সারা তুখোড় ছাত্রী ছিল। ক্রিকেটের মাঠে একজন অলরাউন্ডার ঠিক যেমন; তেমনি তার জীবন। বিসিএস পরীক্ষায় না বসে সিদ্ধান্ত নেয় মিডিয়ায় কাজ করবে। সেখানে তুখোড় মিডিয়া কর্মী হয়ে ওঠে। এরপর সে উদ্যোক্তা হতে চেষ্টা করে; সুতরাং সাফল্য এসে যায়। আমাদের সমাজে যেটা হয়; একটা মেয়ে যতই মেধাবী হোক, এবাভ অ্যাভারেজ হোক; তার মা যতই শিক্ষিতা ও সংস্কৃতিবতী হন; মেয়ের কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর করেন, এবার একটা বিয়ে করো। এ কারণেই টমাস গ্রে'র এলিজি রিটেন ইন আ কান্ট্রি চার্চইয়ার্ড কবিতার মতো, আমাদের কবরস্থানগুলোতে ঘুমিয়ে থাকে মাদাম কুরী, ভ্যালেন্টিনা টেরেসকোভা, ভার্জিনিয়া উলফ; যারা জীবন বিকাশের সুযোগ পায় না। উদয়াস্ত সংসারের ঘানি টেনে সমস্ত সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটিয়ে ধূলোয় মিশে যায় তারা।
সারা মিতভাষী, ফলে মায়ের মুখের ওপর জিজ্ঞেস করতে পারে না, আচ্ছা আম্মা, আপনি এই বিয়েটা করে কোন পৃথিবী জয় করলেন। এই যে ছোটোবেলা থেকে চাইলেন পড়ালেখায় তুখোড় হতে হবে; বিতর্ক করতে হবে, আত্মনির্ভরশীল হতে হবে তা কেন! আরেকটা বাড়িতে গিয়ে রান্নার হাঁড়ি ঠেলার জন্য, নাকি প্যাম্পারস বদলানোর জন্য, কারও স্পয়েল্ট ব্র্যাট ছেলের মুড সুইং ম্যানেজমেন্টের জন্য। একটা মেয়ের জন্মই কি হয় হয়, স্বামীর হাসিতে হাসার তার কান্নায় কাঁদার জন্য। আচ্ছা আম্মা, আপনারও একটা কবিতা লেখার খাতা ছিল, সেটা কোথায় লুকিয়ে ফেললেন।
এই সমাজের অ্যাভারেজ পুরুষ যে বিউটি উইদাউট ব্রেনের ভক্ত; তার জন্য তাহলে এমন ব্রেন উইথ বিউটি করে গড়ে তুললেন কেন!
যে সমাজের পুরুষ পঞ্চাশের পর জামার একটা বোতাম লাগাতে ভুলে যায়, পাতলুনের জিপার আটকাতে ভুলে যায়, ট্রেন ও বাস স্টেশনে কনফিউজড হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, রাস্তা পার হতে নার্ভাস হয়ে যায়, তাকে হাত ধরে রাস্তা পার করতে হয়; আর বাসায় ফিরলেই বেলারুশের লুকেশেংকোর মতো ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠে; তার সঙ্গে নিজের মেয়ের ভবিষ্যৎ দেখছেন কী করে! তাহলে এত ক্লাসে ফার্স্ট না করে, বিতর্ক না করিয়ে স্বামী গরবে গরবিনী ললিতা কিংবা আনারকলি করে রাখতেন, নিদেনপক্ষে তাঁবু সজ্জিত রাবেয়া। সারা বানাতে কেন গেলেন। তাকে কেন মেডিয়েভ্যাল ট্র্যাশ নিতে হবে!
আইরন লেডি সারা আয়রন কার্টেন ভেঙে ফিরে আসে সেপারেশন নিয়ে। অ্যাভারেজ থেকে মুক্তি নিয়ে আবার এবাভ অ্যাভারেজ জীবনের খোঁজ করতে থাকে। অল রাউন্ডার হলে যা হয়, বাচ্চাটাকেও একটা আনন্দময় জীবন দেয়; যে স্কুল থেকে ফিরে মায়ের জুম মিটিং-এ ঢুকে পড়ে বাঁশি বাজাতে বাজাতে।
সারা দেখতে সুন্দর, বাংলা ও ইংরেজি দুটো ভাষাতেই সাবলীল, পোশাকে নান্দনিক ও ছিমছাম। ক্লিভেজ দেখিয়ে যারা কেরিয়ারের দৌড়ে চ্যাম্পিয়ন হতে চায়; তাদেরকে পিছে ফেলে সে এগিয়ে যায় তার পরিশীলিত জীবন চর্যা নিয়ে। ফলে কর্ম ক্ষেত্রে যেসব লোক নারী দেখলে চনমনিয়ে ওঠে, বাক বাকুম করে ব্যর্থ কৌতুক করে; তারা সারাকে দেখলেই মনে মনে গায়, বাঁচকে রেহেনা রে বাবা, বাঁচকে রেহেনারে রে। সারার ব্যক্তিত্বকে অতিক্রম করার সাহস পায় না কেউ।
কিন্তু মুশকিল হয়ে যায় কোনোমতে একটা স্বামী ফিশিং করে স্বামীর টাকায় এলিট হয়ে ঘোরা ললিতা ও আনারকলিদের নিয়ে। তারা ইনসিকিউরিটিতে ভুগে, এই যে তারা ওয়েস্টার্ন আউটফিট পরে, ভুল ইংরেজি বলে, নানানরকম অ্যাফলুয়েন্স প্রদর্শনী করে স্বামীর সামনে ক্লিওপেট্রা হয়ে ঘুরছে; এরা যদি কখনও সারার সঙ্গে কথা বলে, তাহলেই তো বুঝে যাবে ভালো ছাত্রী ও খারাপ ছাত্রীর পার্থক্য, অলরাউন্ডার ও চিয়ারলিডারের পার্থক্য।
মানুষ যা ভয় পায়, ঠিক তাই ঘটে তার জীবনে। এক অফিশিয়াল মিটিং-এ সারার সঙ্গে ললিতাদির হাবির দেখা হয়। সেখানে আরও সব প্রফেশনালরা উপস্থিত। সারার প্রফেশনালিজম দেখে ইমপ্রেসড হয় মিস্টার ললিতা। বাসায় গিয়ে বলে, আজ সারা নামে একজনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, কী চৌকষ একটা মেয়ে, প্রফেশনাল, বাই লিঙ্গুয়াল। ভাবতেই ভালো লাগে আমাদের দেশে এমন অল রাউন্ডার মেয়ে তৈরি হয়েছে।
মিসেস ললিতার মুখের হাসি মিলিয়ে মুখমণ্ডল পোড়া বেগুনের মতো হয়ে যায়। স্কুলের ইংরেজি ক্লাসে ফাঁকি দেবার কষ্টটা বুকে এসে লাগে। অকারণে কিচেনে গিয়ে একটা আচারের বোতল ভেঙে ফেলে। শুরু হয় মুড সুইং। ঘর অন্ধকার করে রবীন্দ্র সংগীত শোনে। এরপর মিস্টার ললিতা বাসার বাইরে গেলেই পনেরো মিনিট পর পর ফোন করে তাকে, এই তুমি এখন কোথায়! স্বামীর ফোনে লোকেশান জানার সফটওয়্যার ঢুকিয়ে দেখতে চেষ্টা করে, ওর গাড়িটা কোন দিকে গেল। সারার বাসা কিংবা অফিসের রেডিয়াসের মাঝে গাড়িটা দেখা গেলেই ফোন করে, কি সারার সঙ্গে ইটিশ পিটিশ করো নাকি! মিস্টার ললিতা উত্তর দেয়, তুমি তোমার এই মুরাদ টাকলা স্বামী নিয়ে যতটা বেচায়েন, অন্য কেউ কি তা হবে, আমি তো কেভিন কস্টনার না। তোমার পাগলামি বন্ধ করো ললিতা।
কিন্ত ললিতার পাগলামিটা বাড়তেই থাকে। যথারীতি ফেসবুকের কলতলায় পোস্ট দেয়, উঁহ আমার প্রফেশনাল উইমেন! চিনি চিনি, পুরুষের মাথা খাওয়ার যম এইগুলি।
অষ্টাদশ শতকের কলতলায় এসে পড়ে দল মত নির্বিশেষে, আনারকলি-রাবেয়া, সহমত-শিবব্রত-শরিয়ত। আনারকলি উস্কানি দেয়, দেও না মুখোশ উন্মোচন কইরা। রাবেয়া এসে চুক চুক করে বলে, এই জন্য একটু পর্দা পুসিদা করে চলতে বলি নারীদের। সহমত হুঙ্কার দেয়, নিশ্চয়ই লাল বিপ্লবী কোনো মাইয়া; আমগো চেতনার দুলাভাইয়ের পিছে লাগছে। শিবব্রত তখন রামায়ণের গল্প বলে, সীতা যদি লক্ষ্মণরেখার বাইরে না যেত; তাহলে তো এতসব লংকাকাণ্ড হতো না। শরিয়ত আদেশ দেয়, নারী ঘরের শোভা। সে কেন কর্মক্ষেত্রে যাবে!
আমাদের সমাজ এমন একটি সমাজ, যেখানে লোকজন বন্ধু হয়ে আপনার পয়সায় চা-কফি-কাচ্চি-শিঙাড়া খাবে, রিকশায় চড়বে, মাঝে মাঝে টাকা ধার করবে, গাড়িতে নিয়মিত লিফট নেবে, ফেসবুকে আপনাকে বেস্ট ফ্রেন্ডের মর্যাদা দেবে; কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে আপনার ডুমস ডে'র জন্য অপেক্ষা করবে। আপনাকে কথায় কথায় পকেট থেকে পয়সা বের করতে দেখে আসলে সে ঈর্ষা পুষেছে মনের গহীনে। সে আপনার আর্থিক অনটন, সুনামহানি ও অপমান দেখার নেশা নিয়ে ঘুরছে।
এরকম কেউ কেউ, যারা সারাকে দেখলেই আপা কফি খামু বলে আবদার জুড়ত, তারা সুযোগ বুঝে ললিতার পোস্টে গিয়ে মন্তব্য করে, আমি তারে অনেক দিন ধইরা চিনি। তার ক্যারেক্টার ঠিক নাইকা।
সারা এইসব কলতলা কালচারের সঙ্গে অপরিচিত। তার অবাক লাগে, একবার একটা লোকের সঙ্গে একটা মিটিং-এ এত লোকের সামনে দেখা হলো, অথচ তার স্ত্রী রীতিমতো গোবর ছুঁড়ছে।
সারা ফেড আপ হয়ে পড়ে এসব উটকো ঝামেলায়। সে নিজের কাজ করে শেষ করতে পারে না; অথচ তাকে নিয়ে ডেসপারেট হাউজওয়াইভসের কী কলতলামাতম।
অফিসের কাজে আমস্টারডাম থেকে ফোন করে ড্যানিয়েল। সে একটা সুখবর দেয়, তাদের প্রতিষ্ঠান সারার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একটা যৌথপ্রকল্প করবে। কাজটা কর্মহীন হাউজওয়াইফদের ঘরে বসে কিছু কাজ করার সুযোগ সৃষ্টির। সারাকে খানিকটা অফ দেখে ড্যানিয়েল জিজ্ঞেস করে,
: ইজ এভরিথিং ওকে!
: নাথিং ইজ ওকে, অফিসের কাজে মন দিতে পারছি না। সাইবার বুলি সামলাচ্ছি।
: ইগনোর ইগনোর, বি আ ম্যান সারা!
সারা হেসে ফেলে। তারপর সে আ কিউরিয়াস কেস অফ ললিতা সম্পর্কে বলে।
ড্যানিয়েল শুনে অনেকক্ষণ হাসে, আমাদের প্রকল্পটা কতটা জরুরি তা বোঝা গেল। ললিতাদের ব্যস্ত থাকতে হবে। জবলেস ব্রেন ইজ আ গসিপ ফ্যাক্টরি।
: কিন্তু বটম লাইন হলো, আমাদের সমাজে একটা মেয়ের স্বামী না থাকলেই, স্বামী গরবিনীরা সেই মেয়েকে থ্রেট বলে মনে করে।
: ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের পর নতুন ধনীদের বিশ্রামেহত স্ত্রীরাও এমন ছিল। সারাদিন তারা গসিপ করে বেড়াত আর এফলুয়েন্স শো অফ করত।
: আমাদের তো দুর্নীতি বিপ্লব, কর্পোরেট বিপ্লব আর এনজিও বিপ্লব হয়েছে; শিল্প বিপ্লব তো হয়নি। তবে ডেসপারেট হাউজ ওয়াইফ আছে দলে দলে; ফেসবুক তাদের এফলুয়েন্স আর স্বামী গৌরব প্রকাশের শোকেস।
ড্যানিয়েল বলে, এই ডেসপারেট হাউজওয়াইফেরা তোমার একটা স্বামীর নাম চায়। স্বামী আসলে একটা নামই। ইন্ডেপেন্ডেন্ট মেয়েদের জন্য এর বেশি কিছু নয় সে।
ফোন রেখে সারা ঠিক করে, মাদার ইন ম্যানভিলের মতো সে এক কাল্পনিক স্বামীর গপ্পো বানাবে। মানুষ আসলে ফিকশন চায়। এই যে পলিটিকস, রেলিজিওন, ডেভেলপমেন্ট, রেভোলিউশন; এ সবই তো ফিকশনাল ব্যাপার। সবচেয়ে বড় ফিকশন হলো হাজব্যান্ড।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন