লেখা: ফাহিম হাসান
কারওয়ান বাজারের সামনে আছি। সদাই করতে করতে কোন ফাঁকে মানিব্যাগটা চুরি হয়ে গেছে বুঝতে পারি নাই। কপালটাই খারাপ। এখন রিকশা ভাড়া ছাড়া বাসায় কীভাবে যাব সে চিন্তাটিই মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। বাজারের থলেটা নিয়ে মেইন রোডে আসলাম। মোবাইলটা বের করে বাসায় ফোন দিলাম। রিসিভ করল আম্মু।
আমি: হ্যালো আম্মু, মানিব্যাগটা হারিয়ে গেছে। বাজার সব করতে পারি নাই। কিছু বাকি থেকে গেছে।
আম্মু: কী হদ্দে ওডো কিছু ন বুঝির। আরও জোরে হ।
আমি:(একটু উচু স্বরে) মানিব্যাগ আঁজি গেয়িদে হইদ্দি। বাজার বেগ্গিন গরিত ন ফারি।
আম্মু: জিনিস আঁজাই ফেলন ইয়েন তো আর নতুন কিছু ন তুল্লেই। কিইরিবি আর? বাসাত আঁই যা।
কলটা কাটার সাথে সাথেই দেখি রাস্তার উপর ৪/৫ জন রিকশাওয়ালা রীতিমতো যুদ্ধ লাগিয়ে দিয়েছে। এ বলে, ভাই, আমার রিকশায় উঠেন। ও বলে, ভাই, আমার রিকশায় উঠেন। আমি তো দেখে অবাক। আমার দেশে এত্ত এত্ত ভালো মানুষ আছে? দেশটা তো পরিবর্তন হয়েই গেল মনে হয়।
মাঝখান থেকে একজনে এসে তো সব সমস্যার একটা হাল বের করেই দিল। মাঝবয়সী এক রিকশাওয়ালা পেছন থেকে বলে উঠল, ভাইয়েরা দেখেন, উনি আমার দেশী লোক। সুতরাং, ওনাকে সাহায্য করার প্রথম হক আমারই থাকে। হয়তো উনি আম্মুর সাথে আমার কথোপকথনটা শুনেছিল। তাই বুঝতে পারল আমি চট্টগ্রামের।
আমিও সহমত পোষণ করলাম। সাহায্য করার প্রথম হক আমার দেশীয় ভাইয়ের উপরই বর্তায়।
মামা দেখি নিজে থেকেই রিকশা থেকে নেমে বাজারের ব্যাগগুলো রিকশায় তুলে দিচ্ছিল। আমি তো তার আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে গেলাম পুরো। কিন্তু ব্যাগগুলো রিকশায় তোলার সময় ব্যাগের ভেতরে কী কী সদাই করেছি সেসব কেন দেখছিল সেটা অবশ্য বুঝতে পারিনি। বাজারের সবচেয়ে বড় মাছটি কেনার কারণে মামা আমার তারিফও করল। এছাড়া বড় সাইজের চিংড়ি, গরুর মাংস এসব দেখে মামা তো কেঁদে দেওয়ার অবস্থা। আমি সিচুয়েশনটা কিছুই বুঝছিলাম না।
যাহোক, মামার সাথে টুকিটাকি কথাবার্তা বলতে বলতে বাটা সিগন্যালে নিজের বাসার নিচে চলে আসলাম। মামাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানালাম নিজে থেকে এসে হেল্প করার কারণে। মামাও সৌজন্য স্বরুপ বলল, যে এটা তার এক প্রকার কর্তব্য একজন অসহায় মানুষকে সাহায্য করা।
আমি কোনো এঙ্গেলেই বুঝে উঠতে পারলাম না যে আমি কোনদিক থেকে অসহায়। মানিব্যাগ হারিয়েছে ঠিক আছে, কিন্তু আমি তো সহজেই বিকাশ থেকে টাকা ক্যাশ আউট করে বাসায় আসতে পারতাম। খালি রিকশাওয়ালা মামারা নিজে থেকেই এগিয়ে এল বলে আমি আর টাকা ক্যাশ আউট করার সেই সময়টুকু পেলাম না।
যাহোক, মামাকে আরেকটা ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় জানিয়ে বাসার নিচে দাঁড়ালাম গেট খোলার অপেক্ষায়। রিকশাওয়ালা মামাও রিকশাটা ঘুরিয়ে কিছুদূর সামনে এগিয়ে গেল।
বাসার কেয়ারটেকার মামা জানাল তিনি খেতে বসেছে, খেয়ে উঠেই খুলে দেবে। সে ফাঁকে আমি মোবাইল চালাচ্ছিলাম। একটু পর দেখি রিকশাওয়ালা মামা আবার হাজির৷ আমি বললাম, কী হলো মামা? আবার ফেরত আসলেন যে? কোনোকিছু নিতে ভুলে গিয়েছিলাম নাকি?
মামা তো দেখি পুরো রেগে আছে। মামা বলল, রাখেন মিয়া আপনার আলগা পিরীত। আপনে পেছন থেকে ডাক দিলেন না ক্যান?
আমি সিচুয়েশনটা বোঝার চেষ্টা করছিলাম। পেছন থেকে ডাক দেব মানে? আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না মামা।
: আপনার কিছুই বুঝতে হবে না। আমি এ ধরনের সব ভিডিওই দেখি। সবাই পেছন থেকে ডাক দেয় রিকশা ঘুরিয়ে চলে যাওয়ার সময়।
: সবাই ডাক দেয় মানে? আমি তো সব জিনিসই নামিয়েছি রিকশা থেকে? আমি কেন ডাক দিতে যাব পেছন থেকে?
: হুররর মিয়া, বেশি কথা বইলেন না তো। দেখি বাজারের ব্যাগটা দ্যান জলদি।
আমি থ হয়ে গেলাম পুরো। বাজারের ব্যাগ দেব মানে? সে কেন আমার বাজারের ব্যাগ চাইছে? আর সে কীসের কোন ভিডিওর কথা বলছে?
: এত কী চিন্তা করেন মিয়া? জলদি দ্যান। আমি তো সবকিছু ভেবেচিন্তে রেখেছি। আজকে আর রিকশা চালাব না। জরিনার মারে নিয়ে সিনেমা দেখতে যাব আজকে। সিনেমা দেখে এসে রাতে আয়েশ করে মাছের মাথাটা খাব।
: মামা, আমাদের মনে হয় কোথাও ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। একটু ক্লিয়ার করে বলবেন কী আমাকে যে আপনি কোন ভিডিওর কথা বলছেন?
: আরে, ফেসবুকে ভিডিও কতগুলা দেখেন না যে, মানুষের মানিব্যাগ হারিয়ে গেছে বলে ফ্রিতে রিকশায় করে বাসায় যেতে চায়। পরে যে রিকশাওয়ালা রাজি হয় বাসার নিচে গিয়ে তারে বাজারের ব্যাগটা ধরিয়ে দিয়ে বলে যে, আজকে আপনাকে আর রিকশা চালাতে হবে না মামা। আজকে আপনি রেস্ট করেন।
মুহূর্তের মধ্যে আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছিল। মাথাটা ভনভন করে ঘুরতে শুরু করেছে। একে তো সব সদাই করতে পারিনি মানিব্যাগ হারানোর কারণে। এর ভেতরে যদি খালি হাতে বাসায় যাই, আম্মু আমাকেই রান্না করে ফেলবে হয়তো।
কোনোমতে নিজেকে সামলে রিকশাওয়ালাকে বললাম, মামা, আসলে এমন কিছুই না। বাসায় মেহমান আসছে তাই আমি বাজারগুলো করেছি।
: আমি অতকিছু বুঝি না মিয়া। দেখি বাজারের থলেটা দ্যান জলদি। বাসায় যাব।
এরমধ্যেই কেয়ারটেকার মামা এসে গেট খুলল। মামাকে বললাম, মামা, ১০০ টাকা দেন তো, রিকশা ভাড়া দেব।
কিন্তু রিকশাওয়ালা মামা দেখি নাছোড়বান্দা। উনি কোনো ভাড়া নেবে না। উনি বাজারের থলেটাই নেবে।
আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে ইতোমধ্যে। কিছুক্ষণের জন্য ভুলেই গিয়েছিলাম যে বাজারের থলেটার আসল মালিক আমিই।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন