বাংলাদেশকে এর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অতীত গৌরব পুনরুদ্ধার করতে হবে। প্রতিবেশী ভারতে কট্টর হিন্দুত্ববাদের উস্কানিতে বাংলাদেশে কট্টর ইসলামপন্থা প্রশ্রয় পেলে তা হবে এই জনপদের বহুত্ববাদের শিক্ষা থেকে দূরে চলে যাওয়া।
এই পূর্ববঙ্গে সুলতানী, মুঘল ও নবাবী আমলে মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল। সুলতানী আমলে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির একটি সর্বধর্ম আশ্রয়ী বিকাশ ঘটে। শাসকেরা মুসলিম হলেও তারা হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্ম চর্চার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেন; এক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। প্রশাসনে নৈর্ব্যক্তিক ও নিরপেক্ষ মনোভঙ্গি থাকায় প্রতিটি ধর্মের মানুষ সমান অধিকার ভোগ করতেন। বহুকাল পরে ইউরোপ যে সেকুলার বা ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করে; সেই সুলতানী-মুঘল ও নবাবী আমলে এমন বহুত্ববাদী রাজ্য ও সমাজ কাঠামো বিনির্মিত হয়েছিল পূর্ববঙ্গে। যে কারণে এই তিনটি মুসলিম শাসনামলে নারীর স্বতন্ত্রভাবে ঋণ গ্রহণ, ব্যবসা পরিচালনার স্বাধীনতা ছিল। ইউরোপের নারী যখন চার্চের উইচহান্টিং-এ অবরুদ্ধ; পূর্ববঙ্গে সেসময় নারী আত্মনির্ভর উন্নয়ন কৌশল লাভ করেছিল। ভূমির ওপর তার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রশাসনের কাছ থেকে জমি পত্তনি নিয়ে স্বতন্ত্রভাবে জমিদারি পরিচালনা করেছেন নারীরা এসময়। এসময়ে আন্তঃধর্ম বিবাহের একটি মানবিক ধারা প্রচলিত ছিল। ধর্মীয় বিভাজন কখনও মানবিক ভালোবাসার পথে বাধা হয়নি। এসব কোনো রুপকথা নয়। নৈর্ব্যক্তিক ইতিহাস ও প্রত্ন গবেষণায় এই সুষম সমাজের দেখা মেলে।
বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসকেরা ১৭৭০-৭৬ সালে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে প্রায় এক কোটি মানুষ হত্যা করে; ১৭৯৩ সালে কৃষকের ভূমি কেড়ে নিয়ে বৃটিশ কোলাবরেটরদের জমিদারির চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দিয়ে; পূর্ববঙ্গের সমৃদ্ধ কৃষক-কারিগর-শিল্পী সমাজকে দুঃস্থ করে; একে নিম্নবর্গের সমাজের তকমা দেয়। সুলতানি-মুঘল ও নবাবী আমলে পূর্ববঙ্গ ছিল এশিয়ার খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসাকেন্দ্র। চট্টগ্রাম থেকে লখনৌতি হয়ে পারস্যগামী ব্যবসাপণ্য পরিবহনের রুটে যে সরাইখানা ছিল; বৃটিশেরা তা বিলুপ্ত করলে; সরাইখানাগুলোর বেকার হয়ে যাওয়া কর্মীরা বাধ্য হয়ে অপরাধী জীবন বেছে নিলে; বৃটিশেরা তাদের ঠগী তকমা দেয়।
একটি জনগোষ্ঠীকে সমৃদ্ধ ও সম্প্রীতিময় অবস্থা থেকে দুঃস্থতা ও বিভাজনময় পরিস্থিতির দিকে কৃত্রিমভাবে ঠেলে দেয়া হয়েছিল। কলকাতাকেন্দ্রিক কিছু হিন্দু কোলাবরেটর তৈরি করে; তাদের জমিদারি দিয়ে ও তাদের দিয়ে সুলতানি-মুঘল-নবাবী আমল সম্পর্কে কুতসামূলক ন্যারেটিভ লিখিয়ে পূর্ববঙ্গের মুসলমান ও হিন্দুদের মাঝে বিদ্বেষ-বিভাজন সৃষ্টি করা হয়।
সাম্প্রতিক দেড় দশকের শেখ হাসিনার শাসনামলে হুবহু একই নীতি অনুসরণ করে; হিন্দুদের প্রশাসন-পুলিশ ও মিডিয়ায় নিগ্রহকারী ও ন্যারেটিভ নির্মাতা হিসেবে ব্যবহার করে হিন্দু-মুসলমান বিভাজন ও বিদ্বেষ তীব্র করে তোলা হয়েছে। দিল্লির সাউথব্লক ও ঢাকার হাসিনা ব্লক জায়নিস্ট অপকৌশল অবলম্বন করে; হলোকস্টের জন্য কাঁদো আর নতুন হলোকস্ট ঘটাও নীতি বাস্তবায়ন করেছে গুম-ক্রসফায়ার-জঙ্গি বিরোধী অভিযান নাটকে। শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির গেরুয়া সন্ত্রাস বাংলাদেশে ইসলামি সন্ত্রাসবাদ সৃষ্টি করে; ক্ষমতার চিরস্থায়ীত্ব চেয়েছে। বাংলাদেশে ইসলামি সন্ত্রাসবাদ রয়েছে, হাসিনা ছাড়া আর কেউ তা নিয়ন্ত্রণে সক্ষম নয়; এই নেসেসারি ইলিউশন তৈরি করতে চেয়েছে পশ্চিমের মিডিয়া ও থিংক ট্যাংকদের মনে। হলোকস্টের কান্না কেঁদে কেঁদে জায়নিস্টরা যেভাবে প্যালেস্টাইনে নাগবা গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে; শেখ হাসিনার আওয়ামিস্ট আগ্রাসনবাদীরা চেয়েছিল ঠিক সেইভাবে একাত্তরের গণহত্যার কান্না কেঁদে বাংলাদেশে ফ্যাসিজম বিরোধীদের বিরুদ্ধে আওয়ামিস্ট সিসটেমেটিক এথনিক ক্লিনজিং চালিয়ে যেতে।
বৃটিশেরা অল্প-সংখ্যক হিন্দু জমিদার দিয়ে মুসলিম কৃষকদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যেভাবে হিন্দু-মুসলমান সামষ্টিক সম্পর্কে বিদ্বেষ ও বিভাজন রচনা করেছিল; শেখ হাসিনা একইভাবে অল্প-সংখ্যক হিন্দু পুলিশ-প্রশাসক-মিডিয়া ইনফরমেশন হিটম্যান নিয়োগ দিয়ে তাদের দিয়ে দাড়ি টুপিওয়ালা ধার্মিক মুসলমান অংশটিকে দমন নিপীড়ন করে; ঐ হিন্দু-মুসলমান বিভাজনকে চিরস্থায়ী রুপ দিতে চেষ্টা করেছিল।
৫ আগস্ট হাসিনার পতন ও পলায়নের পর ভারতের গদি মিডিয়া ও বাংলাদেশে ফ্যাসিজমের দোসরেরা আবার সেই আওয়ামীলীগ দলীয় হিন্দুদের ভিকটিম কার্ড খেলে বাংলাদেশে কথিত হিন্দু নির্যাতনের ন্যারেটিভকে যুক্তরাষ্ট্রে কট্টর খ্রিস্টিয়বাদী নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুখে পুরে দিয়েছে।
বাংলাদেশের সাধারণ হিন্দু ও মুসলমানকে এই মোদি-হাসিনার যৌথ প্রযোজনা নাটক সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন হতে হবে। বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যেহেতু মুসলমান; তাদেরই দায়িত্ব হিন্দুদের নিরাপত্তা হয়ে ওঠা। শেখ হাসিনার দোসর সে মুসলমান, হিন্দু বা বৌদ্ধ হোক; তাদের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করার জন্য বিচার বিভাগ রয়েছে। সভ্য জগতে মব জাস্টিস বলে কোনো কিছু নেই। ন্যায়বিচার আসতে হবে আদালতের মাধ্যমে।
বাংলাদেশের পতাকার ওপরে গেরুয়া পতাকা উড়িয়ে অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন কিংবা কালো পতাকা উড়িয়ে খিলাফতের কল্পনা; মানসিক বিভ্রাট। একবিংশ শতকের বাংলাদেশ; যেখানে ২০২৪-এর হিন্দু-মুসলমান মা তাদের সন্তানকে হাসিনার স্বৈরশাসন উপড়াতে এগিয়ে দিয়ে নিজেরা মিছিলে নেমেছেন; এইখানে জনমুক্তি ও সার্বভৌমত্বের ইস্যুতে সবাই একাট্টা। একবিংশের হিন্দু-মুসলমান তারুণ্য বুকের রক্ত দিয়ে ভারতের আগ্রাসনবাদের পুতুল হাসিনাকে তাড়া করে ভারতে পালাতে বাধ্য করেছে।
এই ভারত অর্থ ক্ষমতা-কাঠামোর ভারত; হিন্দুত্ববাদ আচ্ছন্ন হিংস্র ভারত। কিন্তু ভারতের সাধারণ মানুষ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মতোই অকল্যাণ রাষ্ট্র ও এর ক্ষমতাকাঠামোর হাতে জিম্মি অসহায় জনগোষ্ঠী। কাজেই দুই দেশের সাধারণ মানুষকে এই হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের মারণ খেলা থেকে শত হাত দূরে থাকতে হবে।
ফেসবুকে যে মুসলমান তরুণেরা হিন্দুদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রকাশ করে; আর যে হিন্দু তরুণেরা মুসলমানের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রকাশ করে; তারা আসলে হাসিনা-মোদির তৈরি বিভাজনের ফাঁদে পা দিয়েছে। ইন্টারনেট যুগে জন্ম নেয়া জেনজিরা বিশ্বরাজনীতি ও সমাজ সম্পর্কে সচেতন; তাদের উচিত হবে না; হাসিনা-মোদির ভিলেজ পলিটিক্সের খপ্পরে পড়া।
হিন্দু-মুসলমান বিদ্বেষ ও বিভাজন জিইয়ে রাখতে ফেসবুকে সক্রিয় রয়েছে আফসোস লীগের কথিত সংস্কৃতি মামা ও খালারা; হাসিনার পতনে এতিম হয়ে যাওয়া ফুটসোলজারেরা। এই বিষাক্ত নরগোষ্ঠীর ব্যাপারে খুব সাবধান থাকতে হবে।
হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের মাধ্যমে হাসিনা সৃষ্ট সাম্প্রদায়িকতার রাক্ষসটিকে পরাজিত করা সম্ভব। হাসিনার সাইকোপ্যাথ পলিটিক্সের বিদ্বেষ-বিভাজন-প্রতিহিংসার ভাইরাস থেকে মুক্ত করতে হবে এ সমাজকে। জুলাই বিপ্লবের স্বপ্ন ঠিক তখনই সফল হবে; যখন হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খৃস্টান ও অন্যান্য নৃ গোষ্ঠীর মানুষের একটি ঐক্যবদ্ধ সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে; একটি কল্যাণরাষ্ট্র সৃজিত হবে বহুত্ববাদের ক্যানভাসে।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন