জাফর ইকবালের বুদ্ধিবৃত্তিক ফ্যাসিজমের জবাব

৩৫১ পঠিত ... ১৭:৪০, অক্টোবর ২১, ২০২৪

28 (21)

যে ব্যক্তি লিখে বা বক্তৃতায় কোন মতবাদ প্রকাশ করেছেন; তার উত্তর লিখে বা বক্তৃতাতেই দিতে শিখতে হবে আমাদের সমাজকে। কারও লেখা কিংবা বক্তব্যে বিক্ষুব্ধ হয়ে তাকে শারীরিক আক্রমণ করা বা তার বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে কারাগারে প্রেরণ; অত্যন্ত অযৌক্তিক পন্থা।

ফ্যাসিস্ট হাসিনা ভিন্নমত প্রকাশের উত্তর লিখে কিংবা বক্তব্যে না দিয়ে; ভিন্নমত প্রকাশকারীকে গুম, খুন করে কিংবা কারাগারে নির্যাতন করে অথবা গোয়েন্দা সংস্থা লেলিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে কালো অধ্যায় সূচনা করেছেন। তিনি নিজে টেলিভাইজড অশ্লীল বক্তব্য রেখেছেন ভিন্নমত প্রকাশকারীর উদ্দেশ্যে; আরাফাতকে দিয়ে সাইবার গ্যাং বানিয়ে সিপি গ্যাং-এর চ-বর্গীয় গালাগালিতে বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজকে গোবর ছুঁড়েছেন। এই গোবরডাঙ্গা আওয়ামী কালচারের আরেকটি উইং ছিলো গোয়েন্দা সংস্থা, হারুনের ভাতের হোটেল ও মনির জঙ্গী থিয়েটার গ্রুপ। কাউকে প্রতিপক্ষ মনে হলেই গোয়েন্দা সংস্থাকে দিয়ে গুম-খুন করে, মনিরকে দিয়ে জঙ্গী সাজিয়ে গ্রেফতার করে, হারুনকে দিয়ে ভাতের হোটেলে ভীতিপ্রদর্শন করে; পৃথিবীর নিকৃষ্টতম ফ্যাসিস্ট হিসেবে ইতহাসে নিজেকে কুচিহ্নিত করেছেন। আর ভিন্নমত দমনের এই অপকৌশলে দলীয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আইকন ব্যবহার করে; ইতিহাসের আদরনীয় দুটি বিষয়কে ভীতির চেহারা দিয়েছেন স্বৈরাচারী হাসিনা।

সমস্যা হচ্ছে, গত সাড়ে পনেরো বছরে সমাজ মনস্তত্বে হাসিনার উগ্র সাবহিউম্যান কালচার প্রভাব ফেলেছে। ২০০৮-এর তুলনায় ২০২৪-এর সমাজ তাই অনেক বেশি অসহিষ্ণু। ফলে পাশার দান উলটে গিয়ে হাসিনার গোবরডাঙ্গা ক্ষমতা পালটে গেলেও; সমাজ মননে ছড়িয়ে থাকা  হাসিনার দলান্ধ প্রতিশোধপরায়ণতা দৃশ্যমান হচ্ছে।

হাসিনা ১৯৭৫ সালে তার পিতা সপরিবারে নিহত হবার প্রতিশোধ নিয়েছেন একটি পুরো জাতির ওপরে। পোস্ট ট্রমাটিক ডিজ অর্ডারের রোগী ছিলেন তিনি। ঐ রোগে তিনি পুরো সমাজকে আক্রান্ত করেছেন ভীতির দিনরাত্রিতে জীবন্মৃত প্রজা হিসেবে কোনমতে বেঁচে থাকার ট্র্যাজেডিতে। আর তার দল আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্টের দোসর হিসেবে গত দেড় দশকে ক্যানিবাল হয়ে উঠেছে। এই ক্যানিবালেরা গণভবনে গান গেয়েছে, পার্টি অফিসে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কেক কেটেছে; গেরুয়া বসন পরে প্রগতিশীলতার সনদ বিতরণ করেছে। প্রতিশ্রুতিশীল বুদ্ধিজীবীদের প্লট-পদক-পদের মূলো ঝুলিয়ে ফ্যাসিজমের তেলাঞ্জলির আসরে বিদূষক করে তুলেছে।

কপোট্রনিক সুখ দুঃখের লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল তার বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তার কাছাকাছি যেতে না পেরে হাসিনার কাছাকাছি গেছেন, আদুরে ভঙ্গিতে বলেছেন, একটু শ্লোগান দিই আপা। মুক্তিযুদ্ধে যাবার বয়সে ‘রাজাকার’ ও ধর্মপন্থী আত্মীয়ের বাসায় লুকিয়ে থাকার শ্লাঘাতেই কিনা জানিনা; হাসিনার ফ্যাসিজমের আঁচলের তলে বসে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বপ্রণোদিত ম্যানেজার হয়েছেন। কথায় কথায় ধর্মপন্থীদের জঙ্গী তকমা দিয়েছেন। সবশেষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-ছাত্রীদের ‘রাজাকার’ তকমা দিয়েছেন। একই রকম ঘটনা ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুনের ক্ষেত্রে ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধে যাবার বয়সে, পাকিস্তানি সরকারের সেবায় নিয়োজিত প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী আত্মীয় মহিউদ্দীন খান আলমগীরের বাসায় আরামে কাটিয়েছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হলেই নিরাপদ তন্দ্রা ভেঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গবেষক হয়ে, দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তিতে বিভাজিত করেছেন। অধ্যাপক ইকবাল ও অধ্যাপক মামুন দুজনের আত্মপরিচয়ের সংকট কিংবা গিলটি ফিলিংস তাদের হোলিয়ার দ্যান দাও করেছে।

ঠিক তাদের বয়েসী আমার মামা শহিদ মুক্তিযোদ্ধা শিবলী; অনার্সে ফার্স্টক্লাস পেয়েছিলেন; বেঁচে থাকলে অধ্যাপক কিংবা গবেষক হতেন। মুক্তিযুদ্ধে তার সম্পৃক্ততা ও পারিবারিক সমর্থনের কারণে পরিবারের আরও চারজন পাকিস্তানের খুনে মিলিটারির হাতে খুন হন। এই পরিবারের বেঁচে যাওয়া সদস্যরা কখনো বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কাছে তাদের রক্তের প্রতিদান চাননি। স্বপ্রণোদিত হয়ে কোন দলীয় নেত্রীর আঁচলের ছায়ায় গিয়ে বসেননি। যুদ্ধে স্বামী হারিয়ে বিধবা হয়ে যাওয়া খালা কষ্টেসৃষ্টে নিজের চার সন্তানকে বড় করেছেন। এলাকার মানুষ যতটুকু পারে ঐ সামর্থ্যে এই পরিবারকে শ্রদ্ধা জানাতে সারদা পুলিশ একাডেমির পাশে শহীদ শিবলী সড়ক নির্মাণ করেছে। বাংলাদেশে প্রতিটি শহীদ পরিবারের ইতিহাস একই রকম। তারা কেউ মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি চায়নি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বপ্রনোদিত ম্যানেজার হয়নি। হাসিনার ফ্যাসিজমের সারিন্দা হয়নি।  

কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ না করেও অধ্যাপক ইকবাল ও অধ্যাপক মামুন হয়ে উঠেছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিবেক। হাসিনার আশেপাশে ও ফেসবুকে যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাহুবলীদের দেখেন; এদের কারো পরিবারে মুক্তিযুদ্ধে রক্ত ও ত্যাগ নেই। ঢাকা শহরে মিডিয়াজেনিক শহীদ পরিবারের কটি সন্তানকে আঁচলের তলায় নিয়ে তাদের ফ্যাসিজমের এনাবলার করেছেন চতুর হাসিনা।

এখন এই যে ইকবাল কিংবা মামুন, এরা জুলাই গণহত্যায় উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন, বিবৃতি প্রকাশ করেছেন। আমার ধারণা তাদের মতো ফ্যাসিজমের বিদূষকদের সঙ্গে বিতর্ক করার মতো অসংখ্য মেধাবী মিলেনিয়াল বুদ্ধিজীবী দেশে তৈরি হয়েছে; যাদের মুক্তিযুদ্ধ গবেষণার অভিজ্ঞতা রয়েছে। কল্যাণরাষ্ট্র-সুশাসন সম্পর্কে সম্যক ধারণা আছে তাদের। জেনজিদের মধ্যে রয়েছে অসংখ্য বিতার্কিক, কার্টুনিস্ট, মিমার, গায়ক, গ্রাফিতি শিল্পী; যারা জুলাই বিপ্লবে জাফর ইকবাল, মুনতাসির মামুন ও হাসিনার ফ্যাসিজম এনাবলার ব্রিগেডকে ধরাশায়ী করেছে তাদের শৈল্পিক কাউন্টার হেজিমনিতে।

কাজেই ইকবাল বা মামুনদের গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ অনেকটা হাসিনার শফিক রেহমান কিংবা মাহমুদুর রহমানকে কারাগারে প্রেরণের মতো দেখায়। ফরহাদ মাজহারকে গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে নিঃগৃহীত করার মতো দেখায়। বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিপক্ষতার জবাব বুদ্ধিবৃত্তিক প্রক্রিয়ায় না দিয়ে শক্তিপ্রয়োগ একটি অত্যন্ত ভুল কৌশল। এটি অন্তহীন প্রতিশোধলীলার রেসিপি।

প্রচলিত আইনে গোয়েবলসের মতো ফ্যাসিস্ট প্রচারণার দায়ে কারো কি রকম আইনি শাস্তি হতে পারে তা বিবেচনা করবেন আদালত। তবে আওয়ামী লীগে ছাত্র-জনতা হত্যার আদেশদাতা ও ফ্যাসিজমের সরাসরি অপারেটিভ অপরাধীদের সংখ্যাই অনেক; তাদের বিচার প্রক্রিয়াই কঠিন একটি কাজ। সেইখানে ফ্যাসিজমের বিদূষক বুদ্ধিজীবীদের বিচারের অধীনে আনলে এই খেলনা বুদ্ধিজীবীদের গুরুত্ব অপ্রয়োজনে অনেক বেড়ে যাবে বলে মনে হয়।

আওয়ামী লীগের  বুদ্ধিজীবী হচ্ছে বেড়াল প্রকৃতির জিনিস; এরা তারস্বরে চিৎকার করে কেঁদে পাড়া মাতাতে ওস্তাদ। তারচেয়ে বরং আওয়ামী লীগের হিংস্র শৃগালগুলোকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা যাক। এদের শাস্তি দেখে যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার সাহস না দেখায়।

৩৫১ পঠিত ... ১৭:৪০, অক্টোবর ২১, ২০২৪

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top