সেইকালে বিটিভিতে যখন বগুড়া ইয়ুথ কয়ার বগুড়ার আঞ্চলিক ভাষায় গান গেয়েছিল; এ ছিল এক আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা। এইকালে পিনাকী ভট্টাচার্য যখন বগুড়ার আঞ্চলিক ভাষায় ভ্লগিং করলেন, তখন তা সবাইকে আকৃষ্ট করল। খালেদ মুহিউদ্দীনের কুমিল্লার ভাষার ভ্লগিং দেখার অভিজ্ঞতাও অত্যন্ত আনন্দপ্রদ। টিভি নাটকে মোশাররফ করিমের বরিশালের ভাষা কিংবা চঞ্চল চৌধুরীর পাবনার ভাষায় অভিনয় খুবই প্রাণদায়ী।
কিন্তু দিনাজপুর কিংবা রংপুরের আঞ্চলিক ভাষা একজন সিলেটির পক্ষে বোঝা বেশ কঠিন; চট্টগ্রামের ভাষা বোঝা আরও কঠিন। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের পারস্পরিক যোগাযোগ সহজ করার জন্য; সবাই বুঝতে পারে এমন একটি স্পষ্ট বাংলা ভাষা জাতীয় ভাষা হিসাবে প্রচলিত রয়েছে।
যারা কোনোভাবেই এই ভাষাটা আয়ত্ব করতে পারেন না; তারা রেগে গিয়ে একে শান্তি নিকেতনী বাংলা বলে বকাঝকা করেন। খুব সূক্ষ্মভাবে একটা গিলটি ফিলিংস দিতে চেষ্টা করেন। ঐ দ্যাকো কলকাতার ভাষা বলতেছে।
কলকাতার যে বলেচে, খেয়েচে, এয়েচে; তা নদীয়ার আঞ্চলিক ভাষা। বাংলাদেশের খুলনা এলাকার আঞ্চলিক ভাষাও ভৌগলিক কারণে ঐ ভাষার কাছাকাছি আঞ্চলিক ভাষা। খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের মানুষ; তার আঞ্চলিক ভাষা ও সব এলাকার মানুষ বুঝতে পারে এমন বাংলা ভাষা দুটোই ভালো বলতে পারে; কারণ তাদের আঞ্চলিক ভাষাটি অত্যন্ত সহজ।
বাংলাদেশের সব অঞ্চলের মানুষ বুঝতে পারে, এমন একটি স্পষ্ট বাংলাভাষা শিক্ষাদান প্রক্রিয়া ও মিডিয়াতে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত। আর তা কলকাতার বাংলা থেকে পৃথক ও স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। কাজেই এই যে স্পষ্ট বাংলাভাষা বলতে না পেরে উলটো রেগে গিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় ভাষাকে শান্তিনিকেতনী বলে তকমা দেওয়া লোকগুলো ঠিক ঐরকম; যারা বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মীয় আচারকে চট করে পাকিস্তানি আচরণ বলে তকমা দেয়।
আঞ্চলিক ভাষাকে জাতীয় ভাষা হিসেবে প্রচারকারী ব্রাত্য রাইসু ও মোস্তফা সরোয়ার ফারুকীর সঙ্গে অল্প বিস্তর পরিচয় ছিল। ব্যক্তি মানুষ হিসেবে তাদের আমি পছন্দ করি। কিন্তু তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে তারা বাংলা ভাষার জাতীয় রুপটি ভেঙ্গে দিয়ে ঢাকাইয়া ভাষাতে ছ গুলোকে স উচ্চারণ করে; বলতেসি, খাইতেসি চালু করে। ঢাকাইয়া ভাষা ইংরেজি উচ্চারণের স দিয়ে বলে একে ট্রেন্ডি ভাষা হিসেবে প্রচার করতে করতে তারা ডি জুস ভাষার উৎপত্তি ঘটান। রাইসু প্রাণপনে বিতর্ক করতে থাকেন স্পষ্ট বাংলা ভাষা বইলা কিছু নাইক্কা।ত ফারুকী আরও শক্তিশালী টিভি নাটক মাধ্যমে ভাই বেরাদারদের নিয়ে ঢাকাইয়া ভাষাকে জাতীয় ভাষায় পরিণত করার ধণুক ভাঙ্গা পণ করেন। পরিণত বয়সে ফারুকী নিজে স্পষ্ট বাংলা উচ্চারণে ফিরে এলেও; রাইসু এখনও তার একান্ত ব্যক্তিগত আঞ্চলিক ভাষাকে জাতীয় ভাষার ডিসকোর্স হিসেবে হাজির করে চলেছেন।
আমাদের প্রবাদ প্রতিম মনীষীদের অনেকেই নিজে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতেন। কিন্তু তারা কখনও তাদের একান্ত ব্যক্তিগত আঞ্চলিক ভাষাকে জাতীয় ভাষায় রুপান্তরের চেষ্টা করেননি। অধ্যাপক রাজ্জাক যেমন নিজে তার ব্যক্তিগত আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতেন। কিন্তু কখনও ঐটিকে জাতীয় ভাষায় রুপান্তরের কল্পনা করেননি। ইতিহাসবিদ ইউভাল নোয়াহ হারারি যেমন আঞ্চলিক ইংরেজিতে কথা বলেন; কিন্তু ঐটিকে আন্তর্জাতিক ইংরেজি ভাষায় রুপান্তরের চেষ্টা করেন না।
রাইসু স্কুল অফ থটের কিছু চিন্তক, প্রবন্ধ লেখার চেষ্টা করেন ঢাকাইয়া আঞ্চলিক ভাষায়। এসব লিখে খুব বিপ্লবী কর্মকাণ্ড হচ্ছে ভেবে তারা স্পষ্ট বাংলা ভাষায় যারা লেখালেখি করে; তাদের দিকে রাগ নিয়ে তাকায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ভিসি দশটাকায় ছা-ছম-ছমুছা-এর গুনাগুন বর্ণনা করতে গিয়ে মিমের রাজা হয়ে উঠেছিলেন। ঐ মিম এড়িয়ে চলতেই লোকে বলতেসি খাইতেসি করতেসি বলে। কারণ ছ উচ্চারণ নিয়ে তাদের বিরাট বিভ্রাট।
বিতর্ক আন্দোলন ও আবৃত্তির কণ্ঠশীলনের মাধ্যমে যারা ছ বিভ্রাট কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন; তারা রাইসু কিংবা ফারুকীর আঞ্চলিক ভাষা বিপ্লবে যোগ দেননি।
ভাষা নিয়ে হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতি মামা ও ইসলামপন্থী দর্শন মামার টানাহেঁচড়া রয়েছে। হিন্দুত্ববাদীরা বাংলা ভাষায় শত শত বছর ধরে মিশে যাওয়া আরবি-ফার্সি শব্দ বাদ দিয়ে সেইখানে সংস্কৃত শব্দ আনতে চান। যেমন, শত বছর ধরে ব্যবহৃত গোশত শব্দটিকে উড়িয়ে দিয়ে তারা মাংস শব্দটি প্রচলনের চেষ্টা করেছেন। আবার শত বছর ধরে প্রচলিত যোগাযোগ বা সংযোগ শব্দ উড়িয়ে দিয়ে ইসলামপন্থী দার্শনিকেরা আমদানি করেছেন সিলসিলা শব্দটি।
আমি সিলেটি আর চট্টগ্রামের ভাষা বাদ দিলে বাংলাদেশের বেশিরভাগ আঞ্চলিক ভাষা অল্প বিস্তর শিখেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অঞ্চলের বন্ধুদের কাছে। পরে সাংবাদিক হিসেবে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার মানুষকে ইন্টারভিউ করতে গিয়ে এগুলো কাজে লেগেছে। বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষাগুলোর হিউমার আমাকে আকৃষ্ট করে। কিন্তু কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদানে, মিডিয়ার খবর ও টকশোতে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার আমার কাছে অগ্রহণযোগ্য ও উগ্র আঞ্চলিকতাবাদ মনে হয়। সবাই সহজে বুঝতে পারে এমন একটি স্পষ্ট ভাষা যোগাযোগের প্রয়োজন রয়েছে। একজন অবাংলা ভাষীকে আড্ডায় বসিয়ে নিজেরা বাংলায় গুজুর গুজুর করা যেরকম আনকার্টিয়াস, রাজশাহীর একজন বন্ধুকে আড্ডায় বসিয়ে নিজেরা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় গুজুর গুজুর করা অসৌজন্যমূলক। এটা পৃথিবীর সর্বত্র অলিখিত কোড অফ কন্ডাক্ট যে আড্ডায় অন্যভাষার লোক থাকলে সবাই ইংরেজিতে আড্ডা দেবে; যেহেতু সেটি গোটা পৃথিবীর যোগাযোগের ভাষা হিসেবে শত শত বছর ধরে প্রতিষ্ঠিত। একইভাবে বাংলাদেশের কোনো একটি আঞ্চলিক ভাষার মানুষের মধ্যে অন্য অঞ্চলের মানুষ বসে থাকলে; শত বছর ধরে প্রচলিত স্পষ্ট বাংলা ভাষায় আলাপ আলোচনা করা শিষ্টাচার।
অনুসিদ্ধান্ত হচ্ছে নিজের স্পষ্ট বাংলা বলতে না পারার অক্ষমতাকে জোর করে হেজিমনিতে পরিণত করতে নেই। আরেকটি শিষ্টাচার হচ্ছে, কেউ স্পষ্ট বাংলা ভাষা না বলতে পারলে; তার ওপর জোর করে স্পষ্ট বাংলাভাষার হেজিমনি চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়।
যেমন একজন সাধারণ মানুষ ছা ছপ ছমুছা বললে; তা মিমের বিষয় হতে পারে না। ঠিক তেমনি আপনি যখম মিডিয়ায় কাজ করতে এসেছেন, ক্লাস রুমে ক্লাস নিতে এসেছেন, শিল্প-সাহিত্য-দর্শন আলাপ করতে এসেছেন, টকশোর সম্মানিত অতিথি হয়েছেন; তখন আপনাকে স্পষ্ট বাংলা ভাষার প্রস্তুতি নিতে হবে। মানুষ এভারেস্ট জয় করতে পারলে; চন্দ্রবিজয় করতে পারলে, ৩৬ জুলাই বিপ্লব সংঘটিত করতে পারলে; একটু স্পষ্ট করে সবার বোঝার মতো বাংলা বলা শিখতে পারবে না কেন!
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন