নাচো রুমি নাচো

১২৭ পঠিত ... ১৬:৪০, ডিসেম্বর ৩০, ২০২৪

32

বসফরাসের বুকে অলৌকিক সে নৌযান; কয়েকটা সী-গাল এসে মাস্তুলে বসে। ভেতরে সুরম্য নগরীর মতো কোলাহল। গোটা পৃথিবীর মানুষ এসে জড়ো হয়েছে সে ভাসমান আনন্দগৃহে। বাদ্যযন্ত্রের মুহুর্মুহু শব্দ পানপাত্রের টুংটাং আওয়াজের মাঝে নীল চোখের এক নর্তকী রহস্যময় সাঁঝটাকে হাত ধরে নিয়ে যায় অনন্তলোকে; হুইরলিং দরবেশের মতো যখন অনন্তের দিকে তাকায়, সবার দৃষ্টি ঠিক সে দিকে যায়। হাতের মুদ্রায় সে যখন গোলাপ ফোটায়; তখন সে সৌরভ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। গুড়িয়ার ইন্দ্রজালে আচ্ছন্ন হয় চারদিক। নাচের মুদ্রায় জিজ্ঞেস করে, এখানে ওখানে ইতিউতি কোথায় খুঁজছো স্বর্গটাকে; সে তো তোমার মস্তিষ্কে।

গুড়িয়া লক্ষ্য করে একটা লোক অন্যমনষ্কভাবে বসে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে। সে এখানেই আছে কিন্তু এখানে নেই। সে কোলাহলের মাঝে বসে পানপাত্র থেকে চুমুকে চুমুকে নীরবতা পান করছে। গুড়িয়া সামান্য এগিয়ে এসে ঠিক তার সামনে দাঁড়িয়ে নাচে। তবু তার ধ্যান ভাঙ্গাতে না পেরে এক হাত তার কাঁধে রেখে আর এক হাতের মুদ্রায় একটি গোলাপ ফুটিয়ে তার হাতে দেওয়ার ভঙ্গি করে। গুড়িয়ার বাদামি চুলের দারুচিনি সৌরভ এসে তাকে বর্তমানে নিয়ে আসে। মনের ছুটি থেকে ফিরে সে রহস্যময় হাসি হাসে। অনেকদিনের পরিচিত হাসি। খোরাসানের ঘুড়ি ওড়ানো শৈশবে দুষ্টু বালকটি আরেকজন বালিকার ঘুড়ি কেটে যেমন করে হাসত। বালিকাটি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বালকটির পিতার কাছে গিয়ে নালিশ করেছিল, জালাল রোজ রোজ আমার ঘুড়িটাকে আকাশ থেকে জমিনে নিয়ে আসে।

লোকটা নাচের আসর থেকে উঠে নৌযানের ডেকে দাঁড়িয়ে সীগালের গান শোনে। তারার আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবে সেই দিনটির কথা যেদিন মোঙ্গলেরা অতর্কিতে হামলা করেছিল তাদের গ্রামে। দূর থেকে মোঙ্গলদের ঘোড়ার বহর দেখে সে দৌড়ে গিয়েছিল মাদ্রাসায় যেখানে তার পিতা ছাত্র পড়াচ্ছিলেন। শিক্ষক ও ছাত্রদের দার্শনিক সংলাপের বিঘ্ন ঘটানোর সাহস পাচ্ছিল না। শ্রেণীকক্ষের দরজায় উৎসুক উদভ্রান্ত মুখে বালককে দাঁড়িয়ে দেখে শিক্ষক প্রশ্ন করেন, কিছু কি বলতে চাও!

: মোঙ্গলেরা ধেয়ে আসছে; আমি তাদের ঘোড়ার ক্ষুরের আওয়াজ শুনেছি; তাদের আগমনে ধুলিময় উত্তর-পূর্ব আকাশ দেখেছি।

সেদিন মোঙ্গলদের হামলায় খোরাসানে যে শরণার্থীদের ঢল নেমেছিল; সেখানে ঘোড়ার গাড়ির জানালায় এসে বালকটি বালিকাকে বলেছিল, যদি আরেকবার ঘুড়ি ওড়ানোর খোলা আকাশ পাই; আমি আর কখনোই তোমার ঘুড়ির সুঁতো কেটে দেব না। এই আমার মাথার দিব্যি।

গুড়িয়া তখন বিড় বিড় করে নিজের সঙ্গে কথা বলা লোকটির পেছনে দাঁড়িয়ে। সে বলে, আরবসাগর থেকে পারস্য সাগর হয়ে ভূমধ্যসাগর; গুড়িয়ার নাচ পছন্দ করেনি; এমন কাউকে পাইনি। তুমি কি জানো না জলসাঘর থেকে উঠে এলে শিল্পীর অপমান হয়।

: যখনই কোনো অপমানে তোমার মনে কোনো ক্ষত তৈরি হয়, বুঝে নিও সেদিক দিয়ে স্বর্গের আলো আসে।

: তুমি দেখছি একদম আমার আব্বার মতো করে কথা বলো।

: তাই নাকি! উনাকে আমার সালাম দিও।

: তাহলে আকাশের কোনো একটা তারাকে বেছে নিয়ে তাকে সালাম দাও। আমার আব্বা বেঁচে নেই।

: তিনি নিশ্চয়ই তোমার মধ্যে বেঁচে আছেন।

: তিনি তো তাই চেয়েছিলেন। আমাকে তিনি তার মনের মতো করে বড় করেছিলেন। ফারসি, ইংরেজি দুটোই শিখিয়েছিলেন। আর পাশতু আমার মাতৃভাষা। তিনি স্কুল শিক্ষক ছিলেন। খান আবদুল গাফফার খানের কাছে সাম্যবাদে দীক্ষা নিয়েছিলেন। তিনি খুব সুন্দর গাইতেন। পার্টির বিপ্লবী গান গাইতে তার ডাক পড়ত। আমাদের বাড়িতে তাই নাচ-গানের চল ছিল। আমি ক্লাস ফোরে পড়ার সময় গান গেয়ে ও নেচে স্কুলে রীতিমতো তারকা হয়ে গিয়েছিলাম। উত্তর ওয়াজিরিস্তানের সবুজ পাহাড়ের ঢালে আমি প্রজাপতির মতো নেচে বেড়াতাম। এলাকার সবাই আমাকে রাজকুমারি বলত। আব্বাকে তো সবাই শিক্ষাগুরু হিসেবে মাথায় করে রাখত। আমাদের জীবন ছিল সাইফুল মুলুক হ্রদের জোতস্নাভরা রুপকথার মতো সুন্দর।

: তোমার খোরাসানের সেই সবুজ পাহাড়ের ঢালে ঘুড়ি ওড়ানোর দিনের কথা মনে নেই। আমি যখন তোমার ঘুড়ির সুতো কেটে দিলে তুমি আমার বাবার কাছে গিয়ে ছিঁচকাঁদুনে রাজকুমারির মতো বলতে, ওস্তাদজি, জালাল রোজ রোজ আমার ঘুড়ি কেটে দেয়। ঐ যে যেদিন মোঙ্গলদের হামলায় আমরা হানাফিরা শরণার্থী হলাম, আমি তো তোমার ঘোড়ার গাড়ির জানালায় গিয়ে বলেছিলাম, আর কখনও তোমার ঘুড়ির সুঁতো কেটে দেব না।

গুড়িয়া হাসে, হাসতেই থাকে; সে হাসি আছড়ে পড়ে বসফরাসের সুনীল জলে। হবে হয়তো সে কোনো অন্য জনমে। কিন্তু এই জনমে আফঘান মুজাহিদেরা হামলা করেছিল আমাদের গ্রামে। আমাদের স্কুল বন্ধ করে দিয়েছিল। মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। আমার আব্বাকে তারা হুমকি দিয়েছিল, আর যদি কোনোদিন আমাদের গৃহ থেকে গান-বাদ্যের শব্দ শোনা যায়; তাহলে তারা পুড়িয়ে দেবে এলাকার সব বাড়ি ঘর। ক্লাস ফাইভে থাকতেই স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমার সবুজ রঙ্গা ঘাগরা চোলি পরে আর কোনোদিন নাচতে পারিনি পাহাড়ের সবুজ ঢালে। কালো কাপড়ের অবগুণ্ঠনে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল আমার শৈশব।

লোকটার মন খারাপ হয়ে যায়। টিস্যু এগিয়ে দেয় গুড়িয়াকে। সে চোখের কোণাটা মুছে বলে, তুমি কি আজনবি হয়েই রয়ে যাবে। তোমার কি কোনো পরিচয় নেই।

: তেহেরানে এক কবি আমার বাবাকে বলেছিল, ওস্তাদজি আপনি হচ্ছেন সাগর, আর আপনার পেছনে দাঁড়ানো কিশোরটি হচ্ছে সমুদ্র। আমায় সমুদ্র বলেই না হয় ডেক!

: রহস্য কোরো না। তুমি কি সি আই এ এজেন্ট নাকি মোসাদ! এইখানে কি কোনো যুদ্ধের কারবার করতে এসেছ। আফঘানিস্তানে যেরকম যুদ্ধের কারবার করে আমাদের মতো ছোটোখাটো মানুষের জীবন থেকে কেড়ে নিয়েছিলে, সংগীত ও বাদ্য।

: আমি তো সংগীত ও বাদ্যের মানুষ। গীতিকবিতা লিখি। বাইজেনটাইন, রোমান, পারস্য, তুর্কী শব্দ দিয়ে তৈরি করি মসনবি। আমি অন্তর্গত যুদ্ধের কথা লিখি, যে যুদ্ধে জিতলে মানুষ আর কখনও হন্তারক হতে পারে না!

গুড়িয়া এবার স্টিমারের রেলিঙে বসে। আকাশের দিকে তাকায়। লোকটার চোখে চোখ রাখে। গুড়িয়ার নীলচোখে তখন আবিষ্কারের আনন্দ। অনেকদিন পর একটু রহস্যময় লাগছে। তবু রহস্য না ভেঙে গুড়িয়া তাই বলে, এখন মনে হচ্ছে আমি খোরাসানে তোমার সঙ্গে ঘুড়ি উড়িয়েছি। তোমাকে মহল্লার লোকেরা অলৌকিক শিশু বলত। তুমি একটু অন্যরকম ছিলে। একা একাই হাঁটতে পাহাড়ের ঢালে। ঘুড়ি ছিঁড়তে আর কীসব বলতে গাছেদের, ফুলেদের। খানিকটা পাগলছাঁট ছিলে।

একথাটা বলে রিনি রিনি হাসিতে গুড়িয়া ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যাবার জোগাড় হলে, তাকে ধরে রেলিং থেকে নামিয়ে একটা চেয়ারে বসিয়ে দেয় লোকটি।

লোকটি এবার মাস্তুল পিছে রেখে খানিকটা হুইরলিং দরবেশের ভঙ্গি করলে গুড়িয়া মুচকি হেসে আঙ্গুল নাচিয়ে বলে, নাচো রুমী নাচো।

গুড়িয়া (পর্ব-১) 

(চলবে)

১২৭ পঠিত ... ১৬:৪০, ডিসেম্বর ৩০, ২০২৪

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি


Top