দ্য ইকোনোমিস্টের চোখে ২০২৪-এর সেরা দেশ হিসেবে বাংলাদেশের স্বীকৃতি লাভ খুবই স্বাভাবিক একটি ঘটনা। আমাদের সবার চোখের সামনে এই ইতিহাস রচনা করেছে বাংলাদেশের সবচেয়ে কমবয়েসী ছেলে-মেয়েরা। মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু শহিদ আবু সাঈদের এই জীবন মুদ্রা বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের পরিচয় তুলে ধরে। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীরা, যাদের সরকারি চাকরির কোটা-অকোটার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই; যারা কখনও বিসিএস পরীক্ষায় বসবে না; তারা যখন জীবন উৎসর্গ করেছে বাংলাদেশের ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম স্বৈরশাসকের পতন ঘটাতে; তখন স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল; এরা বৃটিশ বিরোধী সংগ্রাম ও পাকিস্তান বিরোধী মুক্তিযুদ্ধের জাতিস্মর।
বাংলাদেশের ভারত সমর্থিত আওয়ামীলীগ সরকার ও রাজনীতি যে দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য ঝুঁকি; এটা বাংলাদেশের সবচেয়ে কমবয়েসী নাগরিকেরা বুঝতে পেরেছিল। পিঠে পূর্বপুরুষের রক্তজবার চিহ্ন নিয়ে চিলড্রেন অফ দ্য সয়েল গুলি খেয়ে একজন মাটিতে লুটিয়ে পড়লে; বাকিরা ঠায় দাঁড়িয়ে থেকেছে মাতৃভূমিকে মুক্ত করতে।
পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম অন ক্যামেরা মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছেন মোদি সমর্থিত শেখ হাসিনা। এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল হত্যা দৃশ্যের ভিডিও ভেরিফাই করে গোটা পৃথিবীকে জানিয়েছে হাসিনার মাংসের কারবার সম্পর্কে। ইন্টারনেটের আয়নায় গোটা পৃথিবীর মানুষ দেখেছে কীভাবে নির্বিচারে শিশু, কিশোর- কিশোরী, তরুণ-তরুণীকে হত্যা করেছে হাসিনার খুনে বাহিনী। কীভাবে ভারতীয় মিডিয়া নিহত তরুণদের মৌলবাদির তকমা দিয়েছে। কীভাবে বাংলাদেশের হাসিনা সমর্থিত সংস্কৃতি মামা-খালারা রক্ততৃষ্ণা প্রকাশ করেছে সন্তানের বয়েসীদের শিকারে।
ভারতের হিন্দুত্ব মৌলবাদি মিডিয়া ও রাজনীতিকেরা বাংলাদেশকে ইসলামি মৌলবাদি দেশ হিসেবে পৃথিবীর সামনে চিত্রায়িত করতে মিথ্যা প্রোপাগান্ডার স্ট্রিপটিজ করেছে। হিন্দুত্ববাদী বজরং দল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, ইসকনকে বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণায় নামিয়েছে এমেরিকা, ক্যানাডা, বৃটেনের পথে পথে। এসব ক্যানিবাল কালচারের অবিরত ডিসপ্লে দেখে; পশ্চিমারা আরও নিশ্চিত হয়েছে জুলাই বিপ্লবের শক্তি সম্পর্কে। দ্য ইকোনোমিস্ট তাই কান্ট্রি অফ দ্য ইয়ারের অভিজ্ঞান দিয়েছে এই অভাবনীয় তারুণ্যের উত্থানকে।
একটি বিপ্লবের পর পতিত ফ্যাসিস্টের পোড়ামাটি নীতিতে ফেলে যাওয়া দেশে অর্থনৈতিক পুনর্গঠন, প্রশাসন ঢেলে সাজানো, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জ রয়েছে, হিন্দুত্ববাদী সমর্থিত হাসিনা শাসনে নির্যাতিত ইসলামপন্থীদের এই বিপ্লব পরবর্তী খোলা হাওয়ায় ভারতের হিন্দুত্ববাদের আদলে বাংলাদেশে ইসলামপন্থা গড়ার ভ্রান্তস্বপ্নের কোলাহল থাকতে পারে; কিন্তু নোবেল বিজয়ী ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ শ্রেয়তর উদারপন্থার দিকে হাঁটছে বলেই দ্য ইকোনোমিস্ট অভিমত প্রকাশ করেছে।
ভারতীয় মিডিয়ার ক্রমাগত সাম্প্রদায়িক উস্কানির পরেও; ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা মন্দির পাহারা দেওয়া, যে কোনো বছরের চেয়ে শান্তিপূর্ণ দুর্গাপূজা নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সন্দেহভাজন হিন্দুত্ববাদ সমর্থিত আওয়ামীলীগের সন্ত্রাসীদের হাতে চট্টগ্রামে মুসলিম আইনজীবী নিহত হবার পর, হিন্দু ও মুসলমান জনগোষ্ঠী দায়িত্বের সঙ্গে শান্তি বজায় রাখা; অনেক প্রতিকূলতার মাঝেও একটি বহুত্ববাদী সমাজের সম্ভাবনা মেলে ধরে।
হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসনের সুবিধায় হঠাৎ রুলিং ক্লাস ও এফলুয়েন্ট ক্লাস হয়ে ওঠা লোকজনের ৫ আগস্ট-এর পরে সবকিছুই অত্যন্ত তেতো লেগেছে। পনেরো বছর মানবাধিকারের ব্যাপারে স্পিকটি নট থেকে ৫ আগস্ট সাঁঝ থেকে যে সংস্কৃতি মামা ও খালাদের মুখে মানবাধিকারের খই ফুটেছে; এটাই বা কম কীসে! কিন্তু আর সেই গণভবনের পিঠাপুলির আসর, কলকাতায় চেক ইন দিয়ে সরকারি কবিদের কবিতার আসর, বঙ্গভবনে ইদে সেমাইয়ের দাওয়াত, প্লট-পদক-পদবীর সেই হরষে দোল খাওয়ার দিনগুলো আর ফিরে আসবে না; যেমন ফিরে আসেনি কর্নওয়ালিশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমিদারি পাওয়া মধ্যস্বত্বভোগীদের বাইজির আসর; ঝাড়বাতিতে কৃষকের রক্তে জ্বালা উজ্জ্বল পিদিম। সেই দিন আর নেই দিনের আলো রাতের তারার মাঝে। যে দিন ছিল তা একেবারেই গেছে; সেই বাস্তবতা মেনে নিতে না পারলে আওয়ামীলীগ সহমত ভাই-শিবব্রত দাদা-ললিতাদি-আনারকলি আপা ক্ষয়ে যাবে ফেসবুকের পাগলাগারদে।
বাস্তবতাকে মেনে নিতে না পেরে আওয়ামীলীগের সমর্থকদের ভিডিও বার্তায় জুলাই বিপ্লবের তরুণদের গুপ্তহত্যার নির্দেশ এসেছে। ভারতের মিডিয়ায় এই তরুণদের প্রতি যে আক্রোশ প্রকাশিত হয়েছে; তা এ পর্যন্ত গুপ্তহত্যার স্বীকার কয়েকজন জুলাই বিপ্লবী্র হত্যাকারীদের এভিডেন্সিশিয়াল প্রুফ হিসেবে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। এইসব গুপ্তহত্যার দ্রুত তদন্ত করতে হবে; জুলাই বিপ্লবের পরাজিত শক্তির যে সন্ত্রাসী স্লিপিং সেল গুপ্তহত্যায় সক্রিয় রয়েছে; তাদের প্রতিহত করতে হবে।
আমরা জানি, ভারতের বিজেপি, কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিটি রাজনৈতিক দলের বাংলাদেশ নীতি অভিন্ন। বাংলাদেশকে অধীনস্থ একটি দেশ হিসেবে দেখতে চাওয়ার যে ভ্রান্ত কল্পনা; তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে ভারতের রাজনৈতিক ও সেনাপ্রশাসনকে।, বাংলাদেশ হচ্ছে রহস্যজনক চোরাবালির মতো। এখানে বৃটিশ ও পাকিস্তান উপনিবেশ আধিপত্য কায়েম করতে এসে তলিয়ে গেছে। ভারতকে তাই ঔপনিবেশিক অহম থেকে বেরিয়ে এসে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সমমর্যাদার ভিত্তিতে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি ওয়ার্কিং রিলেশন গড়ে তুলতে হবে।
বাংলাদেশ ও ভারত নাগরিক পর্যায়ে মেলামেশা ও সংলাপ বাড়াতে হবে; যাতে অন্ধ-অক্ষম ক্ষমতা-কাঠামোর তৈরি করা বিদ্বেষের ঢেউয়ে এন্টি বাংলাদেশ সেন্টিমেন্ট ভোটের বাক্সে তাসের খেলায় নষ্ট জোকারের মতো না নাচে। ৭৮ বছরে কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না করে, দেশ লুণ্ঠন করে, বৈষম্য তৈরি করে; রাতে মসজিদের নিচে মন্দিরের স্বপ্ন দেখে তারপর হিন্দু-মুসলমান কাইজ্জা বাধিয়ে ব্যস্ত রেখে; জারি রাখা হয় শোষণযন্ত্র। কৃষক ও কর্মসংস্থানহীন যুবক আত্মহত্যা করে। সরকারঘন বণিকের ছেলের বিয়েতে বলিউড নাচে; আর ফুটপাথে নিয়ন আলোর নীচে ঘুমিয়ে থাকে দারিদ্র্যে বিশীর্ণ মানুষ; যারা নদীতে অপরিকল্পিত বাঁধ আর বনভূমি উজাড় করে শিল্পায়ন-দরিদ্র উচ্ছেদে ভেসে আসে নিয়ন জ্বলা মহানগরীতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গ্রাউন্ড জিরো থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে জার্মানি প্রতিষ্ঠা করেছে বৈষম্য মুক্তির সামাজিক গণতন্ত্র। আর প্রায় একই সময়ে স্বাধীন হওয়া ভারত শাসন-শোষণ-ভাষণ-দক্ষিণ এশিয়ায় দাদাগিরির কল্পনায় তৈরি করেছে বৈষম্য বিধুর মলিন এক জনগোষ্ঠী। কাজেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অনধিকার চর্চা না করে ৭৮ বছর বয়েসী সোশিও- ইকোনোমিক্যালি চ্যালেঞ্জড শিশু অবস্থা থেকে পরিণত সমাজ-অর্থনীতি গড়ার কাজে মন দিতে হবে।
বাংলাদেশকে পৃথিবীর কেউ ভারতের হিন্দুত্ববাদী লেন্সে দেখবে না। প্রত্যেকটি দেশের নিজস্ব চোখ আছে। যে চোখে ২০২৪-এর সেরা বিপ্লবী রাষ্ট্র বাংলাদেশ।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন