এই যে আমরা আমাদের সমাজে বিচিত্র সব স্বভাবের লোক দেখি; এর কারণ প্রাচীনকালে দক্ষিণ এশিয়া ছিল ‘আ ল্যান্ড অফ অপরচুনিটিজ’; ফলে পৃথিবীর নানা জায়গা থেকে লোকজন এসে এখানে বসতি স্থাপন করে। প্রথমেই আসে আফ্রিকার লোকেরা। তারা জঙ্গল পরিষ্কার করে চাষাবাদ শুরু করে। এরপর এখানে চীন ও পারস্যের লোক এসে কারিগর ও ব্যবসায়ী হয়ে ওঠে। মধ্য এশিয়ার লোক এসে লক্ষ্য করে তাদের গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল হবার কারণে সবাই বেশ প্রশংসা করে। তারা ঠিক করে, উজ্জ্বল গাত্রবর্ণের কারণে তারা নিজেদের উচ্চ শ্রেণি দাবি করে সমাজের লোককে শেখাবে, কোনটা ঠিক কোনটা বেঠিক। এরাই দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম বুদ্ধিজীবী সমাজ, যাদের কাজ ছিল বিবৃতি দেওয়া।
মঙ্গোলিয়া থেকে মোঙ্গল ও নোম্যাডেরা এসে পড়লে তাদের পেশী শক্তির সামনে টিকতে না পেরে বুদ্ধিজীবীরা তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে বলে, আপনারা আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে নেন। বুদ্ধিজীবীদের সুন্দর সুন্দর কথা শুনে নোম্যাডেরা প্রস্তাব দেয়, আমরা ক্ষমতা নিয়ে নিচ্ছি; আর আপনারা ক্ষমতার সভাসদ ও সভাকবি হয়ে থাকুন। এরপর তুরস্ক থেকে তুর্কী, উজবেকিস্তান থেকে উজবেক, ইউরোপ থেকে পর্তুগীজ, ফেঞ্চ, ডাচ, বৃটিশ আসতে থাকে ভাগ্যান্বেষণে।
উজ্জ্বল গাত্রবর্ণের কেউ এলেই বুদ্ধিজীবীরা তাদের অভিজাত সমাজে গ্রহণ করতে থাকে। এ কারণে গুণবান কালো পুরুষেরা জীবনের লক্ষ্য হিসেবে ঠিক করে একটি ফর্সা মেয়েকে বিয়ে করাকে। যাতে সন্তানাদি ফর্সা ও শ্যামলা হয়। সামান্য শ্যামলা গাত্রবর্ণ হলেই লোকজন নিজেকে তখন আর্য বলে দাবি করতে শুরু করে।
ঐ যে আর্য কল্পনার লোকেদের অপরকে অনার্য বলে তকমা দেওয়া; তার ওপর ভিত্তি করেই দক্ষিণ এশিয়ার সমাজ মনোজগত পরিচালিত। দক্ষিণ এশিয়ার ফর্সারা রুপের গৌরবে ব্যস্ত থাকার মাঝেই দক্ষিণ ভারতের কালো গাত্রবর্ণের লোকেরা শিক্ষিত ও পণ্ডিত হয়ে ওঠে। পড়ালেখায় এদের ধারে কাছে আর কেউ নেই।
কালো ও ফর্সা বিভাজন নিয়ে কোন্দল করতে করতেই এসে পড়ে হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের দ্বন্দ্ব। অলস ফর্সা লোকগুলোই পুরোহিত ও পীর হয়ে নতুন দুটি রাজনৈতিক দল গঠন করে। বৃটিশেরা এই দুটি রাজনৈতিক দল পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে। বিভাজন করো আর শাসন করো।
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে শুরুর দিকে মধ্য এশিয়া ও পারস্যের লোকের প্রভাব থাকলেও; মোঙ্গল ও আফ্রিকার পেশীবহুল লোকেরা ধীরে ধীরে রাজনীতিতে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে।
দক্ষিণ এশিয়ার জনপ্রশাসন সাজানোর ক্ষেত্রে উজবেকিস্তান থেকে আসা উজবেক অরিজিনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
দক্ষিণ এশিয়ার সেনাবাহিনীতে তুর্কী অরিজিনের লোক নেওয়া হলেও গোয়েন্দা সংস্থার জন্য কিছু নোম্যাড অরিজিনের লোককে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। পুলিশ হিসেবে আফ্রিকান ও নোম্যাডদের প্রেফার করা হয়।
চৈনিক অরিজিনের লোকেরা কারিগরী বিদ্যা ও ব্যবসা-বানিজ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকে।
পারস্যের লোকেরা কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিক-শিক্ষক। এদের মধ্যে ফ্রেঞ্চ প্রভাব আছে। যেসব কবি সাহিত্যিক কথায় কথায় প্রেমে পড়ে এদের মাঝে ফ্রেঞ্চ প্রভাব খুবই বেশি।
মাদক ব্যবসা ও মাদক গ্রহণ করে প্রধানত ডাচ অরিজিনের লোকেরা।
বৃটিশ অরিজিনের লোকেদের কাজ হচ্ছে অনুভূতি কলা উস্কে দেওয়া ও ন্যারেটিভ নির্মাণ। বলাই বাহুল্য এই অনুভূতিকলার ভিকটিম সহজ সরল হিন্দু ও মুসলমানেরা। এরা উত্তেজিত হয়ে পড়লেই তখন নোম্যাড অরিজিনের লোকেরা খুনাখুনিতে নেমে পড়ে।
দক্ষিণ এশীয়দের মধ্যে পদ-পদবীর আকাংক্ষা মূলত এসেছে উজবেকিস্তান থেকে। পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ চায় শান্তিতে বসবাস করতে। কিন্তু উজবেকরা পদায়ন ও কিছুকাল পর জনগণের পদাঘাত অত্যন্ত পছন্দ করে।
দক্ষিণ এশিয়ার ছিনতাইকারীরা পর্তুগীজ অরিজিনের লোক। এরা প্রতিদিন ব্রেকফাস্টের সময় পরিকল্পনা করে, আজ কোন এলাকায় ছিনতাই করবে।
দক্ষিণ এশিয়ার কান্নাপ্রিয় রুদালি গ্যাং এসেছে ইরাক থেকে। কারবালার কান্নাতে অভ্যস্ত জনগোষ্ঠী দক্ষিণ এশিয়া এসে রুদালি হিসেবে বিরাজ করছে। এরা ফেসবুকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কান্নাকাটি করে।
দক্ষিণ এশিয়ার পূর্ব বঙ্গ মুঘল আমলে পৃথিবীর সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধির হার অর্জন করে। এ কারণেই বৃটিশদের চোখ পড়ে যায় পূর্ব বঙ্গের দিকে। পৃথিবীর নানা এলাকা থেকে যারা দক্ষিণ এশিয়ায় এসেছিল; তারা পূর্ববঙ্গে জড়ো হয় সম্পদ অর্জন ও পাচারের জন্য। হিমালয় বেসিনে অবস্থিত দেশটি বর্ষাকালে প্লাবিত হয়; তাই শীতকালে লুণ্ঠন করে গ্রীষ্মকালে লুণ্ঠনের অর্থে অন্যত্র সেকেন্ড হোম বানানো পূর্ববঙ্গের নিয়তি।
পূর্ববঙ্গে স্ল্যাং বা খিস্তির প্রচলন করেছে বৃটিশেরা। এরা পূর্ব বঙ্গের কৃষকদের লুণ্ঠন করত; আর তাদের ঋণস্বীকার করতে ইচ্ছা না হওয়ায় তাদের পেয্যান্টস, র্যাটস বলে গালি দিত। সেই বৃটিশ শিক্ষায় শিক্ষিত ও ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি মেখে ফর্সা হওয়া লোকেরাই ক্ষ্যাত ও চাষা গালি প্রচলন করে। আর চ-বর্গীয় গালিটি এসেছে হতভাগ্য সর্বদেশীয় পুরুষ সম্প্রদায়ের অক্ষমতাজনিত হতাশা থেকে। আজও ফেসবুকে সেই অক্ষমদের আহাজারি চ-বর্গের গালি হিসেবে শোভা পায়।
দক্ষিণ এশিয়ার ছিন্নমূল ও অসহায় যে মানুষেরা নিজেদের সান অফ দ্য সয়েল দাবি করে; অন্যদের ‘পছন্দ না হইলে বাপের দেশে চইলা যাও’ বলে এখানে-ওখানে চলে যেতে আদেশ দেয়; তারা আসলে জানে না যে, রীতিমত ডিএনএ নমুনা পরীক্ষা করে ফলাফল পাওয়া গেছে; আফ্রিকা-ফারইস্ট-পারস্য-মধ্য এশিয়া থেকে ভাগ্যান্বেষণে আসা মানুষেরাই বসতি গড়েছিল এই ভূখণ্ডে। সে কারণেই এখানে ঘুমানোর আগে কী হইলো, কী হইতে পারত জাতীয় হতাশা ভিড় করে উন্মূল ডিএনএগুলোতে।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন