যিশুখ্রিষ্টের জন্মের আগেই নদী বিধৌত এই জনপদে গড়ে ওঠে আধুনিক নগরী। গাছ-গাছালিতে ঢাকা, পাখি ডাকা এই নগরীতে ছিল অনেকগুলো জিমনেসিয়াম। সেইখানে দার্শনিকেরা আসতেন; বিতর্ক করতেন এই নগর রাষ্ট্রটিকে কীভাবে রিপাবলিক হিসেবে গড়া যায়; তা নিয়ে। সেইখানে কালচার নিয়ে কুস্তি শিক্ষারও ব্যবস্থা ছিল।
পণ্ডিত দার্শনিকদের মাস্টারমাইন্ড বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন মেগাস্থিনিস; তার দ্য ওল্ডেস্ট সিটি অফ মাস্টারমাইন্ডস গ্রন্থে। মেগাস্থিনিস বলেন, এ নগরের সাধারণ মানুষেরা ছিলেন অত্যন্ত ভক্তিপ্রবণ। মাস্টারমাইন্ডদের সঙ্গে পথে ঘাটে দেখা হলে তারা ভক্তিগীতি গাইতেন।
এই নগররাষ্ট্রে তিনটি স্কুল অফ থটের বিকাশ ঘটেছিল বলে উল্লেখ করেছেন পরিব্রাজক হিউয়েন সাং তার ক্ল্যাশ অফ থটস গ্রন্থে। সেখানে বলা হয়েছে, একটি স্কুল অফ থটের মাস্টারমাইন্ড প্রথম সংবিধানের ধারণা প্রবর্তন করেন। তিনি বলেছিলেন, এই সংবিধান হতে হবে বিপ্লবী। দ্বিতীয় স্কুল অফ থটের মাস্টারমাইন্ড মনে করতেন, নিরীহ মানুষের ওপর রাজার কোটালপুত্ররা হামলা করতে গিয়ে জনতার সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হলে, কোটাল পুত্র হত্যার বিচার আগে করতে হবে। কোটাল পুত্রের হাতে নিহত নিরীহ মানুষ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই; নিরীহ মানুষ নিহত হবে; এটা নতুন কিছু নয়। তৃতীয় স্কুল অফ থটের মাস্টারমাইন্ড দাবি করতেন, তারটিই শ্রেষ্ঠতম চিন্তা বা চিন্তার রাজা। এই থটের কাজ ছিল বাকি স্কুল অফ থটগুলোকে খারিজ করে দেওয়া।
এই নগররাষ্ট্রে ঝগড়া সভ্যতা বিকশিত হওয়াতে, সংগীত, নৃত্য, অভিনয় ও সংস্কৃতির অন্যান্য শাখায় চর্চা কমে গিয়ে সংস্কৃতি কর্মীরা সংস্কৃতি নিয়ে ঝগড়াকেই সংস্কৃতি চর্চায় রুপান্তর করে।
এই নগর সভ্যতায় দুটি বিপ্রতীপ ধর্মের উতপত্তি ঘটেছিল। একটি ছিল আকারের আরাধনা, আরেকটি ছিল নিরাকারের প্রার্থনা। ধর্ম বিষয়টি নৈতিকতা চর্চার বিষয় হলেও; নৈতিকতা বাদ দিয়ে শ্রেষ্ঠত্বের দ্বন্দ্বই হয়ে উঠেছিল উভয় গোষ্ঠীর মানুষের জীবন চর্যা। একই নগরের মানুষ; একই তাদের বংশগতি। কিন্তু কেবল আকার ও নিরাকারের দ্বন্দ্বে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে দিন কাটাত তারা।
নগরীর অপেক্ষাকৃত ফর্সা ব্যক্তিরা নিজেদের অভিজাত বলে পরিচয় দিত। এ কারণে নদীর ধারে গিয়ে কাদা-মাটি মেখে শরীরে জামা ঘষে সবাই ফর্সা হয়ে ওঠার চেষ্টা করত।
নগরীর রাজনৈতিক ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে দুটি কবরের সন্ধান পাওয়া গেছে; যাকে প্রার্থনার কেন্দ্র বানিয়ে সেইখানে অশ্রুপাত করে ভাগ্যপরিবর্তনের চেষ্টা করত সাধারণ মানুষ। এই দুটি কবরের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সেখানে গিয়ে চুম্বন করলে সাধারণ মানুষের মাথার চুল স্বর্ণে রুপান্তরিত হতো। সেই স্বর্ণচুল কেটে বিক্রি করে নিতান্ত পথের ভিখারি ধনাঢ্য অভিজাত লোক হয়ে উঠত। তখন ভিখারির স্ত্রীদের নদীর ধারে গিয়ে অনেক বেশি কাদামাটি মেখে ঝামা ঘষে ফর্সা হয়ে ওঠার চেষ্টা করতে হতো।
সংস্কৃতির লোকজন তখন সংস্কৃতি চর্চার পরিবর্তে কবরে চুম্বনকে সৌভাগ্যের প্রসূতি মনে করতে থাকে। একই সঙ্গে সংস্কৃতি ও স্বর্ণ কেশ এসে যাওয়ায় এরা দ্রুতই অভিজাত হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। সেই আড়াই হাজার বছর আগেই এ নগরীতে রুপের আয়নাঘরের বিকাশ ঘটেছিল স্বর্ণকেশীদের ফর্সা বানাতে। রুপচর্চার সময়েও সংস্কৃতি বিষয়ক বচসা ছিল এদের প্রিয় অবসর বিনোদন।
একটি কবরের গদিনশীন এক মহাপরাক্রমশালী নারী শাসক; জনতার বিদ্রোহের মুখে অযোধ্যা পালিয়ে গেলে; তখন মাস্টারমাইন্ডদের যুগ এসে পড়ে। অপর কবরের গদিনশীন মহাপরাক্রমশালী নারী শাসক শারীরিক অসুস্থতায় নিষ্ক্রিয় থাকলে; গদিনশীন হবার প্রস্তুতি নেন তার উত্তরাধিকারী বালক। অন্যদিকে অযোধ্যায় পলাতক শাসিকার উত্তরাধিকারী বালিকার প্রশিক্ষণ চলতে থাকে দণ্ডকারণ্যে।
মাস্টারমাইন্ডদের বিদগ্ধ আলোচনা সাধারণ মানুষের মাথার উপর দিয়ে যেত। তাই আকার ও নিরাকার দুই ধর্ম-রাজনৈতিক গোষ্ঠীর পুকুর-পাতকূয়াতলা ও নদীতীরের বচসা এই জনপদে অধিক জনপ্রিয় হয়ে পড়ে।
যারা কবরে গিয়ে চুম্বন দেয় না; তারা দরিদ্র্য থেকে দরিদ্র্যতর হয়ে পড়ে। আর কবরে চুম্বন করে দ্রুত ধনী হয়ে ওঠা লোকেদের চর্বি স্ফীত হতে থাকে। অনেক পরে বৃটিশ শাসক লর্ড কর্নওয়ালিশ এই চর্বির চিরস্থায়ী বন্দোবস্তী প্রথা চালু করেন।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ১১টি স্থান খুঁড়ে আড়াই হাজার বছর আগের এই প্রত্ন নগরীর সন্ধান পাওয়া গেছে। একই সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ও অর্থনৈতিক বৈষম্য সুদীর্ঘ আড়াই হাজার বছর ধরে রাখার কারণে; এটিকে পৃথিবীর দীর্ঘস্থায়ী প্রাচীন নগরী বলে ইউনেস্কো স্বীকৃতি দিয়েছে। আর ঝগড়া-শাস্ত্রকে এ নগরীর ইনট্যানজেবল কালচারাল হেরিটেজ হিসেবে স্বীকৃতি দেবার প্রক্রিয়া চলছে।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন