নাবিস্কো বিস্কুট ও একজন লোকমান 'ফোরম্যান'

৯৭৯ পঠিত ... ১৬:৫৯, মে ২৭, ২০২৩

349244217_542550578045437_8063520948830665391_n

আমি মনে করতাম 'ফোরম্যান' অনেক বড় একটা পদ।

আমার বাসার কাছেই নাবিস্কো বিস্কুট ফ্যাক্টরি। যারা সাতরাস্তা থেকে মহাখালী পর্যন্ত নিয়মিত যাওয়া আসা করেন তারা জানেন, কখনও কখনও এই রাস্তায় বিস্কুট তৈরির সময় বেকিংয়ের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।

আমার ছোটবেলার একটা অংশ দখল করে আছে ওই ঘ্রাণ। ওই গন্ধ পেতাম আর ভাবতাম স্বর্গের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি।

এইরকম এক দিনে স্বর্গের দরজা খুলে গেল। এক ভদ্রলোক ফ্যাক্টরির ভেতরে যাচ্ছিলেন। স্কুল ড্রেস পরা আমাকে দেখে বললেন, ‘ভিতরে যাইবা? ভূক লাগছে?’

ভূক কাকে বলে আমি জানতাম না, দুই অর্থেই। অতি সাধারণ এক মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়েছি, প্রাচুর্য কখনও ছিল না। কিন্তু অনাহারে থাকিনি কখনও। কাজেই ক্ষুধার কষ্ট কী তখনও জানি না। আর ভূক শব্দটাই আমার অপরিচিত ছিল।

যাই হোক, আমার ইতস্তত ভাব দেখে ভদ্রলোক বললেন, ‘আহো। বিস্কুট খাইবা?’

আজ ভাবতে অবাক লাগে, কী করে অপরিচিত এক লোকের ডাকে অপরিচিত এক ফ্যাক্টরির বড় গেটের কোনায় ছোট পকেট ডোর দিয়ে ঢুকে গেলাম। অথচ, যে কোনো শিশুকে আমি এর উল্টোটাই করতে বলবো, অপরিচিত কেউ লোভ দেখালে খবরদার যাবা না।

তেজগাঁয়ের ফ্যাক্টরিগুলার একটা কমন বৈশিষ্ট্য আছে। দীর্ঘ প্যাসেজ একেবারে দুনিয়ার শেষ মাথা পর্যন্ত।

ভেতরে ঢুকেই ডানদিকে কয়টা প্যাসেজ পার হলাম মনে নেই আর আজ। গিয়ে দেখলাম সেই স্বপ্নের লাইন। মেশিন চলছে। গোটা দুনিয়া জুড়ে শো শো আওয়াজ। একেবারে ঘোর লাগা পরিবেশ। তার মধ্যেই নাবিস্কো পাইনঅ্যাপল ক্রিম বিস্কুট সারিবদ্ধভাবে বের হচ্ছে ওই ছাদ সমান উঁচু বিশাল মেশিনের ভেতর থেকে। অথবা অতো বড় নয়, ওই হাফপ্যান্ট পরা শৈশবে ওটাকেই বিশাল মনে হয়েছে হয়তো।

ভদ্রলোক বললেন, ‘ওইখান থিকা নিয়া খাও।‘

এতো বিস্কিট আমি জীবনে দেখিনি। আমার শৈশবে দেখা বিস্কিট মানে হচ্ছে, বাসায় মেহমান এলে ট্রের ওপর কয়েক কাপ দুধ চা আর তার পাশে হাফ প্লেটের ওপর প্যাকেট খুলে রাখা ১৫-২০টা বিস্কিট। মেহমান বিদায় নেওয়ার পর সেখান থেকে খেতে পেতাম।

আর এখানে রাজ্যের সব বিস্কিট পরে আছে, চাইলেই খেতে পারি। যত খুশী। যত খুশী। যত খুশী।

‘তাড়া নাই, খাও আব্বা। আর কেউ জিগাইলে আমারে দেখায়া দিও। বলবা, ফোরম্যান লোকমানের গেস্ট!’

সেই প্রথম আমি জানলাম, ফোরম্যান নামে একটা পদ আছে। বিশাল এক পদ। এরা চাইলেই দুনিয়ার সব বিস্কিট দিয়ে দিতে পারে! কী আশ্চর্য!

কতোগুলা বিস্কিট খেয়েছিলাম আজ আর মনে নেই। কেবল মনে আছে ভদ্রলোক বলেছিলেন, ‘আবার খাইতে ইচ্ছা হইলে চইলা আসবা। বলবা ফোরম্যান লোকমানের গেস্ট।‘

‘এইখানে যত খুশি খাইতে পারবা, কিন্তু বাইরে নিতে পারবা না।‘

আমার ছোটবেলায় যতোগুলো অসম্ভব আনন্দের স্মৃতি আছে আর মধ্যে একটি এই ফোরম্যান লোকমানের তৈরি করা।

তিনি কি জানতেন, গোটা জীবনের জন্য একটা আনন্দের স্মৃতি তিনি তৈরি করে দিচ্ছেন এক অপরিচিত শিশুর মনে?

এই একুশ শতকে এসে আমরা আমাদের পরিবারের শিশুদের জন্য প্রায় সবাই প্রাচুর্যের যোগান দেওয়ার চেষ্টা করি। তারপর যে বিষয়টা শিশুরা পছন্দ করে, দিনের পর দিন সেটাই দিতে থাকি।

শিশু মনে দাগ কাটার জন্য আসলে পয়সা তেমন একটা লাগে না। দামি রেস্তোরাঁ লাগে না, ব্র্যান্ডেড আইটেম লাগে না। যেটা লাগে সেটা হলো তাদের কল্পনা শক্তির সীমানা বাড়িয়ে দেওয়া, স্বপ্ন দেখার পথ খুলে দেওয়া।

স্বল্প শিক্ষিত ফেরম্যান লোকমান সম্ভবত বিষয়টা জানতেন।

 

৯৭৯ পঠিত ... ১৬:৫৯, মে ২৭, ২০২৩

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top