২০১১ সালে আরব বসন্তে সিরিয়ায় শান্তিপূর্ণ বিপ্লব সূচিত হয়। সেসময় সিরিয়ার নয়নের মণি উন্নয়নের রুপকার বাশার আল আসাদ সিরিয়ার স্বাধীনতার বন্ধু রাশিয়ার সহযোগিতায় প্রায় পাঁচ লাখ স্বাধীনতার শত্রু খতম করেন। দেশ থেকে উচ্ছেদ হয়ে যায় অসংখ্য মানুষ; যারা আসাদের উন্নয়নের শত্রু ছিল, তীব্র সমালোচক ছিল। সেই থেকে চিরবন্ধু রাশিয়া আর ব্যবসা বন্ধু ইরানের সহযোগিতায় আসাদ তার অবস্থান সুসংহত রেখে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সিরিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। অর্থনীতির প্রতিটি সূচকে সংখ্যার অপূর্ব সব পরিসংখ্যান রচনা করে সিরিয়ার পরিসংখ্যান ব্যুরো।
দামেস্ক শহরে এক শোকরানা মেহেফিলে হিজবুল্লাহ আসাদকে কওমি জনক উপাধি দেয়। ইহুদি-খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদ সংখ্যালঘুদের ঘরে ঘরে গিয়ে আসাদকে মুসা ও যিশুর সঙ্গে তুলনা করে। দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি বিবৃতি দিয়ে আসাদকে আহবান জানায় উন্নয়নের শত্রুদের প্রতি জিরো টলারেন্স দেখাতে। দামেস্কের সাংবাদিকেরা ‘প্রশ্ন নয় প্রশংসা করতে এসেছি’ অনুষ্ঠানে বলে, মাননীয় সিরিয়ারত্ন, আপনি আন্তর্জাতিক হয়ে পড়ছেন, আমরা কি আগের মতো আপনাকে আর পাব! আসাদ উত্তরে বলেন, এমেরিকার দিকে নজর রাখুন, কারা কারা এমেরিকার দূতাবাসে ঘোরাঘুরি করে তাদের তালিকা দেন।
এমেরিকার ব্যাপারে উষ্মা প্রকাশ করলেও আসাদের মন্ত্রীসভার সদস্য, বাথিস্ট মুভমেন্টের সহ সভাপতি ও অনুগত আমলারা এমেরিকাতেই গড়ে তুলতে থাকে তাদের সেকেন্ড হোম। আসাদভক্তরা শুধু আসাদকে ভক্তিতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; তার পিতা হাফিজের সমাধিতে কেঁদে লুটিয়ে পড়েছে অবিরত। যে যেখানে পারে হাফিজের মূর্তি গড়েছে। বুদ্ধিজীবীরা হাফিজকে নিয়ে লিখেছে হাজার হাজার গ্রন্থ।
সিরিয়ার সংস্কৃতি মামা ও খালারা আসাদের রাজকীয় প্রাসাদে গিয়ে গান গেয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে আসতে শুরু করে। রাষ্ট্রীয় ও দলীয় অনুষ্ঠানের কেক-পেস্ট্রি খেয়ে খেয়ে সংস্কৃতি মামা ও খালারা ক্রমশ পৃথুল হয়ে পড়তে থাকে।
মাঝে মাঝেই বিদ্রোহীদের নানা হামলায় আসাদের সোনার সংসারে ঝড় উঠলে বুদ্ধিজীবীরা পরামর্শ দেয়, ইসলামি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতে। মুসলিম নিধনে অত্যন্ত আগ্রহী রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি এই কাজে আসাদকে সাহায্য করতে থাকে। সোশ্যাল মিডিয়ায় তখন ইহুদি খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ চিয়ার লিডার হিসাবে গান গাইত, সন্ত্রাসীরে ডিম দেও ওরে; অরে নিয়া অস্ত্র উদ্ধারে যাও।
এই তো দুদিন আগেও আসাদ নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে বলেন, ইসলামি সন্ত্রাসবাদী দমনে আমাদের সাহায্য করুন। ট্রাম্প তাকে হতাশ করে বলেন, এ ছাড়াও আমার অনেক কাজ আছে।
এরপর আচম্বিতে কোথা থেকে কখন যে কী হয়ে গেল; জনতার বিদ্রোহের মুখে আসাদ পালিয়ে গেলেন মস্কোতে। বিপ্লবীরা বিনা বাধায় দামেস্ক দখল করে নেয়। আসাদ সেনাবাহিনীকে বিপ্লব দমন করতে বললেও তারা দেশের মানুষের ওপর গুলি চালাতে রাজি হয়নি; বরং বুঝিয়ে শুনিয়ে তাকে প্রাইভেট জেটে তুলে দেয়। আসাদেরই পুতুল প্রধানমন্ত্রী বিপ্লবীদের বশ্যতা স্বীকার করে বলেছেন, তোমরা একে একে এস, তোমাদের চুপটি করে মন্ত্রীর শপথ পাঠ করাব।
বিপ্লবীরা আসাদের প্রাসাদে ঢুকে সোফা, কার্পেট, শো পিস, সুপারম্যানের আন্ডারওয়ার সবকিছু লুট করে নিয়ে যায়। প্রাসাদের চিড়িয়াখানা থেকে লুট করে সুদৃশ্য হরিণ, চিতা বাঘ ও ঈগল।
সোশাল মিডিয়ায় শুরু হয় আসাদভক্তদের আহাজারি, বিপ্লবীদের তো দাড়ি আর দাড়ি, এইসব জিহাদিস্ট সিরিয়াকে আফঘানিস্তান বানাবে। সাজানো গোছানো সিরিয়াকে তোমরা শেষ করে দিলে। যেসব লিবেরেল এখন লাফাচ্ছে, তারা দুইদিন পরেই বুঝতে পারবে।
লিবেরেলরা উত্তর দেয়, ২০১১ সাল থেকে সিরিয়ার লাখো মানুষকে উচ্ছেদ করা হয়েছে; তারা শরণার্থী হয়ে দেশে দেশে তাঁবুতে বাস করে। ফুলের মতো শিশুরা এখন ইউরোপের পথে পথে ভিক্ষা করে; এর চেয়ে খারাপ আর কী হবে! সিরিয়া নিয়ে এত চিন্তা না করে বরং নিজেদের চর্বি বাঁচাও।
মস্কোর আর টি টিভির উপস্থাপক ময়ূখভ ঘোষস্কি শুরু করে সিরিয়া ট্রান্সমিশন, হরকাতুল জিহাদিরা দখল করে নিল সিরিয়া, পুতিন কেন সেনা পাঠিয়ে তাদের ঠান্ডা করছে না। সিরিয়া থাকবে না। মুসলমান মানেই মৌলবাদি; তারা খ্রিস্টানদের ওপর হামলা করছে; খ্রিস্টানদের বাঁচান।
আসাদ অনুসারী একশো মুসলমান আর নয় জন খ্রিস্টান আক্রান্ত হলে; আর টি টিভি হেডলাইন করে, খ্রিস্টানের রক্তে ভাসছে সিরিয়া। ভিডিও কলে যুক্ত করা এক খ্রিস্টান বলেন, কই আমাকে তো কেউ কিছু বলছে না। মুসলমান বলেন খ্রিস্টান বলেন, ধোলাই খেয়েছে আসাদের ভক্তরা; যারা অনেক চোটপাট দেখিয়েছে এতকাল; যাদের হাতে প্রায় পাঁচ লাখ সিরিয়ানের রক্ত।
ময়ূখভ ঘোষস্কি ধমক দেয়, দূরো জাতচ্যুত খ্রিস্টান, আমি বলি কী আর আমার সারিন্দা বাজে কোন সুরে।
এক বাথিস্ট পার্টির সংস্কৃতি খালা ভিডিও কলে যুক্ত হয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে, আমাকে ওরা মেরে ফেলবে; ওরা আসাদের ও পিতা হাফিজের মূর্তি ভেঙেছে। ওরা এদেশের স্বাধীনতার শত্রু। আমি তবু যাবো ভাঙ্গা মূর্তিতে ফুল দিতে দেখি কে ঠেকায় আমাকে।
সংস্কৃতি মামা ও খালারা একটু পর পর ফেসবুকে আর্তনাদ করে, ডাকাতি হচ্ছে, পুলিশ হত্যা হচ্ছে, লিপস্টিক পরা মেয়ে পথে দেখলে দাড়িওয়ালারা লিপস্টিক মুছে ফেলতে বলছে।
রয়টার্সের আগাথা পল আর্টিকেল লিখে ফেলে, সেকুলারিজমের স্ট্যাচু ভেঙে ইসলামিস্টের বর্বর উল্লাস। পরে জিভ কেটে সংশোধনী দেয়, বিপ্লবী লিবেরেলরা ফ্যাসিজমের স্টাচু গুড়িয়ে দিয়েছে।
এসব কী হচ্ছে, আগেই ভালো ছিলাম এইসব পরাজিতের ক্রন্দনের মাঝে দেবশিশুরা পথে পড়ে থাকা আসাদের মূর্তির ছিন্ন মস্তকে উষ্ণ প্রস্রবণ ঘটায়।
আসাদের পিতা ষাট বছর আগে দখল করেছিলেন সিরিয়ার ক্ষমতা; সে কারণেই আসাদ সবসময় সিরিয়াকে তার বাপের দেশ বলে বর্ণনা করতেন। মস্কোর সামরিক গেস্ট হাউজে বসে বিষণ্ণ আসাদ ফোন করেন দামেস্কে। এক বাথিস্ট সহ সভাপতি ফোন ধরলে বলেন, দুঃশ্চিন্তা করো না; আমি সীমান্তের আশেপাশেই আছি; টুপ করে ঢুকে পড়ব দেশে।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন