অমর্যাদাপূর্ণ আচরণ পেতে চাইনা। আমি সভ্যতার সূচক মাপি; সরকারি দপ্তরে সেবার মান ও সরকারি কর্মচারির আচার আচরণ দিয়ে। আমি নিশ্চিত নতুন প্রজন্মের সরকারি কর্মচারিরা বিশ্বের সভ্য দেশগুলোর সরকারি কর্মচারিদের আধুনিক ও কার্টিয়াস আচরণ দেখে; আমাদের লোকায়ত সংস্কৃতির পদ-পদবীর অহমের অচলায়তন থেকে বেরিয়ে আসবেন।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন