পঁচাত্তর সালের ফেব্রুয়ারি মাসের কথা। নারায়ণ সান্যালের বড় মেয়ের বিয়ে। অতিথি ভোজনের দায়িত্বে বিজলি ক্যাটারার। নিমন্ত্রিতদের তালিকায় বিভিন্ন গণ্যমান্যদের মধ্যে আছেন এক ভাষাচার্য। হঠাৎ খবর এল, ভাষাচার্য একটু আগেই এসে পড়েছেন, তাকে এখনি একটা সেমিনারে যেতে হবে। তাকে ঘরে বসিয়ে নারায়ণ সান্যাল ছুটলেন ছাদে বিজলী গ্রিলের ম্যানেজারের কাছে।
: আমার একজন অতি বিশিষ্ট অতিথি এসে পড়েছেন। আপনার মেন আইটেম কয়েকটি একটা প্লেটে সাজিয়ে দিন।
একটু পরেই ম্যানেজার ভদ্রলোক একটি থালায় আহার্য সাজিয়ে নিয়ে এলেন। খেতে খেতে হঠাৎ সেই ভাষাচার্য একটি ভোজ্যদ্রব্যের দিকে তর্জনী নির্দেশ করে বললেন, ওটা কী?
বিজলী গ্রিলের ম্যানেজার হেসে বললেন, ওটা ফিশ ওর্লি, খেয়ে দেখুন, ভেটকি মাছের স্পেশাল আইটেম।
: ফিশের কী?
: আজ্ঞে ওর্লি।
ভাষাচার্যের চর্বণকার্য বন্ধ হলো। সোজা হয়ে বসলেন তিনি।
: ফিশের ওর্লি মানে কী? কোন দেশের খাবার?
: ভেটকি মাছের ফিশ ওর্লি স্যার! ইয়ে মানে ওর্লি।
: বানান কী?
স্যুট পরিহিত ম্যানেজার গলার টাইটা আলগা করে দিয়ে আমতা আমতা করে বললেন, ও আর লয়ে রেফ দীর্ঘ ঈ।
ভাষাচার্য গম্ভীরভাবে বললেন, আমি রোমান বানানটা জানতে চাইছি।
ম্যানেজার এবার আত্মসমর্পণ করে বললেন, ঠিক জানি না। শুনেছি জার্মান, না জার্মান নয়; ফ্রেঞ্চ বোধহয়।
ভাষাচার্য হাত গুটিয়ে নিলেন। বললেন, উঁহু, জার্মান ভাষায় ভাজাকে বলে Gebacken, অথবা Gebraten। ফরাসি ভাষায় ভাজা মাছ হচ্ছে Frit Poissons। ওর্লি তো জার্মান বা ফরাসি খাদ্য তালিকায় নেই। স্প্যানিশ ভাষায় ভাজা মাছ হচ্ছে Frito Pescado, ইতালিয়নে বলে Fritte Pesce। ওর্লি এল কোথা থেকে?
মাথায় উঠল খাওয়া। বোঝা গেল ওর্লির ব্যুৎপত্তি জানা না গেলে অচলাবস্থা কাটবে না। নারায়ণবাবু অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে। হঠাৎই তার মেজদা বললেন, আজ্ঞে, আপাতত এল রান্নাঘর থেকে। স্রেফ মাছ ভাজা বলেই ধরে নিন না। ব্যুৎপত্তিগত না হোক উৎপত্তিগত হদিসটা তো পেলেন।
হেসে উঠলেন ভাষাচার্য, তাই বলুন মাছ ভাজা, ওর্লি নয়। তাহলে উল্টে খাওয়া যেতে পারে। ওর্লির এপিঠ-ওপিঠ কিছুই জানি না কিন্তু ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানি।
পরে বিজলী গ্রিলের ম্যানেজার নারায়ণবাবুকে জিজ্ঞাসা করলেন, উনি কে স্যার?
: আমাদের জাতীয় অধ্যাপক সুনীতি বাবু, ভাষাবিদ।
ম্যানেজার জিজ্ঞেস করলেন, আর কজন ভাষাবিদ আপনার অতিথি তালিকায় আছেন?
নারায়ণবাবু বললেন, আর কেউ নেই। আপনি নির্ভয়ে ফিশ ওর্লি চালাতে পারেন।
ভদ্রলোক হেসে বললেন, না, আর ভয়ের কী আছে? ব্যুৎপত্তিগত না হোক উৎপত্তি তো জানা গেছে—রান্নাঘর।
প্রয়াণদিবসে ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
সূত্র: পঞ্চাশোর্ধে—নারায়ণ সান্যাল
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন