গ্রেগর সামসা ঘুম থেকে উঠে দেখল সে হাসপাতালে। না, না। বইপ্রেমীরা ভয় পাবেন না। সে রোগী হয়ে ভর্তি নয়। সামসা সাহেব নিজেকে আবিষ্কার করল ডিউটি ডক্টরস রুমে। ধবধবে সাদা বিছানার চাদর আর পর্দা দেখে জায়গাটা চিনতে তার কোনো কষ্ট হলো না। বিস্মিত সামসা আয়নায় তাকিয়ে দেখল তার গায়ে অ্যাপ্রন, গলায় ঝুলানো লিটম্যান স্টেথোস্কোপ, মুখে চাপদাঁড়ি, চোখে রিমলেস চশমা। নিজেকে তখন তার ক্লিন স্লেট নিয়ে শুরু করা সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর মতো মনে হলো। ততক্ষণে রুমের সামনে রোগীদের ভীড় জমে গেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়েই গ্রেগর সামসা মূলত ডাক্তারি শুরু করল।
আমাদের একজন নিজস্ব সামসা আছেন। তার নাম জয়নাল ওরফে ডাক্তার আরিফ হোসেন। জয়নাল মানে ডা. আরিফ হোসেন মানে ইয়ে, গ্রেগর সামসু পেশাজীবনে ছিলেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ার্ড বয়। এমনিতে ওয়ার্ড বয়ের কাজের ব্যপ্তি বিশাল। সার্বক্ষণিক ওয়ার্ডে থাকা, ডাক্তারের সুবিধার্থে চা নাস্তাসহ এটা সেটা আনা, হাতে গ্লুকোমিটার নিয়ে ঘোরাঘুরি করা, ক্ষেত্রবিশেষে উত্তপ্ত রোগীর লোককে শান্ত করার দায়িত্বও ওয়ার্ড বয় পালন করে।
তবে ভাবছিলাম জয়নালের কথা। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত। ক্লাস এইট সে পাশ করেছিল কিনা, আমাদের জানা নেই। কল্পনা করলাম, কেমন ছিল জয়নালের ওয়ার্ড বয় জীবন? ওয়ার্ড বয় থেকে ডাক্তার হওয়া তো চাট্টিখানি কথা না। নিশ্চয়ই এর পিছে তাকে অনেক শ্রম দিতে হয়েছে!
আমি নিশ্চিত প্রতিদিন রাতের বেলা বাসায় গিয়ে জয়নাল বনে যেত ট্যাক্সি ড্রাইভার সিনেমার ট্রাভিস বিকল। আয়নায় তাকিয়ে ‘য়ু টকিন টু মি?’ বলার পরিবর্তে সে গম্ভীর মুখে ভ্রু কুঁচকে বলত, আপনার প্রেশারটা একটু বেশি আছে স্বাভাবিকের চেয়ে। কয়েকটা পরীক্ষা দিচ্ছি...
জয়নাল, মানে প্যারালাল ইউনিভার্সের ডা. আরিফ হাসান ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী । অন্যান্য ওয়ার্ড বয়দের চেয়ে ছিল সে একদম আলাদা। সুযোগ পেলেই নোরা ফাতেহি কিংবা মল্লিকা শেরওয়াতের কোমড়-বুক দেখার বদলে জয়নাল ডাক্তারদের পাশে দাঁড়িয়ে দেখত অপারেশন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওটি করতে করতে ডাক্তার ক্লান্ত হলেও জয়নালের ক্লান্তি নেই। ভাঙা হাড় রড, স্ক্রু দিয়ে জোড়া লাগানো, পা কেটে ফেলার দৃশ্য ঘুমের ভেতর তার কাছে ফিরে আসে অদ্ভুর রোমাঞ্চকর হয়ে। অপারেশন করার স্বপ্ন তাকে ঘুমায়ে দেয় না।
একদিন সেই স্বপ্ন সত্যিই ধরা দেয়।
ঘুম থেকে ঠে জয়নাল দেখে সে ডা. আরিফ হয়ে গেছে। ডা.আরিফ হাসানের বিএমডিসি নাম্বার বগলদাবা করে নীলক্ষেত থেকে সার্টিফিকেট বানিয়ে সে ছুটে হাসপাতালের দিকে। একটি নয়—দুটি নয়—তিনটি হাসপাতালে তার বিচরণ। অর্থোপেডিক সার্জন জয়নাল, মানে ডা. আরিফ হাসানের নাম ডাকও হচ্ছিল বাকিদের তুলনায়। হাসপাতালে তার সুসজ্জিত রুমের বাইরে লেখা ‘Doctor's Chamber’
সেই Chamber এ অসংখ্য রোগীর আনাগোনা।
শুধু ওষুধ কিংবা পরীক্ষা করতে দেওয়াই নয়, অপারেশন পর্যন্ত নখদর্পনে ডা. জয়নাল ওরফে ডা. আরিফ স্যারের।
তবে একদিন তার সফল ডাক্তারজীবনে মেঘ নেমে আসে।
সত্যিকারের ডা. আরিফ হাসান হানা দেয় জয়নালের Chamber এ।
জয়নালকে দেখে কি আসল ডাক্তারের হিংসা হয়?
হবার কথা না। এমন পরিশ্রমী মানুষ ডাক্তার না হলে এই পেশার পর্যাপ্ত সম্মান হয় না। ওয়ার্ড বয় থেকে ডাক্তার হওয়ায় আমরা বরং তাকে অভিনন্দনই জানাই৷ জয়নাল আরও একবার প্রমাণ করল, মানুষ মূলত ডাক্তার। যে কেউ চাইলেই তার নিজ নিজ পেশা থেকে ডাক্তারি করতে পারে। তবে এতে রোগীর মৃত্যুর দায়ভার এমবিবিএস, এফসিপিএস পাশ করা বোকা ডাক্তাররা নেবে না।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন