লেখা: তানিয়া নূর
যে কোনো গান শুনে আমরা মোটামুটি কয়েক ধরনের মতামত দিতে পারি। ভালো হয়েছে, একদমই মন্দ, অথবা মোটামুটি। অথচ আমাদের যে কোন বিষয়ে প্রতিক্রিয়া আর ঘৃণা ছড়ানোর অভ্যাসটা কেবলই আমাদের জাতিগত তীব্র হতাশা দেখানোর উপায় মাত্র। কোনোকিছু আমার ভালো লাগছে না, পছন্দ হচ্ছে না, সেটা বলেই চুপ থাকতে আমরা আসলেই পারবো না, শিখবো না। কারণ, আমরা সব কিছুই আমাদের রঙে ভাবতে পছন্দ করি। অন্য কোন রঙ মানেই কুৎসিত এইই তো?
ব্যক্তিগতভাবে নজরুল সংগীত ও শাস্ত্রীয় সংগীতের শিক্ষার্থী হিসাবে লম্বা পথ পাড়ি দেয়ার অভিজ্ঞতা থেকে এটুকু বলতে পারি, শুধু নিজের ভালো লাগা মন্দ লাগাকে একেবারে জাতীয় অনুভূতির পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, প্রতিবাদ পাঠানো, ক্ষমা চাওয়ানোটাকে আমার স্রেফ হাস্যকর লাগছে। মনে হচ্ছে ছুটির দিনে এ আর রাহমান কে আঘাতের সহজ টার্গেট করছি আমরা।
নজরুলের জনপ্রিয় অসংখ্য গানের সুর তার নিজের করা নয়। নজরুলের গানের স্বরলিপির সংরক্ষণ নিয়েও অনেক মতভেদ আছে। এখনো বাংলাদেশে আর পশ্চিম বাংলার বিখ্যাত একেক শিল্পীকে দেখা যায় প্রচলিত গানের বিভিন্ন রকম স্বরলিপিতে বিভিন্ন সুরে গাইতে। রাগাশ্রয়ী গানে ক্ষেত্রে তো বলার অপেক্ষাই রাখে না। আর নজরুলের জীবদ্দশায় তিনি গান লিখেছেন, সুর অথবা রেকর্ড করেছেন মূলত কোলকাতায়, চর্চাও বেশি হয়েছে সেখানে। আজও হয় আসলে।
এ আর রাহমান 'কারার ঐ লৌহ কপাট' গানের নতুন এ ভার্সনের সুরকার আর কম্পোজার হিসাবে তার দায়ও স্বীকার করেছেন۔۔আর তিনি তো আর সব ত্রুটির ঊর্ধ্বে গিয়ে সংগীতের খোদা হয়ে যাওয়ার দাবী করেননি কখনও। নাকি করেছেন?
মির্জা গালিবের গজলের কত ধরনের ভার্সন গাওয়া হয়েছে বলেন দেখি? সেটা নিয়ে তো কাউকে মাতম করতে দেখা যায় না। আমাদের যে কোনো বিষয়ে এই যে অন্যের মত নিতে না পারার প্রবণতা সেটা আমাদের ক্রমশ আরো জগত থেকে বিচ্ছিন্ন করে কুয়োর ব্যাঙ বানিয়ে তুলছে। আমি যা বুঝি, জানি, জেনেছি সেটাই সবটুকু না মিললেই আমাদের তুলতুলে অনুভূতির কাবা আর মন্দির টলমল করে। আর এ ধরনের সাংস্কৃতিক মৌলবাদ আর মেরুকরণ আমাদের বহু সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ব্যর্থতার মূল কারণ।
একটা গান বাজে করে কেউ গাইলেই আমাদের গেলো গেলো মাতম ওঠে কারণ আমরা নিজেদের সক্ষমতা নিয়ে সন্দিহান। নজরুলের গান একজন ভিনদেশী ভিন্নভাষী কম্পোজার নতুন সুরে বাঁধলে নজরুল কে অপমান করা হবে বলে যারা মনে করছেন, আমার মনে হয় না আপনারা নজরুলের ব্যাপকতা বুঝতেও পেরেছেন। নজরুলের প্রতিটা কাজ যদি যথাযথ সংরক্ষণ করে বিশ্ব দরবারে পৌঁছে দেয়া যেত তাহলেই তাকে যথার্থ সম্মান জানানো হতো। কিন্তু আমরা তো আজও বিশ্বজনীনতা বুঝতে পারিনি। অথচ নজরুল/রবীন্দ্রনাথ কিন্তু ঠিক বুঝেছিলেন। আমাদের তথাকথিত প্রতিক্রিয়াশীল সাংস্কৃতিক মৌলবাদ ক্রমশ বাঙালি সংস্কৃতিকে জনবিচ্ছিন্ন করেছে, রুচির অবক্ষয় ঠিক সেখান থেকেই। আমাদের অনুভূতির কাবা অথবা মন্দিরে আঘাত তো তখন লাগা উচিত যখন দেশের শতকরা পাঁচভাগ মানুষও শুদ্ধভাবে নিজের জাতীয় সংগীত গাইতে পারে না। জাতীয় সংগীত সিনেমা হলে এখনও বাজলে দাঁড়ানোর প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন না। জানেন কী সে পরিসংখ্যান যে ইংরেজির পাশাপাশি, কতভাগ বাংলা ভাষাভাষি শুদ্ধ বাংলায় বানান ভুল না করে এক প্যারাগ্রাফ লিখতে পারেন? জানাটা যে বড্ড জরুরী।
আরেকটা বিষয়, যে কোনো গান আপলোডের ক্ষেত্রে ইউটিউব ভীষণভাবে কপিরাইট সচেতন। যথাযথ কর্তৃপক্ষ কপিরাইট বিষয়ক আপত্তি জানালে, ইউটিউব সাথেসাথে সে ভিডিও নামিয়ে ফেলবে। আর এত সব বড়বড় বাজেটের প্রজেক্টে সংগীতায়োজন করা সুরকার হিসাবে এ আর রাহমান নিশ্চিতভাবেই গানের কপিরাইট বিষয়ক অনুমতি নিয়েই গানটার নতুন সুর করেছেন বলে ধরা যেতে পারে।
বি: দ্র: গানটা আমার কেমন লাগলো? একদম ভালো লাগেনি। কিন্তু আমি এটাকে কোনো স্পর্ধা হিসাবে দেখছি না। আমার ভাষা, আমার অনুভূতি বোঝার দায় ঠ্যাকা অন্যভাষার মানুষের উপর চাপিয়ে দেয়াটা কাজের কিছু নয়।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন