‘বাজেট আসলেই দাম বেড়ে যায়’ নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও খেটে খাওয়া অধিকাংশ মানুষের জন্য বাজেটের অর্থ এইটুকুই। কিন্তু বাজেট মানেই কেন আতঙ্ক? কারণ বাজেট পরিকল্পনাই ঠিক করে দেয় এক বছরের জন্য পুরো একটি দেশের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা কী সুখের হবে নাকি অভাবের। আর বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা দেখলে খুব সহজেই বলে দেওয়া যায়, নতুন বাজেট পরিকল্পনায় সাধারণ মানুষের সুখী হওয়ার সুযোগ ঠিক কতটা।
জাতীয় সংসদে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। মূল্যস্ফীতি হ্রাস, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমানো এবং রাজস্ব আদায়ের পাশাপাশি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনাই এবারের বাজেটের মূল চ্যালেঞ্জ। তবে সরকার দেশের অর্থনৈতিক অবস্থায় ভারসাম্য আনতে গিয়ে তার নেতিবাচক প্রভাব সাধারণ মানুষের ওপর ফেলছে না তো? তাই আসুন দেখে নেই কেন আপনারও উচিৎ বাজেট নিয়ে মাথা ঘামানো।
বাজেট এলেই কেন দাম বেড়ে যায়?
বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেয়া তথ্য বলছে, আমাদের বিদেশি ঋণ ১০০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছে গত ডিসেম্বরেই। অর্থাৎ ডলার প্রতি মূল্য ১১০ টাকা করে হিসেব করলে বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে নেয়ার ঋণের পরিমাণ প্রায় এগারো লাখ কোটি টাকা। এই ঋণ শোধ করার পন্থা হল রাজস্ব আদায়, রপ্তানি ও রেমিটেন্স আয় বাড়ানো। রাজস্ব আদায়ের মাধ্যমে সরকার যে আয় করে, এ বছর তার চাপ বিশাল পরিমাণে পড়তে যাচ্ছে সাধারণ জনগণের ওপর।
সরকারের ঋণের পরিমাণ যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে ডলারের দাম। ফলে বছরের পর বছর ধরে ঋণ পূরণে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। অন্যদিকে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাড়ছে আমদানি পণ্যের বাজারমূল্য। আমদানি পণ্যে কর আরোপের কারণেও বাড়ছে বাজারমূল্য। ফলে দেশের বাজারে হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। যার ঘানি টানছেন সাধারণ মানুষ। ফলে একদিকে যেমন নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যে কর আরোপের কারণে দাম বাড়ছে, তেমনি মূল্যস্ফীতির কারণেও বাড়ছে দাম। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা পড়ছেন দূর্ভোগে। তাই বর্তমানে জনগণের কাছে নতুন বাজেট মানেই দাম বাড়া, যা এক আতঙ্কের নাম।
করের বোঝা টানছে সাধারণ মানুষ
এবারের নতুন বাজেট সাধারণ মানুষের জন্য তেমন কোনো সুখবর বয়ে আনছে না। বরং এবারের বাজেটে সাধারণ মানুষের ওপর করের বোঝা বাড়ছে। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে টানাপোড়েনে চলছিলেন মধ্যবিত্তরা। আর খেয়ে-না খেয়ে চলছিলের দরিদ্র মানুষেরা। তবে এবারের বাজেটে প্রতিদিনের জীবনযাপনে ব্যবহৃত হয় এ রকম নানা পণ্য ও সেবার ওপর বাড়তি কর এসেছে। মানুষের জীবনধারণ যখন ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে, তখন স্বস্তি দেওয়ার জন্য সাধারণত করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হয়। কিন্তু এবার তা–ও বাড়ছে না।
কর বেড়েছে কিন্তু আয়?
নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যে কর বাড়ছে, কিন্তু বাড়ছে না মানুষের আয়। মূল্যস্ফীতি কিংবা ইনফ্লেশনের সঙ্গে মিলিয়ে মানুষের আয় বাড়েনি। তাই ইনকাম যা, খরচ এখন তার দ্বিগুণ। যেমন ধরুন ফার্মগেটের হকার জনি মিয়ার কথা। ২০০৯ সালে বরিশাল থেকে ঢাকায় এসে ফুটপাতে গেঞ্জির ব্যবসা শুরু করেন তিনি। এরপর ২০১৮-১৯ সাল পর্যন্ত মোটামুটি স্বাচ্ছন্দ্যেই চলছিল তার। কিন্তু এরপর থেকে এখন পর্যন্ত আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে হিমশিম খেয়ে চলেছেন তিনি (সূত্র: দ্য ডেইলি স্টার)।
সূত্র: বণিক বার্তা ডিজিটাল
অন্যদিকে বৈধ আয়ে সর্বোচ্চ কর ৩০%। কিন্তু কালো টাকা সাদা করলে কর ১৫%। নগদ টাকা ১৫ শতাংশ কর দিয়ে বিনা প্রশ্নে বৈধ বা সাদা করা যাবে। একইভাবে জমি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট কিনেও এলাকাভেদে নির্দিষ্ট হারে কর দিয়ে টাকা সাদা করা যাবে। ফলে কালো টাকার মালিকরা খুব সহজেই দিতে পারবে কর ফাঁকি।
বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি ও বিদ্যুতের দাম বেশি
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির উচ্চমূল্য এবং বর্ধিত ক্যাপাসিটি পেমেন্টের কারণে বিদ্যুৎ আমদানিতে সরকারকে দিতে হয় ভর্তুকি। এবারের বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি কমলেও বাড়বে বিদ্যুতের দাম। সরকার আগামী তিন বছর বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে যাতে ভর্তুকি প্রত্যাহার করা যায়।
যেসব পণ্যে বাড়ানো হল শুল্ক কর
নতুন বাজেটের ব্যায়ের যোগান দিতে দাম বাড়তে পারে ফ্রিজ এবং এসির। এছাড়াও মোটরসাইকেল, পানীয় থেকে শুরু করে বাড়তে পারে মুঠোফোনে কথা বলার খরচও।
বিশেষায়িত হাসপাতাল বিশেষ শুল্কছাড়ে চিকিৎসাযন্ত্র ও সরঞ্জাম আমদানির সুযোগ পেত। হার ছিল ১ শতাংশ। বাজেটে ২০০টিরও বেশি চিকিৎসাযন্ত্র ও সরঞ্জাম আমদানির ক্ষেত্রে তা বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হতে পারে। ফলে চিকিৎসাসেবা মূল্য বাড়িয়ে দিতে পারে হাসপাতালগুলো।
সংসদ সদস্যদের গাড়িতে শুল্ককর
সংসদ সদস্যদের আমদানি করা গাড়ির ওপর ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক বসানো হয়েছে। বর্তমানে জাতীয় সংসদের সদস্যরা কোনো শুল্ককর ছাড়াই গাড়ি আমদানি করতে পারেন। ৩৬ বছর ধরে এই সুবিধা পেয়ে আসছেন তাঁরা। ফলে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে এই কর সংযোজনে সরকার ও জনগণ সকলেই লাভবান হবে।
বোঝা কী টানবে শুধু মধ্যবিত্তরাই?
মানুষের জন্যে নিত্যপণ্য এখন বিলাসী পণ্য। উচ্চবিত্তদের থেকে সঠিকভাবে কর আদায়, বাজারমূল্য ও দূর্নীতি নিয়ন্ত্রণে না থাকলে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা যেমন আসবে না, তেমনি সাধারণ মানুষের দূর্ভোগ কখনও কমবে না। জনগণ ইতোমধ্যে যে পরিমাণ টাকা ঘুষ হিসেবে দিচ্ছেন তা যদি সরকার পায় এবং জনগণের কাছ থেকে যথাযথ কর আদায় করা যায়, তাহলে সরকারের আয় অনেক বেড়ে যাবে। অন্যদিকে আমদানি শুল্ক কমিয়ে পণ্যে দাম কমানোর চেষ্টায়ও সুফল মিলছে না। শুল্ক কমানোর সুফল কিছু আমদানিকারক ব্যবসায়ী নিয়ে যাচ্ছেন।
ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এম কে মুজেরি ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘কম ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ কষ্টে আছেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে কম ও মধ্যম আয়ের মানুষের ওপর চাপ না বাড়িয়ে রাজস্ব আদায়ের উদ্ভাবনী পথ খুঁজে বের করতে হবে।’
অর্থনীতিবিদেরা আরও বলছেন, আগামী বাজেটে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই হবে সরকারের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। এ জন্য একগুচ্ছ সমন্বিত নীতি নিতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তায় জোর দেওয়ার পাশাপাশি শহরাঞ্চলের শ্রমিকদের জন্য রেশনিংয়ের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতির কারণে যেহেতু বাচ্চাদের পুষ্টির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, সেহেতু তাদের জন্য স্কুলে বিনা মূল্যে খাদ্য কর্মসূচি চালু করা দরকার।
সূত্র: প্রথম আলো, দ্য ডেইলি স্টার, বণিক বার্তা ডিজিটাল
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন