দেশটা আসলে কার?

৩৮ পঠিত ... ৪ ঘন্টা ১০ মিনিট আগে

19 (5)

অফিস থেকে নিচে নেমেছিলাম আইসক্রিম কিনতে। রাস্তা পার হলাম। তারপরই মানুষের ভীড়ে মিশে গেলাম। এমনিতে জায়গাটায় অনেক বেশি মানুষ থাকে এমন না। আজকে আছে।

এত মানুষের কারণ কী? একটু কান পাততেই কারণ পরিষ্কার হলো। দুজন মানুষ ঝগড়া করছে। আর অন্তত একশ মানুষ চারপাশে ভীড় করে দেখছে। তা দেখুক। গণতান্ত্রিক দেশ, কারোর ক্ষতি না হলে, যার যেটা ইচ্ছে বলার, যার যেটা ইচ্ছে দেখার অধিকার আছে।

সবার মতো আমিও দাঁড়িয়ে পড়লাম। কিন্তু যা শুনলাম, তারা র‍্যান্ডম যেমন শুনি ঝগড়ায়, তেমন করে বলছেন না।

একজন বলছেন, এই দেশ এখন থেকে ইসলামি আইন অনুযায়ী চলতে হবে। আপনি আমাকে না করতে পারেন না।

আরেকজন ট্রাফিক কনস্টেবলের ইউনিফর্ম পরা। তিনি জবাব দিলেন, আমি রাষ্ট্রের কাজ করছি। আপনি আমার কাজে বাধা দিতে পারেন না।

ব্যাপার হলো, দুটাই এমন যুক্তি, উপস্থিত জনতা কোন দিকে যাবে বুঝে উঠতে পারছে না।

আমি ভীড় পার হয়ে সামনের মুদি দোকানে ঢুকে গেলাম। একটা কোন আইসক্রিম কিনলাম, তারপর তাড়াতাড়ি অফিসের পথে পা বাড়ালাম। আইসক্রিম গলে গেলে সমস্যা।

ভীড় দেখলাম আরও বেড়েছে। প্রথম ব্যক্তি জোর গলায় বললেন, আল্লাহু আকবর। উপস্থিত জনতা স্বর মেলাল, আল্লাহু আকবর।

ট্রাফিক কনস্টেবল বললেন, আল্লাহু আকবর কি আপনার একারই স্লোগান নাকি। উনিও উঁচু স্বরে বললেন, আল্লাহু আকবর। জনতা তার সাথেও স্বর মেলাল। আমি পা চালিয়ে চলে আসলাম। আইসক্রিম গলতে শুরু করেছে।

ব্যাপার হলো, ঘটনা শুধু এখানেরই না। দেশের প্রায় সব জায়গাতেই দেখা যাচ্ছে মানুষ হুট করে উত্তুঙ্গ হয়ে উঠেছে। এমন না যে সহিষ্ণু জাতি হিসেবে আমাদের খুব সুনাম। ইতিহাসের বিভিন্ন পরত ঘাটলে দেখা যায় বাঙালি বিভিন্ন সময়ে অত্যাচার-নিপীড়নের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে, অন্যান্য জাতির আগেই উঠেছে। অবশ্য এটাও সত্য যে বৃটিশরা স্বাধীনতার সূর্যটা এখানেই আগে নিভিয়েছিল। সেটা অবশ্য অন্য আলাপ।

যেটা আলাপ করছিলাম, আমরা সহিষ্ণু জাতি না কথা সত্য—কিন্তু কী এমন হলো যে কথায় কথায় আমরা ফুঁসে উঠছি? কথায় কথায় আমাদের দাবী আদায়ে আমাদের রাস্তা ব্লক করতে হয়, রক্তপাত ঘটাতে হয়? উত্তর যেটা সবচেয়ে সরল—প্রবল স্নায়ুক্ষয়ী জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অ্যাড্রেনালিন রাশ। সেটাই স্বাভাবিক। আমাদের প্রায় প্রতিটা মানুষের জুলাই মাসটা এক অবিস্মরণীয় জার্নিতে কেটেছে। এই যাত্রা ক্ষোভের, দুঃখের, গর্বের, আনন্দের, প্রাপ্তির। এই অ্যাড্রেনালিন রাশ ঠিক একদিনে নেমে যাবে এটা হওয়ার নয়।

তারপরও এটাই সম্ভবত সবচেয়ে বড় কারণ নয়। তাহলে কোনটা? সেটা বলার আগে কয়েক লাইনে একটু পটভূমিকা বলা দরকার।

সদ্য গদিহারা ফ্যাসিস্ট সরকার এমন না যে ক্ষমতায় বসার প্রথম দিন থেকেই, অর্থাৎ ১৬ বছর আগে গদিতে বসার পয়লা দিন থেকেই ফ্যাসিজম শুরু করেছে। একটু একটু করে দিন গিয়েছে, ধীরে ধীরে তার ফ্যাসিজমের মাত্রা ততোই বেড়েছে। কিছু মানুষ প্রথমে সরকারের কাজকর্মে বিরক্ত হওয়া শুরু করল, বিরক্ত প্রকাশ করাও শুরু করল। হ্যাঁ, তখন বিরক্ত হলে প্রকাশও করা যেত! ফলে সরকারের দমন-পীড়ন চলল তাদের ওপরই। ধীরে ধীরে সরকার যখন দমন-পীড়ন-স্বেচ্ছাচারীতার মাত্রা বাড়াল, আরও বেশি মানুষ তাতে ক্ষতিগ্রস্থ হলো। প্রতিবাদ হলেই অ্যাকশন। একটা সময় দেখা গেল আওয়ামীলীগের একেবারে নিজস্ব লোক আর তাদের সুবিধাভোগী ছাড়া আর সকলেরই একটা পরিচয়। তারা অত্যাচারিত। এবং তাদের কোনো ভাষা থাকতে নেই।

ফ্যাসিজমের এই এক গুণ, সবাইকে নিঃশেষ করতে গিয়ে তারা সবাইকে এককাট্টা করে ফেলে। ফলে কোটা আন্দোলন যখন সরকার পতনের আন্দোলনে গড়ায়, এ এক অভূতপূর্ব বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। এখানে সবার পরিচয় এক; এন্টি আওয়ামীলীগ। এবং বেশিরভাগকেই এই এন্টি পজিশনে আওয়ামীলীগই নিয়েছে।

ফলে, এই যে বিজয় হলো ৫ আগস্ট, এক কথায় এই জয় জনতার বিজয়। শুনতে ভালোই লাগে, এবং কথা সত্য। কিন্তু একইসাথে সত্য হলো এই জনতা আসলে এক না। আওয়ামীলীগই তাদের বাধ্য করেছিল এক হতে। বিজয়ের আনন্দ একসাথে হলো, তারপরই সবার স্বতন্ত্র স্বত্তা দেখা দেওয়া শুরু করল। আমরা দেখলাম কে বিএনপি, কে জামায়াত, কে বাম, কে চাকরিজীবি, কে আনসার, কে ব্যাটারি রিকশা, কে এটা, কে সেটা। এই পৃথিবীতে কোনো না কোনো পরিচয় সবার থাকবেই; কিন্তু আমাদের সবার মনে হওয়া শুরু করল এই বিজয় আমাদের ব্যক্তিগত বিজয়, এবং আমি যে পরিচয়টা বিলং করি; সেই পরিচয়ের বিজয়।

তাত্ত্বিকভাবে কথাটা শুনতে বেশ ভালো। কিন্তু প্র্যাকটিক্যালি যেটা হচ্ছে, আমাদের প্রত্যেকের আচরণ দাঁড়াচ্ছে বিজয়ীর আচরণে, এবং আমাদের আচরণে বাকি সবাইকে মনে হচ্ছে পরাজিত যুদ্ধবন্দী। আরেকভাবে বললে, আমাদের প্রত্যেকের আচরণ এখন জমিদারের সন্তানের মতো। আমার এটা চাই, এক্ষন চাই। কী... পাওয়া যাবে না? আটকাও রাস্তা, ভাঙো সবকিছু!

যে লক্ষণগুলোর কথা বলছি, দেশের সবাই কি এতে আক্রান্ত? উঁহু, খুব কম। ধরেন যে রাস্তার একশজনের ভীড়ে দুইজন, ওই সেই ঝগড়া করা দুজনের মতো সংখ্যা। বাকিরা ভীড় করে দেখতে থাকা লোকজন। যাদের কাজ দেখে যাওয়া।

এই যে ব্যাপক বিশৃঙ্খল, ক্যাওস… সেটার সমাধান আসলে কোথায়? সংস্কারে? নাকি ইলেকশনে? খুব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছি। প্রচুর মূল্য দিয়ে বা না দিয়ে, ইউসুফ সরকার আসলে কোন পথে আগায়।

 

 

৩৮ পঠিত ... ৪ ঘন্টা ১০ মিনিট আগে

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top