ইতালির ফ্যাসিস্ট মুসোলিনির সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ছিল, এডিটর'স গিল্ড ছিল, থিয়েটার ও হোয়াইট টেলিফোন ফিল্ম সোসাইটি ছিল। মুসোলিনির ছেলের সি আর আই ছিল, সেখান থেকে চলচ্চিত্র শিল্প বিষয়ক পত্রিকা প্রকাশিত হতো। মুসোলিনির পতনের পর সব বন্ধ হয়ে যায়। ফ্যাসিজম বিরোধী চলচ্চিত্রকার ভিত্তোরি ডি সিকা তৈরি করেন ধ্রুপদী চলচ্চিত্র বাইসাইকেল থিভস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ইতালিতে মুসোলিনির রেখে যাওয়া পঙ্গু অর্থনীতি আর ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য ছিল। বাইসাইকেল থিভস সেই বৈষম্যধূসর ইতালির অমর চিত্রায়ন।
ফ্যাসিস্ট হাসিনার সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, এডিটর'স গিল্ড, থিয়েটার গ্রুপ ও ওটিটি ফিল্ম সোসাইটির লোকেদের মুখে তেলাঞ্জলি শিল্পের বড়াই শুনে মনে হয়; তারা অলীক জগতে বসবাস করেন। তাদের সমুদয় শিল্পের সিলেবাস খুবই সীমিত। ১৯৪৭ মানে কোনো হিন্দু পরিবারের দেশ বিভাগের যন্ত্রণা। ঐ ঋত্ত্বিক ঘটককে যে মেঘে ঢাকা তারা বানাতে দেখেছে; ঐটাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রঙ্গিন করে রিপ্রোডিউস করা। ১৯৭১ মানেই শুধু বঙ্গবন্ধু; ভাসানীর দাড়ি টুপি থাকায় তিনি কৌতুক প্রদ। একাত্তরের রাজাকারদের যেসব আলোকচিত্র দেখেছি; সব রীতিমত ক্লিনশেভড লোকজন; অথচ এদের চলচ্চিত্রে রাজাকার মানেই দাড়ি টুপি, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার জিয়া সেসব চলচ্চিত্রে ভিলেন, প্রান্তিক ধূলোমলিন মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন যন্ত্রণার গল্প নেই; আছে কেবল ঢাকার বেছে নেওয়া মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদের জীবন। থিয়েটার মানেই সেই সৈয়দ শামসুল হকের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়-এর পারমুটেশন আর কম্বিনেশন। আর সাংবাদিকতা মানেই হাসিনার উন্নয়নের পাঁচালি, কেন তার বিকল্প নাই; তা শতবার বলা।
এই সাংস্কৃতিক জোটে কামাল লোহানীর মতো সাম্যচিন্তার নৈর্ব্যক্তিক সাংস্কৃতিক নেতা নেই, চলচ্চিত্রে জহির রায়হানের মতো প্রতীতী নেই। থিয়েটারে নেই সেলিম আল দীনের শিল্পবৃক্ষ। বাংলাদেশের শিল্পের সত্য-সুন্দর আর মঙ্গলের মানুষেরা সব কবরে ঘুমিয়ে; আর গত পনেরো বছরে কামাল লোহানী, জহির রায়হান, সেলিম আল দীনের জাতিস্মর তরুণদের গুম করা হয়েছে, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের বিষ মাখানো তীরে শিকার করা হয়েছে।
এই যে ফেসবুকে হাসিনা ধর্মের যে শিল্প-রসিকেরা সারাক্ষয় ’হতাশ হয়ে পড়ছি’ লিখছেন; এই হতাশা সেই শেরে বাংলার কৃষক প্রজা আন্দোলনে জমিদারি হারানো বৃটিশ কোলাবরেটরদের জমিদারি হারানোর হতাশার সমান্তরাল।
এই যে আওয়ামীলীগকে ভারতের ক্ষমতা কাঠামোর জমিদারিতে কিছু জমি পত্তনি পাওয়া গণি মিয়া গরিব চাষী বলে লোকে; তার প্রমাণ আমরা পেলাম ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার দোসরেরা পালিয়ে গিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া; সেখানে মোদি মিডিয়ার হাসিনার পক্ষে প্রচারণা; বাংলাদেশের জমিদারি ফিরে পাবার আকুতিতে।
হাসিনা ধর্মের শিল্প-সাহিত্যের লোকেরা বাংলাদেশে ভারতের ক্ষুদ্র কুটির শিল্পী হবার কালে; তোতা পাখির মতো করে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াকে পাকিস্তানের ‘এজেন্ট’, খালেদাকে পাকিস্তান পন্থী, বিএনপিকে পেয়ারে পাকিস্তানের অনুসারী বলে একটা ন্যারেটিভ তৈরি করেছে; অথচ কোনোদিন খালেদা কিংবা বিএনপির নেতাদের পালিয়ে পাকিস্তানে আশ্রয় নিতে দেখলাম না। তার মানে কত বড় মিথ্যার ওপর দাঁড়িয়ে ভারত সমর্থিত আওয়ামীলীগের রাজনীতি।
একবিংশের পাকিস্তানের নাগরিক সমাজ শেরে বাংলা, ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের ইতিহাসে অনুকরণীয় রাজনীতিক বলে মনে করে। রাজনৈতিক সক্ষমতার দিক থেকে তারা জিন্নাহর চেয়ে বেশি যোগ্য মনে করে সোহরাওয়ার্দীকে। রাজনীতিক ইমরান খান তার রাজনীতিতে বার বার শেখ মুজিবের উদাহরণ টানেন। যে খুনে সেনা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছে; তারা এরপর গত ৫৩ বছর ধরে পাকিস্তানে অ্যাথনিক ক্লিনসিং চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে সেখানেই সোহরাওয়ার্দী ও মুজিব প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন আজকের পাকিস্তান বাস্তবতায়। এটা আইরনিক্যাল হলেও সত্য যে জুলাই ছাত্র-গণহত্যার আগে শেখ হাসিনা পাকিস্তানের নারী সমাজে জনপ্রিয় ছিলেন। খালেদা জিয়া সেভাবে আলোচিত নন পাকিস্তান সমাজে। পাকিস্তানের কোনো মিডিয়াকে আমরা গত পনেরো বছরে দেখিনি খালেদার পক্ষে আকুল হয়ে ময়ূখ নৃত্য করতে।
১৯৭১-এর গণহত্যা নিয়ে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান জামায়াতের যে ডিনাইয়াল; তা পাকিস্তানের শিক্ষিত নাগরিক সমাজের মাঝে নেই। অথচ আওয়ামীলীগের শিক্ষিত নাগরিক সমাজে ২০০৯-২০২৪-৫ আগস্ট পর্যন্ত চালানো হাসিনার গণহত্যা নিয়ে যে ডিনাইয়াল আমরা দেখতে পাই; ভারতের শিক্ষিত নাগরিক সমাজেও তা যেমন দৃশ্যমান নয়। এ কারণে আমি সব সময় ভারত ও পাকিস্তান বিষয়ক আলোচনায়, ক্ষমতা কাঠামোর কুকীর্তি আর সাধারণ মানুষের সুকৃতি কিংবা স্বাভাবিকতাকে আলাদা করে দেখি। যেমন গুজরাটে মোদির গণহত্যা নিয়ে বিজেপির শিক্ষিত লোকেরা অনুতাপহীন কিন্তু শিক্ষিত সাধারণ নাগরিক সমাজ অনুতপ্ত। তাই পররাষ্ট্র বিষয়ক আলোচনায় ঐ দেশের সরকার ও নাগরিক সমাজকে পৃথকভাবে মূল্যায়ন কমনসেন্সের অংশ।
১৯৭১-এ বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর শেখ মুজিবের অনমনীয়তার কারণে ভারতের ক্ষমতা-কাঠামো আগ্রাসন সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যায়। জিয়া-এরশাদ-খালেদার ক্ষেত্রেও সমমর্যাদার ভিত্তিতে বাংলাদেশ নীতি সাজিয়েছে ভারত। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর শেখ হাসিনা দিল্লিতে আশ্রয় নিলে লোকাল গার্ডিয়ান হিসেবে প্রণব মুখার্জি তার দেখাশোনা করেন সঙ্গে রাজনৈতিক পরামর্শ দিতে শুরু করেন। প্রণব মুখার্জির স্ত্রী বাংলাদেশের মেয়ে। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু তার বিপন্নতার মনস্তত্ব থেকে অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন দেখা অনেকটা স্বাভাবিক। ২০০৮ সালে সেসময়ের সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদকে ঘোড়া উপহার দিয়ে প্রণব হাসিনাকে ক্ষমতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন। ২০০৯ সাল থেকে ভারতের ক্ষমতা কাঠামো তার ১৯৪৭ সালের হারানো জমিদারিটি ফিরে পায়। এই ভারতীয় জমিদারীর সম্মতি উৎপাদনে কাজ করে হাসিনার সাংস্কৃতিক ট্রুপের কুটির শিল্পীরা। সে কারণেই জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে ঘোষিত হয়, হাসিনা’জ কালচার ইজ ডেড।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছিল পাকিস্তানের সংখ্যালঘিষ্ঠ রাজনীতিক ও দখলদার সেনা। ২০২৪ সালেও বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছিল ভারতের মোদি সমর্থিত সংখ্যালঘিষ্ঠ মানুষের আওয়ামী সেনারা। ইতিহাসে দুবার প্রমাণিত হলো সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের শক্তি।
একবিংশ শতকের বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে অর্থনীতিতে শক্তিশালী একটি রাষ্ট্র। বাংলাদেশের রাজনীতিতে পাকিস্তান অপ্রাসঙ্গিক। ভাষার পার্থক্য ভৌগলিক দূরত্বকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ইতিহাসের কান্দন ব্যস্ত ঘড়ির কাঁটায় কবেই মিলিয়ে গেছে। কিন্তু ভারত বাংলাদেশকে চারপাশ থেকে ঘিরে রাখা প্রতিবেশী। উত্তর-পশ্চিম ভারতের সঙ্গে ভাষাগত দূরত্বের কারণে যে ভৌগলিক দূরত্ব বেড়ে যাবার কথা; সেটা বাংলাভাষী পশ্চিমবঙ্গের প্রণব স্কুল অফ থটের কিছু লোকের কারণে কখনোই কমে না। সাউথব্লকে তারা ঘুরে ফিরে হারানো জমিদারির জন্য কাঁদে; আবদার করে, দাদা পায়ে পড়িরে মেলা থেকে বৌ এনে দে।
সে কারণে ভারতের শিক্ষিত নাগরিক সমাজে অনেক বন্ধু থাকার পরেও ভারতের আগ্রাসনবাদ নিয়ে কিছু অপ্রিয় বিষয় সবসময় আলোচনা করতে হয়। এর কারণ বাংলাদেশের মানুষ সার্বভৌমত্বপ্রিয়। আমরা আমাদের দেশমাতাকে কারও ঘরের দাসী বাঁদী হয়ে থাকতে দিতে চাই না।
আওয়ামীলীগের কুটির শিল্পীরা ওপরে জমিদারি ভাব ধরে রাখলেও তাদের একটি কাঁকন দাসী সত্বা রয়েছে। তাই তারা মোদি প্রগতিশীলতায় আস্থা রাখে। অধুনা তারা ট্রাম্প প্রগতিশীলতা নিয়ে পাগলপারা হয়েছে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মতো সার্বভৌমত্ব সচেতন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। আপাত নিরীহ এই মেহনতী মানুষেরা আওয়ামীলীগের শিল্পকলা মামাদের ন্যারেটিভ শুনে চুপ করে থাকে। কিন্তু সেটা সহ্যের সীমা অতিক্রম করলে এমন বাড়ি দিয়ে দেয়; তখন লেজ গুটিয়ে লুটিয়েন্স প্যালেসে পালাতে হয় দেশ লুটের আলীমা ও চল্লিশ চোরদের।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন