সুকুমার রায়ের বিখ্যাত নাটিকা অবাক জলপান। জলতেষ্টা পাওয়া এক পথিক এক গ্রামে এসে চারদিকে জল খুঁজে বেড়াচ্ছে। যাকে দেখছে তাকেই জিজ্ঞেস করছে, একটু জলপাই কোথায় বলুন তো?
অনেকদিন ধরেই আমাদের এমন সংস্কার তেষ্টা লেগেছে। ভ্যাট বিরোধী আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, কোটা সংস্কার আন্দোলন… গত ১৫ বছরে এমন নানান আন্দোলনে একটা ফেস্টুন বেশ দেখা গেছে—রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ চলছে, সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত। বুকের ভেতর সংস্কারের তেষ্টা নিয়ে আমরা সবাই সবাইকে জিজ্ঞেস করছি, একটু সংস্কার কোথায় পাই বলুন তো।
সলিমুল্লাহ খান বলেছেন, উপরতলায় সংস্কার এনে তো লাভ নাই। সংস্কার আনতে হবে নিচের তলায়। অর্থাৎ মানুষের প্রতিদিনের জীবনে সংস্কার আনতে হবে। সুকুমার রায়ের পথিককে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম, একটু সংস্কার খোঁজার আশায়।
উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়ার প্রোফাইলে গিয়ে দেখি সেখানে সংস্কার ঝুলে আছে। উত্তরবঙ্গ সফরে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে উত্তরবঙ্গে ৫০ লক্ষ, ৫০ লক্ষ, ২০ লক্ষ এমন নানান পরিমাণের উন্নয়ন বরাদ্দ ঘোষণা করা হয়েছে। এই অনুদানের একটি ফটোকার্ড ঝুলতে দেখা গেছে তার প্রোফাইলে। সেখানে একটি, দুটি না। তিনটি ছবি আসিফের। দেখে মনে হলো, আসিফের গ্রাফিক ডিজাইনারের ইমিডিয়েট সংস্কার দরকার। সরকারি বরাদ্দে উপদেষ্টার ছবি ঘটা করে প্রচার করলে সেটি আর নতুন বন্দোবস্ত হয় না, পুরোনো বন্দোবস্ত বুকে আঁকড়ে ধরার লক্ষণই প্রকাশ পেয়ে যায়। এই বেসিক সংস্কারের একটা বন্দোবস্ত আসিফ মাহমুদের গ্রাফিক ডিজাইনারের হওয়া উচিত।
শুধু কি ডিজাইনারের? আসিফ মাহমুদের ফেসবুক পেজের অ্যাডমিনেরও তো সংস্কারের দরকার আছে।
রাহাত ফাতেহ আলী খানের কনসার্টের দিন আসিফ মাহমুদ কী যেন একটা ভিডিও আপলোড করছিলেন। সেখানে জুলাই অভ্যুত্থানের কয়েকজন ঠিকাদারের ছবি ব্যবহার করে গ্রেটেস্ট অফ অলটাইম বা এমন কোনো ধরনের ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে। যে শিল্পকর্মটি দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি, তার আগেই সমালোচনার মুখে ডিলেট করে গাজী রাকায়েত স্টাইলে কাজের ছেলে অর্থাৎ অ্যাডমিনের উপর দোষ চাপিয়ে ডিলেট করা হয়েছে। এই দোষ চাপানোর সংস্কৃতির সংস্কারেরও তো দরকার আছে। আর কতকাল সকল দোষ পেজ অ্যাডমিনের উপর চাপানো হবে? কিছু দোষ এবার পেজ মডারেটরের উপর চাপানো হোক।
অনেকে বলবেন, সংস্কার তো আসিফেরও দরকার আছে। নতুন বন্দোবস্তের যে সংস্কারের কথা ওনারা বলছেন, এই সংস্কার তো ওনার এইসব কর্মকান্ডে দেখা যাচ্ছে না। আমি বলবো, এই ধরনের কুতর্ক করবেন না। আসিফ একজন জ্ঞানী মানুষ। ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক। ওনাকে সংস্কারের পরামর্শ দেয়ার সাহস আপনারা পান কোথায়?
ফেসবুকে ঘোরাঘুরি করলাম। মাহফুজ আলমের ফেসবুকে গিয়ে কিছু ইংরেজি স্ট্যাটাস পড়লাম। ইংরেজিতে দুর্বল বলে তেমন কিছুই বুঝলাম না। নিজের অপারগতায় মনে হলো, একটু সংস্কার তো মাহফুজ আলমের পেজবুক পেজের অ্যাডমিনেরও দরকার। সেই সংস্কারের পর যদি মাহফুজের কথা আমরা আমজনতা একটু বুঝতে পারি। অনেকে আবার বলতে পারেন, স্ট্যাটাস স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছেন কেন? ইংরেজিতে স্ট্যাটাস দিবে নাকি বাংলাতে নাকি হিব্রুতে সেটা যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। বলতে পারেন। যুক্তি মেনে না নিলে চুপও করিয়ে দিতে পারেন। তবে মনের ভেতরের অ্যাডমিনটা তো বাধ মানে না। বলে দিতে চায়, মাহফুজ নতুন দিনের নেতা। রাজনীতি করবেন। দেশ গঠনে কাজ করছেন। তার ভাবনা তো আমার ও আম পাবলিকের বুঝার দরকার আছে।
কার কথা আর কী বলবো। প্রধান উপদেষ্টার ফেসবুক পেজে গিয়ে দেখি ওনার অ্যাডমিনেরও সংস্কার দরকার। ওনার অ্যাডমিনও আবার শ্যামলদত্তের মতো ইংলিশ ছাড়া কথা বলেন না আরকি!
কেউ কেউ বলতেই পারেন। আম পাবলিক ইংলিশ শিখে নিলেই তো পারে। তাছাড়া এখন তো চ্যাট জিপিটি আছে, গুগল ট্রান্সলেট আছে। ট্রান্সলেট করে পড়ুক। মাহফুজের আর প্রধান উপদেষ্টার তো ঠ্যাকা পড়ে নাই যে আম জনতাকে সবকিছু বুঝাতে হবে। এই যুক্তিকেও ফেলে দেয়া যায় না।
কবি হাসান রোবায়েত বলেছিলেন, আমরা কথা বলি, কারণ নিরবতা ফ্যাসিস্টের ভাষা। মাহফুজ আলমের ফেসবুক আইডিতে গেলে আমার নিজেকে ফ্যাসিস্ট মনে হয়। তার কমেন্টবক্সে বন্ধ, নিরবই থাকতে হবে। এই কমেন্টবক্সেরও একটা সংস্কার দরকার আছে। জুকারবার্গের সাথে মাহফুজের কিসের শত্রুতা যে মাহফুজের কমেন্টবক্স বন্ধ করে রাখতে হবে? হারামজাদা জুকারবার্গকে ধরে ওর কিছু নাটবল্টুতে সংস্কার মেরে দেয়া উচিত।
সংস্কার নিয়ে চারদিকে নানান হইচই তো আছেই। কেউ বলছেন, সংস্কার কই? কী সংস্কার করতেছেন? দেখা যায় না কেন? আর কত সময় লাগবে? আজীবন সংস্কার করবেন নাকি?
তবে হাসনাত আবদুল্লাহ অবশ্য এইসব বিতর্কের উর্ধে। তিনি এইসব প্রশ্ন নিয়ে পড়ে থেকে সময়ক্ষেপণ না করে নিজেই সংস্কারের কাজে নেমে গেছেন। একজন কর্মঠ মানুষ। একটি টেলিভিশন চ্যানেলে গিয়ে তাদের মালিককে হাসনাতের নিজস্ব একটি সংস্কারপত্র ধরিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, এদের বাদ দেন। এটাই সংস্কার। ছেলেটাকে দিয়ে হবে। সংস্কারের কাজ এই ছেলেকে দিয়েই হবে। হাসনাত আবদুল্লাহরাই আমাদের সংস্কারের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেবেন।
জামাত-শিবিরও দেখলাম সংস্কার কাজে হাত দিয়েছে। কুমিল্লায় এক মুক্তিযোদ্ধার গলায় সংস্কার পরানোর মধ্য দিয়ে তারা তাদের সংস্কার যাত্রা শুরু করেছেন। শিবির অবশ্য আরও একধাপ এগিয়ে। শাহবাগের বাসিন্দাদের গোসল নিয়ে তাদের ব্যাপক চিন্তা। ঠিক করেছেন, গোসল দিয়েই সংস্কার শুরু করবেন। জাতীয় জাদুঘরে তাদের এক প্রোগ্রামে শাহবাগীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, শাহবাগী, গোসল কর! গোসলের মতো একটা গুরুত্বপুর্ণ বিষয়েও যে সংস্কারের দরকার আছে, সেটা বোঝার জন্য শিবিরকে ধন্যবাদ। ধন্যবাদ অবশ্য তারা নেবে না, তাদেরকে বলতে হবে মোবারকবাদ।
মাঠেঘাটেও সংস্কার নাই। বাসস্ট্যান্ট, ট্রাকস্ট্যান্ড থেকে মাছ বাজার। কাঁচাবাজার থেকে শুরু করে ফুটপাত। সব ব্যবসায়ীরা ষড়যন্ত্র করে বিএনপি নেতাদেরকে জোর করে চাঁদা দিচ্ছেন। এতে বিএনপির নাম খারাপ হচ্ছে। এই ধরনের কর্মকাণ্ডেরও তো সংস্কারের দরকার আছে? বিএনপির মতো একটা নিষ্পাপ দলের নেতাকর্মীদেরকে এভাবে জোর করে চাঁদা ধরিয়ে দিয়ে ব্যবসায়ীরা কী প্রমাণ করতে চায়? দলটা খারাপ? আওয়ামীলীগের মতোই চাঁদাবাজি করে? এইসব অসাধু ব্যবসায়ীদেরকে চেপে ধরে দুই চামুচ সংস্কার খাওয়ানো দরকার।
কিছু সংস্কার তো আওয়ামীলীগেরও দরকার। তাদের সংস্কার দরকার হৃদয়ে। তারা এখনও যেভাবে স্বৈরাচার, গণহত্যাকারী আপাকে নিজেদের হৃদয়ে একচ্ছত্র আধিপত্য দিয়ে বসে আছেন, এইসব হৃদয়েও তো একটু সংস্কারের বন্দোবস্ত দরকার। নতুন বাংলাদেশে কি দলটি স্বৈরাচারকে হৃদয়ে রেখেই ঘুরে বেড়াবে? সেটা কি ঠিক হবে? সংস্কার, অনুশোচনা কি তাদেরকে কোনোদিনই স্পর্শ করতে পারবে না?
সংস্কার যে একদমই কোথাও হচ্ছে না এমন কোনো কথাও আসলে বলা যাবে না। বিপিএলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভালোই সংস্কার হয়েছে। আগে কোটি টাকা খরচ করে ভারতীয় শিল্পী আনা হতো, এবার কোটি টাকা খরচ করে পাকিস্তানি শিল্পী আনা হয়েছে। এই সংস্কারই বা কম কীসে! সামনে আরও বেশি টাকা খরচ করে আমরা আমেরিকান শিল্পীও নিয়ে আসব ইনশাল্লাহ!
সংস্কার বিষয়ে আমার এক নাস্তিক বন্ধুর কথা দিয়েই লেখাটা শেষ করি। সে আমাকে একদিন বললো, দোস্ত, দেশের সংস্কার নিয়ে ভাবতে গেলে ইচ্ছে করে বিশ্বাসী হয়ে যাই। ওপরের দিকে তাকিয়ে বলি, ইয়া মাবুদ, আমাদেরকে একটু সংস্কার দাও।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন