স্বাধীন বাংলাদেশে বেশ কয়েকজন কৃতি মানুষ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গড়ে স্বদেশ উন্নয়নে অবদান রেখেছেন। ফরহাদ মজহার তাদের একজন। সেই উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের একটি পোশাক বিক্রির শো রুম থেকে নিয়মিত খাদির শার্ট কিনতে গিয়ে পোশাকের দাম দেখে মনে হতো; এই ভদ্রলোক ব্যবসা করতে এসে সীমিত আয়ের মানুষের কথা মনে রেখেছেন। উনি ঢাকার অন্য কিছু পোশাক বিক্রি শো রুমের মতো ডলারের নিরিখে মূল্য নির্ধারণ করেননি।
এরপর একদিন ঐ শো রুমেই পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে গেলাম। সেখানে লালন সংগীত, কীর্তন, মুর্শিদী-মারফতি সবই ছিল। ফরহাদ মজহার এতটাই আতিথেয়তাপ্রবণ যে প্রত্যেক অতিথির কাছে জিজ্ঞেস করছিলেন, আয়োজন কেমন লাগছে। সেখানে মুড়ি-মুড়কি-বাতাসা-সন্দেশের আপ্যায়নের ব্যবস্থাও ছিল।
ফরহাদ মজহার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৭ সালে ঔষধশাস্ত্রে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন এবং পরবর্তীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দি নিউ স্কুল ফর সোশ্যাল রিসার্চ থেকে অর্থশাস্ত্রে ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সামাজিক অর্থনীতিতেও গবেষণা করেছেন। চিন্তা নামক একটি পত্রিকার সম্পাদক মজহার উবিনীগ এনজিও গঠন করে নয়াকৃষি আন্দোলনও শুরু করেন।
আমি ভদ্রলোকের চিন্তা প্রক্রিয়াকেও অনুসরণ করতাম। সত্তর দশকের যে তরুণ প্রজন্মটি সাম্যভিত্তিক সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে সমাজ বিপ্লবের স্বপ্ন দেখত তিনি তাদের একজন। তিনি বাংলাদেশে কৃষি সংস্কার করে কৃষকের ভাগ্য পরিবর্তনে নিরলস কাজ করেছেন। তার মানে তিনি কেবল পুঁথিপড়ুয়া বুদ্ধিজীবী নন; কৃষক ও কারিগরের ভাগ্য পরিবর্তনে নিজের সামর্থ্যের জায়গা থেকে সর্বোচ্চটুকু দিয়েছেন। এ সেই কৃষক ও কারিগর সমাজ; যাদের বিনাশ সাধন করেছিল বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসক ও তাদের স্থানীয় কোলাবরেটর জমিদারেরা।
১৯৮৩ সালে প্রকাশিত হয় তার কাব্যগ্রন্থ ‘আমাকে তুমি দাঁড় করিয়ে দিয়েছ বিপ্লবের সামনে।‘ এই কাব্যগ্রন্থ ফরহাদ মজহারের চিন্তাজগতের অন্তঃসলিল প্রবাহের সিগনেচার। তিনি প্রতিষ্ঠানের পদ-পদবীর ডোয়ার্ফ জীবন নয়; বেছে নিয়েছিলেন প্রতিষ্ঠান বিরোধী বিপ্লবীর জীবন।
মানবসভ্যতার চারুপাঠ হচ্ছে বয়সে বড়দের সম্মান জানানো আর বয়সে কমদের স্নেহ করা। আমরা যারা বাংলাদেশের বয়েসি তারা পরিবার, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ও সমাজ থেকে এই শিক্ষা পেয়েছি। এরপর পৃথিবীর পথে হেঁটে দেখেছি; প্রাচ্য ও প্রতীচ্য সব জায়গায় সেটাই নিয়ম।
গোপালগঞ্জের অভিনব কালচারে ২০০৯-১০ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিকশিত হলে দেখি; খুব সম্ভব দাক্ষিণাত্যের বর্গীদের অরিজিন কিছু তরুণ; যাদের কৃষক ও কারিগর পিতৃপুরুষের কল্যাণে ফরহাদ মজহার তার জীবন উৎসর্গ করেছেন; তারা ফরহাদ মজহারসহ সেইসব প্রবীণ যারা আওয়ামীলীগের সঙ্গে ইঞ্চি ইঞ্চি করে মিলিয়ে কথা বলছেন না; তাদের নিয়ে অশ্রাব্য সব কথা লিখছে। এদের নানি-দাদি অন্যের বাড়ির বেড়ার ফাঁকে ফুচকি দিয়ে পুকুরপাড়ে বা পাতকূয়াতলায় এসে যেভাবে অন্যের শয়ন কক্ষ নিয়ে বানিয়ে ছানিয়ে রগড় করত; ঠিক সেই আইডেন্টিক্যাল ল্যাঙ্গুয়েজে বেড রুম সিটিজেন জার্নালিজম করছে।
কারও কাব্য গ্রন্থ, দর্শন, প্রবন্ধ, কথাসাহিত্য, সাংবাদিকতার ভালো মন্দ নিয়ে কথা নয়; মনগড়া সব কথা বলে চরিত্রহননের অপচেষ্টা চলছে। ভাবখানা এমন যে দাক্ষিণাত্যের বর্গী অরিজিনের লোক জিন্স, টি-শার্ট পরে কফি খেয়ে স্ল্যাং বললেই সমাজ মুগ্ধ হয়ে তাদের কথায় আস্থা রাখবে। এরপর সেখানে এসে জুটল কিছু হিন্দুত্ববাদী; যারা আহমদ ছফা, জাফরুল্লাহ চৌধুরী, শফিক রেহমান, ফরহাদ মজহার, সলিমুল্লাহ খানকে নিয়ে কলতলার লাস্যে আঁকুপাকু করতে থাকে।
ফরহাদ মজহারের বিশাল বন্ধু বৃত্ত রয়েছে কলকাতায়; যাদের কারও কারও সঙ্গে আমার সখ্য রয়েছে। কলকাতায় যে ফরহাদ মজহারের এত সুনাম; তাকে নিয়ে বাংলাদেশে দুর্নাম গাইছে যারা এরা যে বিজেপির সমর্থক তা বুঝতে পারলাম কলকাতার বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে।
আমি যেহেতু পলিটিক্যাল স্যাটায়ার লিখি; তাই ফরহাদ মজহারকে নিয়ে স্যাটায়ার আমিও লিখি; ঠিক যে জায়গাগুলোতে উনার বিবৃতি যুক্তিগ্রাহ্য মনে হয় না। কিন্তু সেই স্যাটায়ারের ল্যাঙ্গুয়েজে অতটুকু সুষমা থাকে যে, উনি আমাদের ই-সাউথ এশিয়া ভার্চুয়াল আড্ডায় এসে কথা বলতে আনন্দে রাজি হতে পারেন।
দলান্ধ বিজেপি সমর্থিত আওয়ামীলীগের লোকের অভিযোগ, ফরহাদ মজহার কেন জঙ্গী বিরোধী অভিযানের (নাটকের) বিরোধিতা করেন। চারিদিকে তো ইসলামপন্থার উন্মাদনা বাড়ছে; উনি কেন তাদের পক্ষ নিচ্ছেন।
এই বিভ্রান্তি ভারতের কংগ্রেসের লোকেদেরও ছিল। তারা একটা কৃত্রিম উদারপন্থী আবহ তৈরি করে; কেবল বর্ণ হিন্দুদের নিয়ে একটা ‘আমরা ও মেসোরা’র আসর সাজিয়েছিল। যেখানে দরিদ্র ও দলিত হিন্দুদের কোনো প্রবেশাধিকার ছিল না। সোভিয়েত পতনের পর বামপন্থা বিলীন হলে; তখন ইসলামপন্থা ও হিন্দুত্ববাদ হয়ে দাঁড়ায় হ্যাভস নটদের ভাগ্য পরিবর্তনের ইজম।
ভারতের মতো ওপরে উদারপন্থার রেশমী পোশাক পরে ভেতরে কট্টর হিন্দুত্ববাদের ক্ষত ঢেকে না রেখে; ফরহাদ মজহার বাংলাদেশের ইসলামপন্থাকে অ্যাড্রেস করতে চেয়েছেন সংলাপের মাঝ দিয়ে। ইউরোপে যেমন কান্ট-হেগেলের সাহায্য নিয়ে কার্ল মার্কসের সাম্যচিন্তার সঙ্গে বোঝা পড়া করায়; খ্রিস্টিয় ধর্মের সঙ্গে মার্কসীয় চিন্তার দ্বন্দ্ব নিরসন করে সামাজিক গণতন্ত্র ভিত্তিক সমাজ গড়া গেছে; কল্যাণরাষ্ট্র তৈরি করা গেছে; ফরহাদ মজহার ঠিক তেমনি লালন-হাসনরাজা ও সুফি-বাউল চিন্তার সাহায্য নিয়ে ইসলাম ধর্মের সঙ্গে সাম্যচিন্তার সেতুবন্ধ রচনা করতে চেয়েছেন। তিনি যে ‘ইনসাফ’ শব্দটি ব্যবহার করেন; এটি সোশ্যাল জাস্টিস বিষয়টি সাধারণ মানুষকে স্পষ্ট করে বোঝানোর জন্য। সারাজীবন সামাজিক সুবিচার জাগরণ বলে কমিউনিস্ট পার্টির লোকেরা যে যোগাযোগ সাধনে ব্যর্থ হয়েছেন।
কট্টর পন্থার উতপত্তি দারিদ্র্য থেকে; দারিদ্র্য দূর না করলে মনিরুলের জঙ্গীবিরোধী অভিযানের অজস্র মঞ্চায়ন করেও কট্টরপন্থার নিরসন সম্ভব নয়।
হাসিনার পতনের পর আনন্দে বেহুঁশ তৌহিদি জনতা মাজার ভাঙচুর করতে চেষ্টা করলে; ফরহাদ মজহার এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তৌহিদি জনতা মজহারকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছে; কারণ তিনি তাদের খিলাফতের ভ্রান্ত স্বপ্নের সামনে এসে দাঁড়াচ্ছেন। ভারতের গদি মিডিয়ার প্ররোচনায় ইসকন হিন্দু জনগোষ্ঠীকে নিয়ে হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় নাটক মঞ্চস্থ করতে শুরু করলে; মজহার ইসকনের সমালোচনা করেন। হিন্দুত্ববাদীরা তখন রেগে টং হয়ে যায়; কারণ তাদের ভ্রান্ত অখণ্ড ভারতের স্বপ্নের সামনে এসে দাঁড়াচ্ছেন মজহার।
ফরহাদ মজহার তো সহিংস চোখের বদলে চোখের মানুষ নন; তিনি অহিংস সংলাপের মানুষ। তাই তিনি ইসকনের মন্দিরে গিয়ে পুরোহিতের সঙ্গে সৌহার্দ্য বিনিময় করেন।
দাক্ষিণাত্যের বর্গী অরিজিনের লোকেরা তখন সহমত-শিবব্রত ও শরিয়ত এই দুইভাগে ভাগ হয়ে ফরহাদকে নিয়ে গ্রামীণ খাট্টাতামাশা শুরু করে। শিবব্রত দাদা বলে, আম্রিকার তুলসি গ্যাবার্ডরে ভয় পাইয়া ইসকনের কাছে গেছে। শরিয়ত ভাই ইসকনের সঙ্গে কোলাকুলি দেখে ভীষণ গোস্বা করে। আসলে বিভাজন ও বিদ্বেষের মানুষ এই সহমত-শিবব্রত ও শরিয়ত। তাই কোথাও মানব সম্মিলন দেখলে এরা কুঁচ কুঁচ করতে থাকে। এদের চেহারা রেগে-বেগে জিম্বাবুয়ের সাবেক ফ্যাসিস্ট রবার্ট মুগাবের মতো বেগুনি হয়ে যায়।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন