লেখা: হাসনাহেনা বৃষ্টি
বাংলাদেশে বেশিরভাগ পুরুষ মানুষের একটা পছন্দের কাজ হচ্ছে, স্ত্রীকে নিয়ে বন্ধুমহলে, পরিবারে কিংবা যে কোনো গ্যাদারিঙে ঠাট্টা করা। বলাই বাহুল্য এই ঠাট্টার বেশিরভাগ হয়ে থাকে অপমানজনক। রসিকতার ছলে একটা সাটল চেষ্টা কোনো ম্যাসেজ দেওয়ার যে ওনার স্ত্রী অমুক বিষয়ে অপরিপক্ক, তমুক বিষয়ে অজ্ঞ। পুরুষেরা এক ধরনের আনন্দ পান অন্যকে তাচ্ছিল্য করে নিজেকে সুপেরিয়র প্রমাণ করার এই চেষ্টাটার ভেতরে। এই জিনিসের যখন মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, সাইকোলজির ভাষায় এটা তখন পার্সোনালিটি ডিজর্ডার এর আমব্রেলা টার্মে পড়ে। সাধারণত স্যাডিস্ট বা নার্সিসিস্ট মানুষ এই ধরনের কাজকর্ম করে আনন্দ পায়।
এই কাজটা পুরুষ শুধু স্ত্রী বা প্রেমিকার ক্ষেত্রে করে এমন বললে ভুল হবে, যাদের এই অভ্যাস আছে, সুযোগ পেলেই আশপাশের যে কোনো নারীর ক্ষেত্রেই এরা এটা করে থাকে। এই ধরনের পুরুষ মানুষ ক্ষেত্রবিশেষে আরও একটা কাজ করে, সরাসরি পার্ভার্সন এক্সপ্রেস করা। এটা করার পরে তারা আশা করে অপরপক্ষ থেকে হয়ত ব্যাপারটা কন্টিনিউ করার ইশারা পাবে। ঠিক যে মুহূর্তে তারা বুঝতে পারে দ্বিপাক্ষিকতার কোনো সম্ভাবনা নেই, তখন তারা ব্যাপারটাকে ঠাট্টা বলে চালিয়ে দেয়।
আমার নিজের তিনটে অভিজ্ঞতার কথা বলি, আমি এই তিন ব্যক্তির শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উল্লেখ করছি শুধুমাত্র তাদের সামাজিক অবস্থান বোঝানোর জন্য।
প্রথম ব্যক্তি, সাবেক বুয়েটিয়ান, আমেরিকার এক স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পোস্ট ডক্টরেট করছেন, এক কন্যা সন্তানের বাবা। একবার আমি একটা স্টোরি দিলাম ফেসবুকে এরকম যে এক গ্লাস দুধে ছোটোবেলার মতো এনার্জি বিস্কুট ডুবিয়ে খাচ্ছি। এই ব্যক্তি আমাকে ম্যাসেজ দিলেন, 'খেতে চাই, কিন্তু কারটা খাব?' আমি ওনাকে রিপ্লাই দিলাম উনি কী বলতে চাচ্ছেন পরিষ্কার করে বলার জন্য। উনি তখন বললেন, 'মানে গরুর দুধ খেতে ভালো নাকি ছাগলের দুধ খেতে ভালো?' আমি ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম, 'আপনি গরু নাকি ছাগলের দুধ খাবেন এটা জানতে আমাকে ম্যাসেজ দিয়েছেন?' উনি তখন উত্তর দিলেন, 'জানতে দেইনি, এটা একটা রেটরিক্যাল কোশ্চেন, ফান।' আমি বললাম, 'আপনার কী মনে হয় আপনার সাথে আমার এই রেটাওরিক্যাল কোশ্চেন করার মতন সম্পর্ক?' উনি প্রথমে ত্যানা প্যাচাতে থাকলেন, পরবর্তীতে ভয়ে স্যরি বললেন।
দ্বিতীয় ব্যক্তি সলিমুল্লাহ মেডিকেলের ডাক্তার, এক কন্যা সন্তান এবং এক পুত্র সন্তানের বাবা। আমার বান্ধবীর বিয়েতে আমার আর বান্ধবীর একটা ছবি আপলোড দিলাম স্টোরিতে উনি রিপ্লাই দিলেন, 'ইলিশ মাছের পেটির মতন পেট।' আমি ওনাকে বললাম ওনার এই ধরনের অব্জেক্টিফাই করে কথা বলাটা আমার পছন্দ হয়নি। উনি আমাকে সরাসরি তখন দোষারোপ করতে শুরু করলেন, আমি ফান বুঝি না, আমাকে উনি এত স্টুপিড ভাবেন নাই, সামান্য এইটুকু হিউমার না বুঝলে কেন ফেসবুক চালাই। ওনার এই আনঅ্যাপোলোজেটিক আচরণে বিরক্ত হয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিলাম। উনি আমাকে নানারকম হুমকি দিলেন, আমার বাসা উনি চেনেন ইত্যাদি ইত্যাদি৷ তো আমি ওনাকে বললাম যা খুশি করতে, আমি থানায় মামলা করব। উনি পরদিন সাজ্জাদের ফোন নাম্বার যোগাড় করে কল দিয়ে বললেন, 'বৃষ্টি ছোটো মানুষ, আমার কথাটা অন্যভাবে নিয়ে ফেলেছে, আমি সেভাবে বলিনি।'
তৃতীয় জন জাহাঙ্গীরনগরের সাবেক ছাত্র, এখন ফেসবুক ইনফ্লুয়েন্সার। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। ওনার সাথে ক্যাম্পাসের পরিচিত লোকজনের মাধ্যমে পরিচয়, একদিন একসাথে সবাই আড্ডা দেওয়ার পরে বাসায় ফিরছি। আমার বাসা তখন পলাশী, ফুলার রোড দিয়ে হেঁটে চলে আসা যায়। উনি বললেন, 'সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে, চল তোকে পৌছে দিয়ে আসি, আমি বুয়েটের দিকেই যাব।' ওনার সম্বোধন শুনলে বুঝতে পারবেন ওনার সাথে আমার সম্পর্কের রেসপেক্টের জায়গা থেকে আমি ওনাকে আপনি করে বলি, এবং আমি ওনাকে তুই সম্বোধন করবার অনুমতি দিয়েছি। তো আমি মেনে নিলাম। ফুলার রোডের মাঝামাঝি যাওয়ার পরে উনি হঠাৎ করে কথা বলতে বলতে আমার কাঁধের ওপর দিয়ে হাত তুলে দিয়ে বুকের কাছে নামিয়ে নিয়ে আসলেন। আমি তড়িৎবেগে সরে গেলাম এবং বললাম ওনার এই আচরণ আমার পছন্দ হয়নি। উনি হাসতে হাসতে বললেন, 'তোর কি ধারণা আমি তোকে মলেস্ট করব?'। আমি সেদিন একাই বাসায় ফিরে গেলাম। ব্যাপারটা আমি ওনার বন্ধুকে জানালাম যার মাধ্যমে ওনাকে আমি চিনি। তিনি তখন ব্যাপারটাকে 'হাসি তামাশা ছিল', উনি আমাকে 'চমকে' দিতে চাচ্ছিলেন ইত্যাদি নানান গুগোবর বলে চালানোর চেষ্টা করলেন। পরদিন ফেসবুকে বিরাট স্ট্যাটাস প্রসব করলেন এই মর্মে যে বাংলাদেশের মেয়েরা আধুনিকতার নাম নেয় শুধু, কিন্তু আড্ডায় ছেলেমেয়ে পাশাপাশি বসলে যে স্বাভাবিক স্পর্শ সেটা নিতে পারে না, কারণ এরা কমপ্লেক্সে ভোগে যে ওদেরকে ছোঁয়ার জন্যে ছেলেরা সারাক্ষণ উশখুশ করতে থাকে।
তো সাধারণত ফেসবুকে অন্য লোকজনকে নিয়ে লেখালেখি ধরনের কাজে আমি সময় নষ্ট করি না। তবে গত দুইদিন ধরে ফেসবুকে একটা ব্যাপার দেখলাম কনসার্নিং। এক ব্যক্তি মেয়েদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে একটা স্ট্যাটাস দিলেন, মেয়েরা রাজনীতি বোঝে না, মেয়েদের উচিত অ্যাবিউজিভ প্রেমিকের কোলে গিয়ে বসে থাকা ইত্যাদি। সেই ব্যাপারে যখন প্রিয়তি মেয়েটা পোস্ট দিল, এবং সবাই সমালোচনা করতে শুরু করল, তখন সেই ব্যক্তি প্রিয়তিকে 'স্টুপিড' ডেকে আবার একটা লেখা লিখলেন। সেখানে জানালেন হিউমার না থাকার কারণে হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে এবং উনি আরও একটি লিস্ট করে দিলেন মেয়েদের সেন্স অব হিউমার বাড়াতে কী কী বই পড়া উচিত।
ওনার অনেক অনুসারী দেখলাম আমার নিজের ফ্রেন্ডলিস্টেরই, নারী-পুরুষ দুই-ই আছেন। তারা ওনার সাথে একমত হয়ে প্রিয়তিসহ দেশের সমস্ত মেয়েমানুষ যে বোকা আর ওনারাই যে একমাত্র রম্য উপন্যাস পড়েছেন সেটা বোঝাতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। তো আপনারা যারা আরও অনেকে এই চিন্তার অধিকারী, আমি একটা জিনিস আপনাদের নিশ্চিত করতে পারি, যদি আপনি মনসুর আহমেদ, মুজতবা আলী বা শিবরাম চক্রবর্তী পড়েই থাকেন, স্যাটায়ার আর হিউমিলিয়েশন একই ব্যাপার এই স্টেটমেন্টে আপনার কনভিন্সড হওয়ার কথা না। রম্য লেখকেরা নানান জন ও মতকে ক্রিটিসাইজ করে থাকেন, ওনারা হিউমিলিয়েট করেন না। আপনাদের মায়েদের কাছে শুনলে জানতে পারবেন, আপনার বাবার করা কিছু কিছু রসিকতা ওনার গায়ে লেগে থাকে রসিকতা হিসেবে নাকি অপমান হিসেবে? জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন ওই ধরনের রসিকতার পাত্রী হতে ওনারা পছন্দ করতেন কিনা। জিরো গ্রাউন্ডে কাউকে তাচ্ছিল্য বা হেয় করার পর সেটাকে যদি স্যাটায়ার সংজ্ঞা দিয়ে আপনার পিঠ বাঁচাতে হয়, একজন লেখক এবং ক্রিটিক হিসেবে আপনার অপারগতাই সেখানে হাইলাইটেড হয়।
নিজে সুপ্রিমেসি কমপ্লেক্সে ভুগে যদি আশপাশের যে কাউকে নিয়ে রসিকতার নামে অপমান অপদস্ত করে কিংবা পার্ভার্সন দেখিয়ে আপনি আনন্দ পান, এটা একটা সমস্যার কথা। আপনার আশপাশের মানুষের জন্যেই কেবল না, আপনার নিজের জন্যেই। এরকম চলতে চলতে একসময় বুঝতে পারবেন আপনি আসলে নিজেকে যেমন ভাবেন, আপনি তার কিছুই না। আপনি দুর্বল, অথবা পার্ভার্ট এবং সেই দুর্বলতা ঢাকতে অন্যকে ছোটো করে, ব্যঙ্গ করে, কুৎসিত ইঙ্গিত করে রসিকতার নামে চালিয়ে দিয়ে আনন্দ পান। এই ধরনের স্যাডিজম বা নার্সিসিজমের ভবিষ্যত ভালো হয় না।
হিউমিলিয়েশন এবং সারকাজম দুটো ভিন্ন জিনিস। ক্রিটিসিজমের একটি কনভেনশনাল উপায় সার্কাজম হলেও এখানে একটি ফাইন লাইন আছে। লাইনটি অতিক্রম হলেই আপনার সারকাজম আর সারকাজম থাকবে না। হয়ে যাবে হিউমিলিয়েশন। সুতরাং আপনার হিউমারের উপর লক্ষ্য রাখুন কোনো ফাঁকে তা হিউমিলিয়েশন হয়ে যাচ্ছে কি-না...
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন