লেখা: রুকনুল ইসলাম
১#
অনেক বছর আগের কথা। তৎকালীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশের নদী নিয়ে একটা প্রোজেক্টর সূচনা করেছিলেন। প্রোজেক্টের নাম ছিল ‘ক্যাপিটাল ড্রেজিং’। এটার জন্য একটা উচ্চ পর্যায়ের কমিটিও ছিল। তো ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রোজেক্ট শুরুর আগে দুইটা পাইলট প্রোজেক্ট নেওয়া হলো যমুনা নদীতে। একটা সিরাজগঞ্জ এবং আরেকটা কুড়িগ্রাম জেলাতে। ঐ উচ্চ পর্যায়ের কমিটি, আমার বস (যিনি একজন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান নদী বিশেষজ্ঞ)-কে দায়িত্ব দিয়েছিল সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীতে (একটা নির্দিষ্ট জায়গায়) ড্রেজিং ফলপ্রসূ হবে কিনা তা গবেষণা করে রিপোর্ট আকারে জানানোর জন্য। ঐ রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে অনেক কিছুর ভবিষ্যৎ ঠিক হবে।
২#
আমার বস অফিসে এসে আমাকে তার রুমে ডাকলেন এবং কী করতে হবে বিস্তারিত বললেন। স্যারের তত্ত্বাবধানে আমি এবং স্যার দুইজনে মিলে গবেষণা করে রিপোর্টের কাজ শেষ করলাম। স্যার এবং আমি অনেক সময় নিয়ে এই কাজ করছিলাম, কেননা এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল।
আমাদের গবেষণার ফলাফল ছিল, যমুনা নদীর ঐ নির্দিষ্ট জায়গায় ড্রেজিং ফলপ্রসূ হবে না।
এখানে কোটি কোটি টাকার ব্যাপার এবং ড্রেজিং করলে সম্পূর্ণ টাকাই নষ্ট হবে, তাই আমরা খুবই সতর্ক ছিলাম। স্যার আমাকে সঙ্গে নিয়ে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উদ্দেশে রওয়ানা দিলেন। একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং ছিল। যেখানে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, সচিব, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালকসহ আরও অনেকে।
আমার বস আমাদের গবেষণার রিপোর্ট উপস্থাপন করলেন। একটা পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশান করলেন এবং বুঝিয়ে দিলেন যে, কেন যমুনা নদীর ঐ নির্দিষ্ট জায়গায় ড্রেজিং ফলপ্রসূ হবে না। মিটিঙে উপস্থিত তৎকালীন পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী ঐ রুম থেকে চলে যাবার পর, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব বললেন, যেভাবেই হোক ড্রেজিং ফলপ্রসূ হবে এভাবে রিপোর্ট তৈরি করতে। এটা উপরের নির্দেশ। রিপোর্ট আজকের মধ্যেই দিতে হবে কেননা আগামীকাল রিপোর্ট যাবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালককে দায়িত্ব দিলেন বিষয়টা তদারকি করতে।
৩#
আমরা তখনই চলে গেলাম বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালকে্র কার্যালয়ে। সেখানে বসে আমাদের বাধ্য করা হলো রিপোর্টটা পরিবর্তন করতে। স্যার অনেক বুঝানোর বৃথা চেষ্টা করলেন কিন্তু কোনো লাভ হল না। স্যার আমার পাশে মুখ গোমড়া করে বসে ছিলেন এবং আমি নিজ হাতে ঐ রিপোর্টটা পরিবর্তন করলাম। হিসাব-নিকাশ থেকে শুরু করে সব কিছু পরিবর্তন করা হলো। পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশানও পরিবর্তন করা হলো। আমাদের থেকে রিপোর্টটা নিয়ে মহাপরিচালক আবার রওয়ানা দিলেন পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দিকে আর আমরা আমাদের অফিসের দিকে।
৪#
আমার বস এবং আমার, আমাদের দুই জনেরই মন খুব খারাপ। স্যার গাড়িতে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে ছিলেন। কোনো কথা বলছিলেন না। তখন আমি স্যারকে বললাম, আমরা এটা হতে দিতে পারি না। এইভাবে দেশের কোটি কোটি টাকা ক্ষতি হবে এবং তা আবার আমাদের হাত দিয়েই? এটা কোনোভাবেই মানা যায় না। আমি স্যারকে বললাম, হয়তোবা প্রধানমন্ত্রী এটার কিছুই জানেন না। আমাদের উচিত যেকোনো ভাবেই হোক প্রধানমন্ত্রীকে এটা জানানো। স্যার তখন আমাকে বললেন, কোনোভাবে যদি পরিকল্পনা মন্ত্রীকে বিষয়টা জানানো যায় তবে কাজ হতে পারে। স্যার তখন কাকে ফোন করেছিলেন মনে নাই, তবে আমাদের ভাগ্য ভালো পরের দিন সন্ধ্যায় পরিকল্পনা মন্ত্রীর বাসায় একটা সাক্ষাতের সময় পাওয়া গেল।
৫#
পরের দিন সন্ধ্যায় পরিকল্পনা মন্ত্রীর বাসায় স্যার গিয়েছিলেন এবং মন্ত্রী মহোদয়কে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, যমুনা নদীর ঐ নির্দিষ্ট জায়গায় ড্রেজিং ফলপ্রসূ হবে না। কিন্তু ড্রেজিং ফলপ্রসূ হবে এই রিপোর্ট তো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চলে গেছে। এখন উপায় কী? মন্ত্রী মহোদয় সরকার স্যারকে বললেন, আপনারা আবার নতুন করে রিপোর্ট ও প্রেজেন্টেশান তৈরি করুন এবং প্রধানমন্ত্রীর সাথে মিটিঙের দিন ১০/১২ কপি নতুন রিপোর্টটা নিয়ে আসবেন। যেহেতু একটা রিপোর্ট চলে গেছে তাই এটা আপাতত কাউকে কিছু বলার দরকার নাই। আমি সুযোগ পেলে প্রধানমন্ত্রীকে বিষয়টা অবগত করব। মিটিঙের দিন রিপোর্টটা সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর হাতে দেবেন। আমি মিটিঙের দিন প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুমতি নিয়ে আপনাকে রিপোর্টটা দিতে বলব। আশা করি প্রধানমন্ত্রী মানা করবেন না।
সরকার স্যার ঐ দিন সন্ধ্যায়ই আমাকে ফোন করে সব বললেন। পরদিন সকালে স্যার আমাদের অফিসের তৎকালীন নির্বাহী পরিচালক স্যারকে বললেন যে আমরা আবার নতুন করে রিপোর্ট করব। সিদ্ধান্ত হলো আমি এই কাজ করব অফিস সময়ের শেষে। অফিস টাইমে এই কাজ করা যাবে না। আমার মনে আছে, আমি ৩ দিন, অফিস টাইমের পরে কাজ করেছিলাম রাত দুইটা/তিনটা পর্যন্ত।
৬#
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মিটিঙের দুই দিন আগে আমার বস হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। স্যার হার্টের রোগী ছিলেন। স্যার আমাকে তার রুমে ডেকে বললেন, উনার পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মিটিঙে যাওয়া সম্ভব না। স্যারের ইচ্ছা, আমি যেন যাই। স্যার বললেন, আমার বিশ্বাস তুমি পারবা। তুমি প্রধানমন্ত্রীকে বুঝাতে পারবা। আর পরিকল্পনা মন্ত্রী তোমাকে সাপোর্ট দেবে। আমি এক কথায় বললাম, আমি পারব এবং এই ড্রেজিং যাতে না হয়, সেভাবেই বোঝানোর চেষ্টা করব।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তো চাইলেই যাওয়া যায় না। অনেক অনুমতির ব্যাপার আছে। স্যার, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নাম পরিবর্তন করে তার জায়গায় আমার নাম দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। মন্ত্রণালয় রাজি হয়ে, অনুমতির জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আমার নাম প্রস্তাব করল এবং তা অনুমোদিত হলো।
আমার বসের সহযোগিতায়, আমি খুব ভালো করে নিজেকে প্রস্তুত করলাম।
৭#
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মিটিঙের দিন সকালে, আমার বস এবং নির্বাহী পরিচালক স্যারের কাছে অনুমতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দিকে রওনা দিলাম।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে, তিন স্তরের সিকিউরিটি চেক পার করে একটা হল রুমে গিয়ে আমার জন্য নির্ধারিত আসনে গিয়ে বসলাম। আমি যেহেতু নতুন, তাই আমাকে বলে দেওয়া হলো কখন কখন কথা বলতে পারব, কীভাবে কথা বলতে হবে, কীভাবে কথা বলার জন্য অনুমতি নিতে হবে, অনেক নিয়ম কানুন।
পরিকল্পনা মন্ত্রী ঐ হল রুমে প্রবেশ করা মাত্র আমি তার কাছে গিয়ে সালাম দিয়ে আমার রিপোর্টগুলো তাকে দিতে চাইলে তিনি বললেন, আপনি নিজের হাতে এক কপি প্রধানমন্ত্রী কে দেবেন এবং বাকি কপিগুলা সামনের সারিতে বসা বাকি মন্ত্রিদের দেবেন। আমাকে উনার নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করতে বললেন।
একে একে অনেক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিবগন এসে হাজির হলেন। ঐ মিটিঙে তৎকালীন পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক এবং বি আই ডাবলু টি এ-এর চেয়ারম্যানও উপস্থিত ছিলেন। একটু পর প্রধানমন্ত্রী এসে হাজির হলেন। আগে থেকেই বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকগণ উপস্তিত ছিল। প্রধানমন্ত্রী আসার পর তারা কিছু ভিডিও ফুটেজ নিয়ে চলে গেল। তারপর মিটিং শুরু হলো।
শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী সংক্ষিপ্তভাবে কিছু বলার পর পরিকল্পনা মন্ত্রীকে ঐ দিনের মিটিঙের বিষয় উত্থাপন করতে বললেন। মন্ত্রী মহোদয় শুরু করলেন এবং কিছুক্ষণ বলার পর বললেন যে আমাদের পানি বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় কিছু পরিবর্তন হয়েছে, যা আগের রিপোর্টের থেকে ভিন্ন এবং সময় স্বল্পতার জন্য আমরা তা আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠাতে পারি নাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনুমতি দিলে উপস্থিত একজন পানি বিশেষজ্ঞ তা আপনার সামনে উপস্থাপন করবেন।
প্রধানমন্ত্রী অনুমতি দিলেন এবং পরিকল্পনা মন্ত্রী আমাকে হাতের ইশারায় রিপোর্ট দিতে বললেন।
আমি আমার সামনে রাখা রিপোর্টগুলা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দিকে এগিয়ে গেলাম। তার ডান পাশে দাড়িয়ে সালাম দিয়ে এক কপি তার হাতে দিলাম। উনি হাতে নিয়ে এক এক করে রিপোর্টের পাতা উল্টাতে লাগলেন এবং পুরা রিপোর্টটা একটু বোঝার চেষ্টা করলেন। ঐ সময় সবাই চুপ করে ছিল। যেন পিন পতন নীরবতা। প্রধানমন্ত্রী রিপোর্টটা তার টেবিলে রেখে আমাকে বসতে বললেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম বাকি রিপোর্টগুলো অন্য মন্ত্রীদের দেব কিনা? উনি অনুমতি দিলেন এবং আমি বাকি রিপোর্টগুলো মন্ত্রীদের বিতরণ করে, আমার জন্য নির্ধারিত আসনে গিয়ে বসলাম।
মিটিঙের এক পর্যায়ে গিয়ে আমাকে অনুমতি দেওয়া হলো প্রেজেন্টেশন দেবার জন্য। আমি দিলাম এবং পরিষ্কারভাবেই সব বুঝিয়ে দিলাম যে, ড্রেজিং ফলপ্রসূ হবে না। উপস্তিত সবাই দেখল এবং শুনল। এটা নিয়ে অনেক আলোচনা হলো। আমার স্পষ্ট মনে আছে, কৃষি মন্ত্রী এবং পরিকল্পনা মন্ত্রী ছাড়া আর কেউ আমাকে সাপোর্ট করে নাই।
প্রধানমন্ত্রী অনেক কথা বললেন এবং শেষে বললেন, ড্রেজিং হবে এবং এটাই আমার সাফ কথা। আমি আর কিছু শুনতে চাই না।
আমি প্রচণ্ড অবাক হয়েছিলাম সেদিন। আমি প্রধানমন্ত্রীকে খুব ভালো মানুষ এবং একজন দেশপ্রেমী জানতাম। আমার অনেক দিনের ধারণা মুহূর্তের মধ্যেই ভেঙে শেষ হয়ে গেল। যে মানুষ একটা গরিব দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং তার কাছে হাজার কোটি টাকা নষ্ট হবে, এটা কোনো ব্যাপার না। এটা কোনো কথা হলো?
মনে অনেক প্রশ্ন আর হতাশা নিয়ে চুপ করে বসে ছিলাম। আর কোনো কথা বলি নাই।
৮#
মিটিং শেষে প্রধানমন্ত্রী চলে যাবার পর এক এক করে যখন সবাই চলে যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময় পানি মন্ত্রণালয়ের সচিব আমার কাছে এসে বললেন বাইরে গিয়ে যাতে আমি ওনার জন্য অপেক্ষা করি। কথা বলবেন।
বাইরে এসে আমি পানি মন্ত্রণালয়ের সচিবের জন্য অপেক্ষা করছিলাম তখন উনি বের হয়ে আসলেন এবং আমাকে বললেন উনার গাড়িতে বসতে। সচিবের গাড়িতে তার পাশে বসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বের হলাম। আর তখনই শুরু হলো আমার উপর আক্রমণ। এমন কোনো খারাপ গালি নাই যে সচিব আমাকে দেয় নাই। খারাপ ভাষায় অজস্র গালিগালাজ করছিলেন।
একবার জিজ্ঞেস করলেন, এই যে রিপোর্ট পরিবর্তন করলাম, তা তাকে জানালাম না কেন? বললাম, সত্যিটা প্রধানমন্ত্রীর জানা উচিত, তাই রিপোর্ট পরিবর্তন করেছি।
এ কথা শোনার পর সচিব তার ড্রাইভারকে বললেন, গাড়ি থামাতে। মাঝ রাস্তায়, বিজয় সরণির কাছে গাড়ি থামলে, সচিব আমাকে এক প্রকার ঘাড় ধাক্কা দিয়ে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিলেন।
মন মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ হয়েছিল। হাঁটতে হাঁটতে ফার্মগেট চলে গেলাম। একটা সিএনজি নিয়ে অফিসে ফেরত আসলাম। সব ঘটনা আমার বস এবং নির্বাহী পরিচালক স্যারকে বললাম। দুইজনই একই পরামর্শ দিলেন। এই ঘটনা এইখানেই শেষ। আমি যেন কাউকে না বলি।
৯#
পরবর্তীতে যমুনা নদীতে ঐ জায়গায় ড্রেজিং হয়েছিল এবং ড্রেজিং করে কোনো লাভ হয় নাই।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন