দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে সম্পদ দখলের জন্য ট্যাগিং বা তকমা প্রধান কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় এর শেকড়ের অনুসন্ধান করেছেন ইতিহাসবিদেরা। পলাশীর যুদ্ধে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার ক্ষমতা দখল করলে; তাদের পুতুল নবাব মীরজাফর ও তার বন্ধুবৃত্ত জগতশেঠ, রায়দুর্লভ, উমিচাঁদ, রাজবল্লভ লর্ড ক্লাইভের কাছে গিয়ে অভিযোগ করেন, জনগণের চোখে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে পরিচিতি পাওয়ায় মান সম্মান আর কিছুই রইল না।
লর্ড ক্লাইভ কিছুক্ষণ চিন্তা করে পরামর্শ রাখেন, আপনারা পুনঃ পুনঃ জনগণকে বিশ্বাসঘাতক বলতে থাকুন। ভিক্ষুক ও এতিম সম্প্রদায়কে একত্রিত করে একটি ‘গান্ধা কইরা দেওয়া ব্রিগেড’ গঠন করুন। তাদের লোভ দেখান, কোথাও আপনাদের সামান্যতম সমালোচনা দেখলে, ঐ স্থলে ঘরের দেয়ালে চকের ক্রস দাগ দিয়ে আসতে। এই ক্রস দাগের অর্থ দেশের শত্রু বা দেশদ্রোহী। এরপর একদিন ঐ ঘরের দখল নিতে। মনে রাখবেন ডেসপারেট,গৃহহীন, ভূমিহীন লোকেরা ঘর বাড়ি দখলের জন্য মরিয়া, আপনারা কেবল তাদের ক্ষমতায়িত করুন। কোনো পরিশ্রম না করে কেবল সম্পন্ন পুরবাসীকে দেশদ্রোহী তকমা দিয়ে সম্পদ অর্জনের এই সুবর্ণ সুযোগ আর আসবে না।
সেই থেকে তকমা বা ট্যাগিঙের বিনিময়ে সম্পদ দখল ও তকমা দেওয়ার দক্ষতার কারণে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদ প্রাপ্তির প্রচলন হয়। ভিক্ষুকদের ‘গান্ধা কইরা দেওয়া ব্রিগেড’ পূর্ববঙ্গে ঘুরে ঘুরে সম্পন্ন কৃষক, কারিগর ও বাংলা-ফারসি-আরবি শিক্ষায় শিক্ষিত পণ্ডিতদের মূর্খ, চাষা, নিম্নবর্গের দেশদ্রোহী তকমা দিয়ে বেড়াতে থাকে। তারা যেসব জমি-দাগ-খতিয়ান লিখে এনে বৃটিশ ভূমি দপ্তরে ‘শত্রু সম্পত্তি’ হিসেবে চিহ্নিত করত; বৃটিশেরা তা সরকারি খাসজমি হিসেবে বরাদ্দ দিত ঐ গান্ধা কইরা দেওয়া ব্রিগেডের সফল সদস্যদের। এই তকমা বা ট্যাগিংকে ন্যারেটিভে রুপান্তর করতে প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। বৃটিশেরা চালু করে আধুনিক বাংলা গদ্য। সেই গদ্যে লেখা শুরু হয় ট্যাগিং ভিত্তিক ইতিহাস। ঐ ইতিহাসে সুলতানি-মুঘল-নবাবী আমলের শাসকেরা অশিক্ষিত-বর্বর-দুঃশ্চরিত্র-বহিরাগত; অপরদিকে বৃটিশ শাসক হয়ে ওঠে বেঙ্গল রেনেসাঁর প্রতীক।
এই আলোর দোকানদারি পরিপুষ্ট হয়ে পড়ে লর্ড কর্নওয়ালিশের আমলে। লর্ড কর্ণ খুঁজে খুঁজে ট্যাগিং দিতে ওস্তাদ বাকপটু ভ্যাগাবন্ড বৃটিশের স্বপক্ষের শক্তি লোকেদের জমিদার হিসেবে গড়ে তুলতে তাদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তী দেন। গোটা পৃথিবীর সম্পদ লুণ্ঠন করে এনে বৃটিশেরা লন্ডনে যেমন একটি ধলা অভিজাত সম্প্রদায় তৈরি করে; তারই একটি মিনিয়েচার কালো অভিজাত সম্প্রদায় তৈরি করেন কলকাতায়।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখানো হয় কী করে বৃটিশ সিভিল সার্ভিসে গিয়ে জমিদারি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত পাওয়া যায়। আবার রাজনৈতিক বিপ্লবের নামে কী করে জনগণের সম্পদে স্বাস্থ্যবান হওয়া যায়। জনগণকে শুধু পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখিয়ে বিপ্লবীর অভিনয় করে জমিদার হওয়া যায়। আর প্রতিপক্ষকে কী করে ট্যাগিং করে তার সম্পদ লুণ্ঠন করা যায়। এইসব গুরুতর বিদ্যা পূর্ববঙ্গের লোকজন শিখে ফেললে, বিপ্লব ব্যবসার অংশীদার এসে পড়বে; এই আশংকায় কলকাতার নব্য বিদ্যাধর জমিদারেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বাধা দেয়।
বৃটিশ আশ্বস্ত করে, ওরা ইংরেজি শিক্ষায় ৫০ বছর পিছাইয়া পড়িয়াছে; সুতরাং তোমার এই বৃহত্তম শ্রেষ্ঠ সেরা জগদখ্যাত বিশেষণগুলি তোমারই রহিবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ধীরে ধীরে বৃটিশ সিভিল সার্ভিসে ঢুকে সুপিরিয়র হওয়ার স্বপ্ন দোলা দেয়। পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখিয়ে বিপ্লব করে ক্ষমতা ও জমিদারি লাভের বাসনা উদগ্র হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত যুবকদের মুখে ভাষা থাকে; কৃষক-কারিগরের মুখে ভাষা থাকে না। তাই তারা সে বিপ্লবের নেতৃত্ব শিক্ষিত তরুণদের দিয়ে নিজেরা রক্ত দেওয়ার প্রস্তুতি নেয়। নতুন ট্যাগিং বৃটিশের দালাল প্রচলিত হয়। কৃষক প্রজা আন্দোলনে জমিদারি হারিয়ে বৃটিশের দালালেরা কলকাতার লুটিয়েন্স সেকেন্ড হোমে পালিয়ে যায়। দিনমান তকমা সাধনা ও ন্যারেটিভের কুঁচকুঁচ তাদের সঙ্গী হয়। তারা অখণ্ড বাংলা স্বাধীন করার প্রস্তাবে অসম্মতি জানায়। ফলে বাধ্য হয়ে পূর্ব বঙ্গকে ‘ঠোঁটে বিড়ি মুখে পান লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ স্লোগান ধরতে হয়।
পাকিস্তান হিসেবে স্বাধীন হওয়ার পর পূর্ব বঙ্গে বৃটিশ বিরোধী বিপ্লবীদের একটি অংশ আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়। বৃটিশের দালাল বলে তকমা দিলেই বাড়ি দখলের অপার সুযোগ সেখানে। পূর্ব বঙ্গের কৃষকের কষ্টার্জিত ফসল বৃটিশ আমলে যেভাবে কলকাতার সেকেন্ড হোমে উঠত, এবার পাকিস্তান আমলে সে ফসল পিন্ডির সেকেন্ড হোমে উঠতে থাকে। অত্যাচারী হিন্দু জমিদারের জায়গায় এসে পড়ে অত্যাচারী মুসলমান জমিদার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিছু সিএসপি জমিদার তৈরি করলেও বিপ্লবসঞ্জাত জমিদারি পশ্চিম পাকিস্তানে গড়ে উঠতে দেখে বিক্ষুব্ধ হয় পূর্ব বঙ্গের বিপ্লবীরা। পূর্ব বঙ্গের কৃষকের উৎপাদিত পাট থেকে পাওয়া বৈদেশিক মুদ্রা খেয়ে দিচ্ছে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপ্লবীরা। এই বৈদেশিক মুদ্রা খাওয়ার কথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপ্লবীদের। আন্দোলন, সংগ্রামে কৃষক-শ্রমিকের ভাষা থাকে না; ভাষা দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত বিপ্লবীরা। সুতরাং রক্ত দিতে রণাঙ্গণে চলে যায় কৃষক-শ্রমিকত-মেহনতি মানুষ। পাকিস্তানের খুনে সেনা দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সাধারণ মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপ্লবীরা কলকাতায় গিয়ে বিপ্লবী ন্যারেটিভ প্রচারের কাজ করে। শিক্ষিত মানুষ সবসময় নিরাপদ স্থানে বসে বিপ্লবী ন্যারেটিভ বানায়; প্রাণ দেয় কৃষক-মুটে-মজুর; এখানেই বা তার অন্যথা হবে কেন। কলকাতার সেকেন্ড হোমের ন্যারেটিভ দাদুরাও জমিদারি ফিরে পাওয়ার আশায় তাদের সঙ্গে যোগ দেয়।
অনেক প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে; ঢাকা শহরেই গতর পুষে বেঁচে থাকা শিক্ষিতেরা মাথায় পতাকা বেঁধে ‘পাকিস্তানের দালালে’-র বাড়ি খুঁজে দখল করতে নেমে পড়ে। কৃষক-শ্রমিক রণাঙ্গন থেকে ফিরে যায় ভাতের লড়াইয়ে। শুরু হয় আওয়ামীলীগের জমিদারি। পাকিস্তানের দালাল বা রাজাকার তকমা দিয়ে যুদ্ধের বাজারে দখল ও লুণ্ঠনে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয় আওয়ামীলীগের লোকেরা। বাংলাদেশ তখন আওয়ামীলীগের একদলীয় জমিদারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপ্লবীরা যারা পাতলা খান লেনের মেসে থাকত; তারা মিন্টু রোড, ইস্কাটন, ধানমণ্ডি, গুলশানে আলিশান বাংলোতে বসে অভিজাত জমিদার শ্রেণি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। রাজাকার তকমা দাও রেডিমেড বাংলো পাও চলতে থাকে দ্রুত গতিতে। জোড়া সাঁকোর ঠাকুর পরিবারের আভিজাত্য নেমে আসে তাদের সাজ পোশাকে।
বিএনপিতেও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের গৌরব রয়েছে; তাই মুক্তিযুদ্ধের সুফল কুড়াতে তারাই বা পিছিয়ে থাকবে কেন। তারা দেখেছে কীভাবে আওয়ামীলীগ যে কাউকে পাকিস্তানের দালাল তকমা দিয়ে তার বাড়ি-ব্যবসা দখল করেছে। সুতরাং আওয়ামীলীগের এই নব্য জমিদারদের ভারতের দালাল তকমা দিয়ে কিছু বাড়ি-ব্যবসা দখল করা গেলে মন্দ কী!
বাংলাদেশে সম্পদ দখলে ও লুণ্ঠনে এই পাকিস্তানের দালাল ও ভারতের দালাল তকমা দুটি সবচেয়ে বেশি কার্যকর হয়েছে। ভিখিরির ভাগ্যবদলের নিয়ামক এই ট্যাগিং বা তকমাকলা।
মাঝে নব্বুই-এর গণঅভ্যুত্থানের পর স্বৈরাচারের দালাল তকমা দিয়েও অল্পকিছু সম্পদ, পদ-পদবী, প্লট, পদক দখলের ঘটনা ঘটেছে। ২০২৪ সালের পাঁচ আগস্টে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন ও দেশ লুটান্তে দিল্লির লুটিয়েন্স প্যালেসে আশ্রয় নেওয়ার পর; ফ্যাসিজমের দালাল তকমাটি দিয়ে বেশ কিছু পদ-পদবী দখল করতে দেখা গেছে। ভবিষ্যতই বলে দেবে ফ্যাসিজমের দালাল তকমাটি কী পরিমাণ সম্পদ আহরণে ব্যবহৃত হয়।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন