দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সারা বিশ্ব থেকে মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। যুদ্ধে বিভিন্নভাবে অবদান রাখলেও অনেকের অবদান কালক্রমে ভুলে গেছে বিশ্ববাসী। সিক্স ট্রিপল এইট এমনই এক ব্যাটেলিয়ন, যা ইতিহাসের পাতা থেকে প্রায় মুছে যেতে বসেছিল। রণক্ষেত্রে না গিয়েও এই ব্যাটেলিয়ন যুদ্ধে বড় ভূমিকা রেখেছিল।
যুদ্ধের সময় ডাক ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনার কারণে সৈন্যদের কাছে লাখ লাখ চিঠি আটকে যায়। ফলে সৈন্যরা নিজেদের মধ্যে এবং পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে পারছিল না, যা তাদের মানসিকভাবে ভেঙে ফেলেছিল। এমন পরিস্থিতিতে সিক্স ট্রিপল এইট নামের এক ব্যাটেলিয়ন মিরাকল ঘটায়।
যুদ্ধের সময় ডাক বিভাগের জটিলতা কাটাতে ইংল্যান্ডে পাঠানো হয় ৮৫৫ জন কৃষ্ণাঙ্গ নারীর একটি ইউনিট, যাদের অবদান এতদিন আড়ালে ছিল। ১৯৪৫ সালে মার্কিন আর্মি এই নারীদের ডাক বিভাগের কাজ ঠিক করার দায়িত্ব দেয়। তাদের দায়িত্ব ছিল ইংল্যান্ডে দুই বছরের ডাক বিভাগের ব্যাকলগ সামাল দেওয়া এবং সৈন্যদের মনোবল বাড়ানো।
দলটির অসাধারণ অবদান
সিক্স ট্রিপল এইটের সদস্যের মার্চ পাস্ট
এই নারীরা একসাথে আমেরিকা থেকে সমুদ্রপথে যুক্তরাজ্যের বার্মিংহামে পৌঁছে ৬৮৮৮তম কেন্দ্রীয় পোস্টাল ডিরেক্টরি ব্যাটেলিয়ন নামে পরিচিত এই ইউনিটে যোগ দেয়। ২৬ বছর বয়সী মেজর চ্যারিটি এডামসের নেতৃত্বে তারা দক্ষতার সাথে বিশাল এই সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখেন। তাদের ছয় মাস সময় দেওয়া হলেও, তারা দিনে-রাতে কাজ করে অর্ধেক সময়েই এক কোটি সত্তর লাখ চিঠি ও পার্সেল বাছাই সম্পন্ন করে।
অবসরপ্রাপ্ত মার্কিন সেনা কর্মকর্তা কর্নেল এডনা কামিংস বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের অবদানের কথা খুব কমই শোনা যায়। এই নারীদের মূলমন্ত্র ছিল: চিঠি না থাকলে, মনোবলও থাকবে না। তারা কাজ শুরু করে বার্মিংহামের কিং এডওয়ার্ড স্কুলে, পরে যায় রুয়েন এবং প্যারিসে। পুরনো যন্ত্রপাতি, সাংস্কৃতিক পার্থক্য, লিঙ্গ বৈষম্য, ঠান্ডা, অল্প আলো, আর গাদাগাদি জায়গায় কাজ করার মতো অনেক চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও, তারা নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করে।
স্বীকৃতি এবং স্মৃতিচারণা
চিঠি গুছাতে ব্যস্ত সিক্স ট্রিপল এইটের নারী সেনা
১৯৪৬ সালে দেশে ফেরার পরেও তাদের সম্মানে কোনো অনুষ্ঠান, প্যারেড বা জনসম্মুখে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। প্রায় ৮০ বছর পর তারা অবশেষে স্বীকৃতি পাচ্ছেন। টেইলর পেরি তাদের গল্প নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন, যা নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাবে। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কানসাসে তাদের সম্মানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হয় এবং ২০২১ সালে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সিক্স ট্রিপল এইট কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল অ্যাক্ট-এ স্বাক্ষর করেন, যা যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান প্রদান করে।
সম্প্রতি তাদের বংশধরেরা ওয়েস্ট মিডল্যান্ডসে গিয়েছিলেন পূর্বপুরুষদের স্মৃতিচারণ করতে। সার্জেন্ট ভার্জিনিয়া এম লেনের স্মৃতিচারণে ড্যানিয়েল সোনিয়া ব্রাউন বলেন, আমার দাদি ইংল্যান্ডে কিছুটা বর্ণবৈষম্যের শিকার হলেও, সেখানে তার সাথে তার নিজের দেশের চেয়ে ভালো আচরণ করা হতো।
এমন একটি ইতিহাস যা আমরা জানি না
সিক্স ট্রিপল এইটের সদস্যদের সামনে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী অফিসার চ্যারিটি এডামস
ইন্ডিয়ানা হান্ট-মার্টিন, ১৯২২ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে তিনি ব্ল্যাক পায়নিয়ার্স অফ নায়াগ্রা ফলসের সদস্য হিসেবে কাজ করেন। তার মেয়ে জানিস মার্টিন বলেন, এই নারীরা শুধুমাত্র সেনাবাহিনীতে নারী এবং আফ্রিকান-আমেরিকান হিসেবে যে বাধা ভেঙেছিলেন, তা আমরা জানি না। মা তার জীবনের শেষ দুই বছর পর্যন্ত নিজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে কোনো কথা বলেননি।
৮৫৫ জন এই নারীর গল্পের প্রভাব গভীর। কিং এডওয়ার্ড স্কুলের আফ্রিকান ও ক্যারিবিয়ান সোসাইটির পরিচালক অলিভিয়া ব্রেচন-স্মিথ বলেন, ৬৮৮৮-এর সম্পর্কে জানা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা জোগাবে।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন