মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আমাদের দেশে চলচ্চিত্রের সংখ্যা অনেক বেশি না–৩৫/৪০টা। কিন্তু নিন্দুকেরা বলেন, দেখার মতো সিনেমা খুব বেশি নেই। আসলেই কি তা?
এখানে এমন কিছু চলচ্চিত্রের কথা বলছি, মুক্তিযুদ্ধের ছবি হিসেবে যেগুলো আপনার না দেখলেই নয়!
১। ওরা ১১ জন (১৯৭২)
‘ওরা ১১ জন’ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা, যা মুক্তি পায় ১৯৭২ সালের ১১ আগস্ট। চাষী নজরুল ইসলামের পরিচালনায় এবং মাসুদ পারভেজ সোহেল রানার প্রযোজনায় নির্মিত এ চলচ্চিত্রে রণাঙ্গন থেকে ফেরা মুক্তিযোদ্ধারা নিজেরাই অভিনয় করেছিলেন। বাস্তবতা আনতে ব্যবহার করা হয় সত্যিকারের গোলাবারুদ, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ এবং এমনকি কিছু রাজাকারকেও ক্যামেরার সামনে আনা হয়। এতে রাজ্জাক, শাবানা, এ টি এম শামসুজ্জামানের মতো অভিনয়শিল্পীরা ছিলেন, আর খোন্দকার নুরুল আলমের সুরে ‘ও আমার দেশের মাটি’ ও ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ গানগুলো দেশপ্রেমের আবহকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে।
২। আবার তোরা মানুষ হ (১৯৭৩)
খান আতাউর রহমান পরিচালিত ‘আবার তোরা মানুষ হ’ মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতা ও তরুণ প্রজন্মের নৈতিক দ্বন্দ্বকে গভীরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বঙ্গবাণী কলেজের সাত তরুণ মুক্তিযুদ্ধের পর সমাজের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই চালালেও নিজেদের নৈতিক সংকট ও হতাশার কারণে পথভ্রষ্ট হয়ে যায়। অধ্যক্ষের আদর্শ ও তরুণদের প্রতিরোধ প্রচেষ্টা চলচ্চিত্রটিতে একটি শক্তিশালী বার্তা দিলেও, তাদের ভেতরের টানাপোড়েন ও সমাজ পরিবর্তনের ব্যর্থতা গল্পের কেন্দ্রবিন্দু। মানবিক মূল্যবোধ, নৈতিক সংকট, এবং সামাজিক অস্থিরতার চিত্রায়ণে সিনেমাটি সময়োচিত ও প্রভাববিস্তারকারী।
৩। আগুনের পরশমণি (১৯৯৫)
হুমায়ূন আহমেদের প্রথম নির্মাণ ‘আগুনের পরশমণি’ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে গড়ে ওঠা এক মর্মস্পর্শী চলচ্চিত্র, এখানে গেরিলা যোদ্ধাদের সংগ্রাম ও ত্যাগকে অসাধারণ দক্ষতায় তুলে ধরেছে। অল্প বাজেটে নির্মিত হলেও এর কাহিনী, নির্মাণশৈলী, চরিত্রের প্রাণবন্ত অভিনয় (আসাদুজ্জামান নূর, বিপাশা হায়াত, ডলি জহুর প্রমুখ) এবং বাস্তবধর্মীতা যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের নির্মম বাস্তবতাকে জীবন্ত করে তোলে। মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই, স্বপ্ন, ত্যাগ এবং স্বাধীনতার জন্য আত্মাহুতি–সব মিলিয়ে ছবিটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রে এক অনন্য মাইলফলক।
৪। নদীর নাম মধুমতি (১৯৯৫)
শুধুমাত্র মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্র নয়, ‘নদীর নাম মধুমতি’কে বাংলা চলচ্চিত্রের সেরা কাজগুলোর মাঝে একটি মনে করেন অনেকে। মূল কাহিনী গড়ে উঠেছে মধুমতির তীরে রসুলপুর গ্রামের তরুণ বাচ্চুকে নিয়ে। বাচ্চু এবং তার অসমবয়সী বন্ধু আখতার মুক্তিযুদ্ধের যোগদান করলেও তার সৎ পিতা (চাচা) মোতালেব, যে রসুলপুর গ্রামের মেম্বারও, যোগ দেয় পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে। সময়ের সাথে সাথে রসুলপুর ও পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো পাকবাহিনী এবং তাদের দোসরদের গণহত্যা-ধর্ষণ-লুটতরাজ-ধ্বংসযজ্ঞ সহ নির্মম অত্যাচারের শিকার হতে থাকে। যে মুক্তিযোদ্ধারা ট্রেনিঙে গিয়েছিলেন তারা ট্রেনিং শেষে অপারেশন করতে দেশে ফিরে আসেন। তারা রাজাকার চেয়ারম্যানকে খতম করার পর নতুন চেয়ারম্যান হয় মোতালেব মেম্বার। গ্রামে হিন্দু ব্রাক্ষণ শিক্ষককে তার রাজাকার বাহিনী হত্যা করে এবং একই সাথে সে শিক্ষকের বিধবা মেয়েটিকে নিজের ঘরে তোলে। মোতালেব চেয়ারম্যানের দৌরাত্ম্য দিনদিন বাড়তে থাকে। সেই এলাকার মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট তাকে খতম করার অপারেশন নিয়ে অস্বস্তিতে পরে কারণ বাচ্চু তাদের দলের একজন সদস্য। যে পিতৃরূপী মোতালেবের হাত ধরে বেড়ে ওঠা তাকে নিয়ে নানা রকম অন্তর্দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকে বাচ্চু। তাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে একটি রাইফেল আর একটি নৌকো নিয়ে রওনা হয় বাচ্চু। শেষ পর্যন্ত কী হয় জানতে হলে দেখতে হবে সিনেমাটি।
৫। হাঙ্গর নদী গ্রেনেড (১৯৯৭)
‘হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’ একটি মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে তৈরি চলচ্চিত্র, যা সেলিনা হোসেনের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত। এই চলচ্চিত্রের গল্প কেন্দ্রিত একটি সন্তানের মা, বুড়ী, যিনি দেশপ্রেমের অগ্নিপরীক্ষায় নিজের সন্তানকে মুক্তিযোদ্ধাদের বাঁচাতে বন্দুকের সামনে দাঁড় করান। চলচ্চিত্রটি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে, যেখানে বুড়ী একটি গ্রামের সাধারণ নারী, কিন্তু যুদ্ধের ভয়াবহতায় তার দেশপ্রেমের পরীক্ষায় সে নিজের সন্তানদের জীবনকে বিপন্ন করে মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন বাঁচাতে আত্মত্যাগ করে। ছবিটি পরিচালনা করেছেন চাষী নজরুল ইসলাম, এবং এর সংলাপ ও গানে সেলিনা হোসেন এবং মুন্সী ওয়াদুদ ও শেখ সাদী খান সৃজনশীল অবদান রেখেছেন।
৬। আলোর মিছিল (১৯৭৪)
মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী একটি পরিবারকে কেন্দ্র করে পুরো ছবির গল্প। যুদ্ধের আগে অল্প বেতনের এক চাকুরে যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে কালোবাজারি ও মজুদদারি করে দ্রুত বড়লোক হওয়ার চেষ্টা করে। বিষয়টি মেনে নেয় না তার স্ত্রী, মুক্তিযোদ্ধা ভাই-বন্ধু কেউই। চারদিকে মজুদদারদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে।
প্রতিবাদ স্তব্ধ করতে হামলা হয়, ঘটনাচক্রে এ বাড়িরই সবার আদরের এক ভাগ্নির মৃত্যু হয়।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নাটক ‘জল্লাদের দরবার’ করে পরিচিতি পাওয়া অভিনেতা নারায়ণ ঘোষ মিতা ‘আলোর মিছিল’-এর পরিচালক। ষাটের দশকেই তিনি পরিচালনায় আসেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে স্বাধীনতার পর যে কৃত্রিম সংকট তৈরির তৎপরতা চলেছিল, তা চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন ছবিতে।
৭। শ্যামল ছায়া (২০০৪)
সময়টা ১৯৭১ সাল , ২৫শে মার্চের কালরাত্রিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে বর্বর পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর । গুলির সাথে লাশ পড়ছে চারিদিকে। দিগ্বিদিক মানুষ ছুটছে একটা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। কিন্তু কোথাও একটা নিরাপদ আশ্রয়ের দেখা নেই। আজ এখানে তো মানুষ কাল আরেক জায়গায়। ঠিকানাবিহীন এক গন্তব্যের উদ্দ্যেশে ছুটে চলছে বৃদ্ধ থেকে শুরু করে মহিলা, শিশু, যুবক, তরুণ সকলে। শুধু খোঁজ একটা নিরাপদ আশ্রয় আর বেঁচে থাকা। অপরদিকে আরেকদল মুক্তিকামী লোক নেমেছে নিজেদের মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করতে। তার জন্যে হাতে তুলে নিয়েছে তারা অস্ত্র। সেই মুক্তিকামী মুক্তিযোদ্ধাদের দলে আছে কৃষক,শ্রমিক, ছাত্র , সাধারণ মানুষ। কিন্তু স্বাধীনতার স্বাদ কি পাবে এই মানুষগুলো? যেখানে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হানাদার বাহিনী। তবুও মুক্তিকামী সেই মানুষগুলোর অদম্য আশা স্বাধীনতার স্বপ্নকে সত্য করতে।
৮। গেরিলা (২০১১)
গেরিলা সিনেমার মূল কাহিনী বর্ণিত হয়েছে বিলকিসকে ঘিরে, যিনি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। সিনেমাটি তার সংগ্রাম, সাহস, এবং দেশের প্রতি ভালোবাসার এক অসামান্য চিত্র তুলে ধরে। বিলকিসের স্বামী হাসান ২৫ মার্চ নিখোঁজ হয়ে যান, তবে বিলকিস সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেননি, বরং মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছেন। তার এই অবদানকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সিনেমায়।
বিলকিসের সাথে সহযোগিতা করেন মিসেস খান, কিন্তু এক ভয়াবহ ঘটনায় মিসেস খান শহীদ হন। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের শেষে পাকিস্তানি আর্মি বিলকিস সম্পর্কে সব তথ্য পেয়ে যায় এবং তাকে ঢাকা ছেড়ে পালানোর জন্য বাধ্য করা হয়। এরপর বিলকিস ফিরে আসে তার গ্রামের বাড়িতে, যেখানে তিনি রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচারে ক্ষত-বিক্ষত মানুষের লাশ এবং নিপীড়িত গ্রামবাসী দেখতে পান।
সিনেমাটি শুধুমাত্র যুদ্ধের ভয়াবহতা নয়, বরং একজন সাধারণ নারীর অনবদ্য সংগ্রামের গল্প বলে। শেষাংশটি অবশ্য দর্শকদের জন্য রয়ে গেছে, যাতে তারা সিনেমার পূর্ণ মর্ম উপলব্ধি করতে পারে। গল্পের গভীরতা এবং চরিত্রগুলোর আবেগনির্ভর অভিনয় দর্শকদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়, যা একটি শক্তিশালী মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র হিসেবে গেরিলাকে স্মরণীয় করে তোলে।
৯। অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী (১৯৭২)
‘ওরা ১১ জন’ এর পর স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তি পাওয়া মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক দ্বিতীয় ছবির নাম ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’। পরিচালকের নাম সুভাষ দত্ত। এই ছবির পোস্টার ডিজাইন করেছিলেন তিনি। অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী ছবির পোস্টারে লেখা ছিল—'লাঞ্ছিত নারীদের মর্যাদা দাও’! ধর্ষিত হয়ে যে সব নারী মা হতে বাধ্য হয়েছিলেন, পৃথিবীতে আসা সেই সব যুদ্ধ শিশুদের বরণ করে নেয়ার তীব্র আকুতি ছিল এই ছবিতে! ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ ছবির সংগীত পরিচালক ছিলেন সত্য সাহা। মোমেনার চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন ববিতা আর আসাদের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন উজ্জ্বল। আপেল মাহমুদের গাওয়া স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের সেই অবিস্মরণীয় গান ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’ এই ছবিতে ব্যবহৃত হয়েছিল।
১০। মুক্তির গান (১৯৯৫)
মার্কিন চলচ্চিত্র নির্মাতা লিয়ার লেভিন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপর একটি ডকুমেন্টারি নির্মাণের অভিপ্রায়ে এদেশের একদল সাংস্কৃতিক কর্মীর সঙ্গ নেন। বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা নামের দলের এই সদস্যরা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের দেশাত্মবোধক ও সংগ্রামী গান শুনিয়ে উজ্জীবিত করতেন। এই শিল্পীদের সাথে থেকে লেভিন প্রায় ২০ ঘণ্টার ফুটেজ সংগ্রহ করেন। যুদ্ধের শেষ দিকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান। আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তিনি ডকুমেন্টারি তৈরি করতে পারেননি।
দীর্ঘ দুই দশক পর ১৯৯০ সালে তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদ নিউইয়র্কে লেভিনের কাছ থেকে এই ফুটেজ সংগ্রহ করেন। এ থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য তারা আরো বিভিন্ন উৎস থেকে মুক্তিযুদ্ধের নানা সংরক্ষিত উপাদান সংগ্রহ করেন, বিশ বছর আগের সেই শিল্পীদের সাথে যোগাযোগ করেন। লেভিনের কাছ থেকে প্রাপ্ত ফুটেজের সাথে সংগৃহীত অন্যান্য উপাদান যোগ করে ছবিটি নির্মিত হয়।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন