যেরকম একরোখা মাঝারি চিন্তার লোকেরা জীবদ্দশায় ইমাম গাজ্জালি ও ইবনে সিনার অগ্রসর চিন্তা বুঝতে না পেরে তাদের অপদস্থ করেছিল; ঠিক সেরকম মাঝারি চিন্তার একরোখা লোকেদের কাছে গাজ্জালি ও সিনা এখন গর্বের প্রতীক। যেরকম কট্টর চিন্তার মানুষেরা জীবদ্দশায় কবি জালালউদ্দিন রুমির ওপর চড়াও হয়েছিল; সেরকম কট্টর চিন্তার মানুষ আজ রুমি পড়েন। ঠিক যেরকম ক্ষীণ বুদ্ধির লোকেরা সাদাত হাসান মান্টোর গল্পকে অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত করে আদালতে তাকে ধর্ণা দিতে বাধ্য করেছিলেন, তাকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন; তারাই আজ মান্টো ভক্ত। যে মির্জা গালিবকে রক্ষণশীল লোকেরা খুশিজল পানের দায়ে অপদস্থ করেছিল, তারাই আজ মির্জা গালিবে হৃদয়ের কথা খুঁজে পায়। যে আমির খসরুর সম্মিলনি সংগীতে অসন্তুষ্ট ছিলেন বিভাজন প্রিয় লোকেরা; তারা আজ আমির খসরুর কাওয়ালিতে দিওয়ানা হন।
আজ এ প্রজন্মের কবি ও প্রাবন্ধিক সোহেল হাসান গালিব সম্পর্কে নিউ এইজ পত্রিকায় তাকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে; এমন খবর পড়ে মনে পড়ল, এই তো দুদিন আগে তার কবিতার অর্থ না বুঝে তার ফেসবুক পোস্টে এসে গরম গরম কথা বলে গেলো ইসলাম ধর্ম ও মহানবী মুহম্মদ (সাঃ)-র ভাবমূর্তির স্বপ্রণোদিত ম্যানেজারেরা। গালিবের কবিতায় তারা অবমাননা খুঁজে পেয়েছে; সুতরাং গালিবকে শাস্তি দেবে তারা; এমন তাদের আবদার।
এই যে আমাদের শিল্প-সাহিত্য জগত; যা বৃটিশ উপনিবেশের প্ররোচনায় তৈরি বেঙ্গল রেনেসাঁর অস্থিধারণ করে গড়ে উঠেছে; যেখানে পূর্ব বঙ্গের জল হাওয়া ভাষা নেই; নেই পূর্ব বঙ্গের মানুষের উল্লেখ। সেই এক ধর্মী ঔপনিবেশিক কালচারাল হেজিমনিতে রুগ্ন সাহিত্য জগতে সোহেল হাসান গালিব স্বকীয় ভাষা ও সংস্কৃতির শৈল্পিক উপস্থাপনা করেছেন। যে সমাজে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক সালাম আচ্ছালামু আলাইকুম বলে বক্তব্য শুরু করলে ঢাকার বুদ্ধিজীবীদের বিব্রত হতে দেখেছেন কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ; সেখানে গালিব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বাংলা ভাষার নদীতে মিশে থাকা আরবি-ফারসি-সংস্কৃত শব্দ সহযোগে আমির খসরুর মতো কবিতা লিখেছেন। তিনি একজন অধ্যাপকের সন্তান, নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের স্নেহধন্য ছাত্র; ফলে তার বেড়ে ওঠার মধ্যে স্বর্ণলতার মতো দলান্ধ সংস্কৃতি মামাদের জড়িয়ে ধরে বেড়ে ওঠার সুযোগ ছিল না। আত্মপরিচয়ের দুর্বলতা না থাকলে কেউ মোদি প্রগতিশীল সাহিত্যিকদের পাত্তা দেয় না। গালিব তাই ক্লিশে কালচারাল ন্যারেটিভ আর ফাঁপা প্রগতিশীলতার গজদন্তের মিনারকে গুড়িয়ে দিয়েছেন তার কবিতার শক্তিতে। অথচ গালিব ভীষণ বিনয়ী; নিজের সম্পাদিত প্রকাশনায় দলমতচক্র না দেখে কেবল সাহিত্যমানের ভিত্তিতে সব লেখকের লেখা ছেপেছেন তিনি।
গালিব একজন অধ্যাপক। কম্পিটিটিভ এক্সামে তার বিষয়ের মেধা তালিকায় তার স্থান ছিল প্রথম। ঠিক যেরকম পণ্ডিত মানুষদের আমরা বাংলাদেশের সোনালী যুগে শিক্ষকতায় পেয়েছি; নতুন যুগে গালিব তেমনি একজন শিক্ষক।
যোগ্য অধ্যাপক, কবি-সাহিত্যিকদের কার অভিমতের সঙ্গে ইঞ্চি ইঞ্চি মিলিয়ে কথা বলার কথা নয়। তাই গালিব কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের সঙ্গে ও কট্টর ইসলামপন্থীদের সঙ্গে ইঞ্চি ইঞ্চি মিলিয়ে কথা বলেননি। বরং রুমি-খসরু-মির্জা গালিবের মতো করে পিছিয়ে থাকা মানুষদের চিন্তার অচলায়তন ভেঙে তাদের মুক্ত করতে চেয়েছেন তাদের অন্ধত্ব থেকে।
বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ মুক্তিযুদ্ধের ওপর একক মালিকানা দাবি করে চলা দেড় দশকের আওয়ামী ফ্যাসিজমের সমালোচনা করেছেন তিনি। একইভাবে বাংলাদেশের প্রতিটি মুসলমানের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ইসলাম ধর্মের মালিকানা দাবি করে চলা তৌহিদি জনতার উইচ হান্টিং-এর সমালোচনা করেছেন গালিব। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে নৈতিকতাহীন শরীরে মুজিব কোট পরে মাস্তানি করার জবাব বাংলাদেশের মানুষ দিয়েছে। কিন্তু তা দেখে ইসলামি চেতনার নামে অনৈতিক মাথায় সাদা টুপি পরে মাস্তানি করে বেড়ানো লোকেদের কোনো শিক্ষাই হয়নি। এত অবিবেচক ও পরিণতি সম্পর্কে অসচেতন লোক কী করে হয়!
তৌহিদি জনতার মাঝে যারা চিন্তাশীল ও স্থিতধী; তাদেরকে অনুরোধ করব; আওয়ামীলীগের ক্যাডারদের মতো দখলদারিত্ব ও পেশীশক্তি না দেখিয়ে; আলাপ-আলোচনা-বিতর্ক-বাহাজ-সংলাপের মতো সভ্যতার সংস্কৃতি চর্চা করতে। এখনও সময় আছে আওয়ামীলীগের দেখানো সর্বনাশা পথে না যাওয়ার। বাংলাদেশের মানুষ কোমল হৃদয়ের ও সহনশীল। কিন্তু তারা কারও বাড়াবাড়িতে রেগে গেলে কী হয় তা ১৯৪৭-এর আগে কৃষক প্রজা আন্দোলনে আমরা দেখেছি, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে আমরা দেখেছি, আর সম্প্রতি ২০২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থানে আমরা দেখলাম। ১৯৭১-এ আওয়ামীলীগ বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গেই ছিল; কিন্তু ২০০৯-২৪ তাদের বাড়াবাড়ির কারণে বাংলাদেশের মানুষ তাদেরকে বাড়ি দিয়ে বের করে দিয়েছে দেশ থেকে। তৌহিদি জনতা ২০২৪-এ বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গেই ছিল। কিন্তু ৫ আগস্টের পর তারা ক্ষমতার দাপট দেখাতে শুরু করেছে; সব শেষ তারা বাড়াবাড়ি করছে একজন কবি ও শিক্ষাবিদ গালিবের সঙ্গে।
বিনীত অনুরোধ করছি পেশী শক্তি ও মাস্তানির পথ পরিহার করে শান্তির পথে আসতে। বিদ্বেষ-বিভাজন-মাস্তানি-গ্যাংবাজির সমাজ আমরা আর দেখতে চাই না।
কারও বাড়াবাড়ি, মাতবরি, গায়ের জোর খাটানোর কারণে জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পাওয়া সার্বভৌম বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যদি অবনতি ঘটে; সেই সুযোগে পতিত আওয়ামীলীগ তার অভিভাবক ভারতকে নিয়ে যদি আবার ছায়া উপনিবেশ গড়তে আসে; বুঝব দেশ ডাকাত আওয়ামীলীগের টাকার কাছে বিক্রি হয়ে মুজিব কোট খুলে মাথায় সাদা টুপি দিয়ে একদল লোক আমাদের বিপদে ফেলতে এসেছে।
বাংলাদেশকে যে ভালোবাসে; সে আর যাই হোক ৫ আগস্টের পর মাস্তানি করে বেড়ানোর কথা নয়। আইনের শাসন ও সভ্যতার প্রতি অকুন্ঠ আস্থা ছাড়া কেউ সুনাগরিক হতে পারে না।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন