কথাটা শুনেই আমি হেসে দিলাম। গত সপ্তাহের ঘটনা। দাঁড়িয়ে আছি ঢাকা এয়ারপোর্টের চেকিং গেটে। এটাই সর্বশেষ চেকিং। এখানে ক্লিয়ারেন্স পেলেই এরপর বিমানে উঠে যাব। আমার পরে আরও দুয়েকজন থাকলেও বেশিরভাগ যাত্রীই ইতিমধ্যে বিমানে উঠে গেছে। আমার সহযাত্রী বন্ধু জাফিরও সিকিউরিটি গেট পেরিয়ে ওপারে গিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমার ব্যাগ চেক করছে ছোকরা গোছের একজন সিকিউরিটি।
আমি হালকা চালে বললাম, ‘নিশ্চয়ই মেশিন নষ্ট আছে। আপনি আবার চেক করেন। আর যাই পাওয়া যাক হেরোইন পাওয়ার তো কোনো কারণ নাই। এইটা তো ইদানিং আমি খাই নাই।‘
উনি সিরিয়াস গলায় বললেন, ‘মেশিন নষ্ট না স্যার।‘ শুনে আমি আবার হেসে দিলাম। সেটা দেখে উনি একটু বিরক্ত হয়ে কাকে জানি ওয়্যারলেসে কল করার জন্য ব্যস্ত হলেন।
ওয়্যারলেসে বললেন, ‘স্যার একজনের ব্যাগে হেরোইন পাওয়া গেছে। তাড়াতাড়ি আসেন।‘ দ্রুতই আরও দুইজন আসলেন। ব্যাপক উত্তেজনা শুরু হলো চারপাশে। আমি মাথা ঠান্ডা রেখে আবারও বিনীতভাবে তাদের বললাম, ‘আবার একটু চেক করেন। হেরোইন পাওয়ার কোনো কারণ নাই।‘
উনারা খুবই কসরত করে আবার আমার ব্যাগের উপর একটা মেশিন নাড়িয়ে সেখানকার স্যাম্পল আবার ডিজিটাল একটা মেশিনে ঢুকালেন। এরপর যেসব তথ্য দিলেন, তাতে আমি এবার শব্দ করেই একটু হেসে দিলাম।
'স্যার আপনার ব্যাগে এইবার হেরোইন, গান পাউডার এবং টিএইচসি পাওয়া গেছে। আপনার সব ব্যাগ তল্লাশি করা হবে। আপনার চেকড ব্যাগও অফলোড করে তল্লাশি করা হবে।'
আমি তখনও বেশ ঠান্ডা এবং খোশ মেজাজেই আছি। মজাই পাচ্ছি। বললাম, ‘করেন, সব ব্যাগ তো এখানেই আছে।‘
'আপনার চেকিং ব্যাগও করতে হবে।'
'আমার তো কোনো চেকড ব্যাগ নাই। এই যে যেটা থেকে হেরোইনের মতো জিনিস পাচ্ছেন সেই ব্যাকপ্যাক আর ক্যারি-অন।'
চেকড ব্যাগ নাই শুনে খুবই হতাশ হলেন মনে হয় সিকিউরিটি ছোকড়া। সেটা বুঝতে পারলাম সে যখন আরও দুইবার কথার মাঝখানে উত্তেজনা নিয়ে বলল, ‘আপনার চেকিং ব্যাগ সার্চ করতে হবে।‘ আমি দুইবারই তার উত্তেজনায় জল ঢেলে দিয়ে বললাম, ওটা নাই। যা আছে সব এখানে।
ছোকরা সিকিউরিটি আমার দুটো ব্যাগই খোলা শুরু করলো। আমি ধৈর্য্য নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছি। আমাকে হাত দিতে দিচ্ছে না আমারই ব্যাগে। ইতিমধ্যে তামাশা দেখার জন্য (বা সত্যিই তাদের দায়িত্ব পালনের জন্য) বাংলাদেশ বিমান ও এয়ারপোর্টের নানা পদের লোকজন দাঁড়িয়ে গেছে চারপাশে। অন্তত ১৫ জোড়া চোখের সামনে আমার টিশার্ট-আন্ডারওয়্যার-মোজা-শর্টস, চার্জিং ক্যাবল ইত্যাদির প্রদর্শনী শুরু হয়ে গেলো। আমি অবশ্য নিজের উপর খুবই মুগ্ধ হলাম। এত সুন্দর করে গুছিয়ে এনেছি সব। বাহ সিমু বাহ! ব্যাগদুটো একদম খালি করে কয়েকটা ট্রেতে রাখা হলো।
এই ফাঁকে আমি একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমি তো কখনও এতসব জিনিস নিয়ে একবারে এয়ারপোর্টে ধরা পড়ি নাই, এসব নিয়ে ধরা পড়লে আপনাদের প্রসিডিউর কী?...জেল? নাকি আপনাদের সেই ক্ষমতা নাই? এয়ারপোর্ট পুলিশের তো তা থাকার কথা। উনি চোখ গরম করে বললেন, ‘আপনাকে থরোলি চেক করা হবে। কোনো কিছু বাহ্যত না পাওয়া গেলে বোর্ডিং করা হবে।‘
আমি বললাম, ‘তাইলে সেই চেকটা একটু তাড়াতাড়ি করেন। অনেক্ষণ তো হলো।‘ কারণ ইতিমধ্যে আধাঘন্টার মতো পেরিয়ে গেছে। বিমান টেকঅফ করার নির্ধারিত সময়ও পেরিয়ে গেছে। আমি আর বন্ধু জাফির ছাড়া সবাই প্লেনে। চারদিকে একটা অস্থিরতা!
আমি বললাম, ‘এই মেশিনটা নষ্ট, বা রিডিং যিনি নিচ্ছেন তিনি প্রসেস ঠিকমতো জানেন না। প্লিজ পাশের বোর্ডিং গেটের মেশিন দিয়ে আমার ব্যাগটা আবার চেক করিয়ে দেখতে পারেন।‘ উনারা সেটা করলেন না। একই মেশিনে আবার সব চেক করতে দিলেন। এবার আরও মজার রিডিং এলো—প্রথমবারের তুলনায় তিনগুণ মাত্রার হেরোইনের সন্ধান পাওয়া গেলো আর দ্বিগুণ হয়ে গেলো গান পাউডারের পরিমান, টিএইচএস বেড়ে হয়েছে ছয়গুণ।
সিকিউরিটির আরেক কর্তা এলেন তখন। চারদিকে সবারই মুখে উত্তেজনা। আমি বললাম, ‘দেখেন মেশিন যে নষ্ট সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে। প্রথমবার শুধুই হেরোইন, পরেরবারে তিনটা একসাথে, এর পরেরবারে মাত্রার ভিন্নতা। প্লিজ অন্য একটা মেশিনে চেক করেন। বা আরও যা চেক করার করেন, দ্রুত করেন।‘ কারণ তখন এতই দেরি হয়ে গেছে যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে আমাকে ছাড়াই বিমান উড়াল দেবে। আমি এই প্রথম একটু টেনশনে পড়ে গেছি। এদের আনাড়িপনায় আমি প্লেন মিস করতে চাই না।
সেই সিকিউরিটির কর্তা বললেন, ‘আপনার কি কোনো গান মানে বন্ধুক আছে?’ আমি বললাম, ‘না, কখনোই ছিলো না। আমি গানের বিপক্ষের মানুষ। ইনফ্যাক্ট মানুষ হত্যার সকল যন্ত্রের বিপক্ষে...ইমাজিন দেয়ারস নো হেভেন...তবে আমার পিলখানার আশপাশ দিয়ে প্রচুর চলাফেরা হয়, সেটার ভেতরে তো জানি গোলাবারুদ মজুদ থাকে, গান টেস্টিং হয়। সেখান থেকে কিছু কি আসতে পারে? এলেও হেরোইন আর টিএইচসের কোনো ব্যাখ্যা নাই আমার কাছে মেশিন নষ্ট হওয়া ছাড়া। বাংলাদেশে তো কোনো হেরোইনের ফ্যাক্টরি নাই যে পাশ দিয়ে গেলে হেরোইন কণারা আমার ব্যাগে এসে পড়বে।‘
উনি আমাকে আশ্বাস দিলেন, ‘চিন্তা করবেন না, আপনাকে ছাড়া প্লেন ছাড়বে না। আমরা আবার একটু দেখছি।‘ আমি বললাম, ‘এখন আপনাদের প্রসিডিউর কী?’ তিনি বললেন, ‘যেহেতু আপনাকে থরোলি চেক করেও কিছু পাওয়া যায়নি এখন এয়ারপোর্টের সিকিউরিটি ও বর্তমানে দায়িত্বপ্রাপ্ত ফ্লাইটের বিমান কর্মকর্তা মিলে দায়িত্ব নিয়ে আপনাকে বোর্ডিং করবেন।‘
কিন্তু আমি বুঝতে পারছি, আমাকে ছাড়াই তারা প্লেন ছাড়ার ফিসফাস শুরু করছে। বিশেষ করে বিমানের যে পঞ্চাশোর্ধ মহিলা দায়িত্বে তিনি খুবই পিছলা টাইপের। সামনে সুন্দর কথা বলছেন কিন্তু পেছনে পেছনে দায়িত্ব নিচ্ছেন না। সেইটা ভেতর থেকে লক্ষ্য করছে সহযাত্রী জাফির। সে আমাকে জানালো সেটা। আমি সেটা শুনে একটু স্বগতোক্তি করেই বলললাম, ‘দায়িত্ব নেবেন না নিজে চেক করে তাহলে এই দায়িত্বে আছেন কেন?’ আমার হঠাৎ হুশ হলো, এ তো ভালোই বিপদে পড়লাম! এতক্ষণের মজা এবার সিরিয়াস হয়ে দেখা দিয়েছে। শিট ইজ গেটিং রিয়েল। তারা আমাকে পরের ফ্লাইটে ট্রান্সফার করে দেবে নাকি? সেইটা কবে কখন কে জানে?
আসলেই প্রসিডিউর কী আর নিয়মের মধ্যে থেকে আমার করণীয় কী জানার জন্য ফোন দিলাম বিমানেরই এক বড় কর্তা বন্ধুকে। সেও তখন এয়াপোর্টেই ডিউটিতেই। সেও একই কথাই বলল। আর বলল, ‘আরও বেশি সিরিয়াস হলে এরপর সে ইনভলভ হবে। প্লেন আমাকে রেখে যেতে পারবে না।‘ কাজেই আমি মাথা আরেকটু ঠান্ডা করলাম।
তাদের বললাম, ‘দেখেন আপনারা আমাকে ও আমার ব্যাগ পুরোটা চেক করেছেন থরোলি। কোথাও কিছু পান নাই। এখন আপনারা দুইপক্ষ মিলে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেন। এটাই আপনাদের দায়িত্ব। নিজের চোখেই তো সব দেখলেন। আর যেহেতু আমার কোনো ভুল নাই তাই আমি সম্ভবত পরের ফ্লাইটে যাব না। কীভাবে কী করবেন দ্রুত করেন। আর আমার পক্ষ থেকে সাজেশন হলো, আমার ব্যাগটা অন্য একটা বোর্ডিং গেটের মেশিন দিয়ে চেক করান। তাহলে সব ল্যাঠা একবারে চুকে যায়। এই মেশিন নষ্ট আমি নিশ্চিত।‘
এতক্ষণে এতসব বড় কর্তা এখানে এসে পড়েছেন যে, প্রথম যিনি সিকিউরিটি চেক করছিলেন তিনি পদমর্যাদায় ততক্ষণে অনেক ছোট হয়ে গেছেন। তবুও সে আবার উচ্চকন্ঠে বলে উঠলো, ‘মেশিন নষ্ট না স্যার। মেশিন ঠিক আছে।‘ এইবার আমার মেজাজটা একটু চড়ে গেল। বললাম, ‘হেই মেশিন নষ্ট না হলে বা আপনি ঠিকঠাক প্রসিডিউর জানলে একই সোর্স থেকে একই উপাদানের ছয়গুণ রিডিং আসে কীভাবে?’
আমার এই অসহিষ্ণুতা ও যুক্তি এয়ারপোর্ট সিকিউরিটির এক কর্তা এবার কানে তুললেন। একজনকে বললেন, ‘আমার ব্যাগটা পাশের বোর্ডিং গেট থেকে চেক করে আনতে।‘ আমি বললাম, ‘উহু, আমি উনাকে একা যেতে দেব না। আমি আপনাকে নিয়ে থাকতে চাই যাতে ভুলভাল কিছু আবার না করতে পারে।‘
ভেতর থেকে ৫০ মিনিট ধরে এই নাটক দেখছিলো সহযাত্রী জাফির। জোরে জোরেই তাকে ডেকে বললাম, ‘জাফির ট্রেতে রাখা জিনিস তুমি পাহারা দাও যাতে কেউ কিছু হাপিস করে না দিতে পারে।‘ কারণ একটা পাউচে আমার কিছু ইমার্জেন্সি ক্যাশ ডলার আছে। সেইটা এতক্ষণ যারা যারা চেক করেছে সবাই জানে। ডলারে ভেসে যাওয়া এই দেশে এই সময়ে ক্যাশ ডলার হারাতে চাই না আমি। জাফিরকে দায়িত্ব দিয়ে আমি ওই কর্তাসহ ব্যাগ নিয়ে পাশের বোর্ডিংয়ে গেলাম। এবং ভোয়ালা! ব্যাগ ক্লিয়ার! কোথাও কোনো কিছুর চিহ্ন নেই। এই মেশিনটা আসলেই নষ্ট ছিলো!
এই তথ্য নিয়ে বোর্ডিং গেটে আসা মাত্রই যেন সবাই হতাশ হয়ে পড়লো। একটা ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল মজার কিন্তু বেরসিক যন্ত্র সব নষ্ট করে দিলো। হঠাৎ করে বিমানের লোকজন খুব তৎপর হয়ে উঠলো। দ্রুত দ্রুত করেন সব। বিমানের ওই মহিলা সামনে এলেন এতক্ষণে, পাশের এক সিকিউরিটিকে নির্দেশ দিলেন, ‘উনার সব জিনিস ব্যাগে ঢুকান দ্রুত।‘
আমি জানি সিকিউরিটি এইবার সব জিনিসপত্র কোনোমতে ডাম্প করবে আমার ব্যাগে। আমার সাজানো গোছানো বাগান তছনছ করবে। সেটা আমি জীবন থাকতে হতে দেব না। এবার আমি আমার হালকা মেজাজ হারালাম। ওই মহিলার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘একদম পেছনে যান আপনি। কেউ আমার জিনিসে হাত দেবেন না। এতক্ষণ হয় বললাম অন্য মেশিনে চেক করেন সেইটা না করে পিছলালেন, এক ঘন্টা ধরে এখানে দাঁড় করিয়ে রাখলেন, যে সিদ্ধান্ত আপনার নেওয়ার কথা সেটা নিলেন না, আমাকে অফলোড করার চিন্তা করলেন, হেনস্থা করলেন আর এখন প্রেশার দিচ্ছেন আমাকে দ্রুত করার জন্য? আপনাদের আনাড়িপনার কারণে দেরী হয়েছে, আমার কারণে নয়, এখন আমাকে আমার মতো ঠান্ডা মাথায় ব্যাগ গুছাতে দেন।‘ বলে আমি ঠান্ডা মাথায় আবার সুন্দর করে বাসায় যেভাবে ভাজ করে করে জিনিস রেখেছি সেভাবে রাখতে শুরু করলাম। আমি আবারও আমার ব্যাগ গোছানোতে প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে নিজেকে বাহবা দিলাম—বাহ্ সিমু বাহ্!
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন