হেডফোন কানে গুঁজে হাঁটতে হাঁটতে ঢাকা শহরকে এক অন্য লেন্স থেকে দেখার অভ্যাস হয়ে গেছে বলা চলে। ফুটপাথ আটকে মুড়ি-চানাচুর বিক্রি করেন যিনি, তাকে আর তার খদ্দেরের ভিড়কে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত মাথায় এক ধরনের রাগ কিলবিল করতে করতে থেমে যায়। সামনে এগোলেই এখন দেখতে পাই মোজার দোকান, জুতার পসরা, শীতের জ্যাকেট থেকে শুরু করে আতর কিংবা কোরআন শরীফ—ঠিক কোন জিনিসটা ফুটপাথে বিক্রি করা হয় না, সেটা বের করা সম্ভব না। হয়তো বেচাবিক্রির শুরুর প্রসেসটা ফুটপাথে শুরু হয়, শেষ হয় দোকানের বড় ক্যাশ কাউন্টারে।
একসময় এই ভিড় ঠেলতে গেলেই মনের মধ্যে ক্ষোভ কিংবা রাগের মিশ্রনে তৈরি হওয়া ক্যামিকেলগুলো ধমনী বেয়ে বেয়ে মস্তিষ্কে ছুটে যেত। ফুটপাথে হাঁটতে গেলেই হুট করে এক এক করে মোটরসাইকেল উঠে আসতে দেখলে ভয়ে ঘাবড়ে যাওয়ার উপক্রম হতো। সম্মানের সাথে সাইড দিয়ে আবার চলতে শুরু করতাম মাসকয়েক আগেও।
ফুটপাথ থেকে বাসে উঠে বসতে না বসতেই আজকাল হিজড়া গোষ্ঠী এসে টাকা চায়। কথা না শোনার ভান করে বসে থাকলে ধাক্কা দেয়। চোখের সামনে অনেককে হেনস্তা করতেও দেখেছি। দেখেছি জামা খুলতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত নিজেকে সংযত রাখতে পারেন এমন কাউকে কাউকে পর্যন্ত অবশ্য।
বাসা থেকে বের হওয়ার পর থেকেই পুরো শহুরে জীবন আমার কাছে অনর্থক এক যাপন বলেই মনে হতো। একপ্রকার অর্থহীন নাগরিক ভিড়ভাট্টা, হৈচৈ, মারামারি ইত্যাদি ইত্যাদি। এটা থেকে বের হয়ে যাওয়ার সুযোগও নেই, আবার একে আপন করে নেওয়ার মতো মানসিক বিলাসিতাও দেখাতে পারতাম না বলে এক রকম ব্রাত্য হয়েই চলছিলো জীবন।
তবে জীবন বদলে যায় হেডফোনের সুবাদে। কানে হেডফোন গুঁজেই এখন বাসা থেকে বের হই। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মানুষের চলাচল দেখতে পাই আগের মতো। ট্রাফিকে আটকে থাকা সারি সারি মোটরসাইকেল দেখে আর অর্থহীন মনে হয় না কেন যেন। যখন যে গান বাজে, সেই গানের অর্থ ভর করে চোখের সামনের দৃশ্যের ওপর।
এই যেমন ফুটপাথ পার হতে হতে আহমেদ হাসান সানির গান শুনলে মনে হয় শহরটা একেবারেই বসবাসের অযোগ্য হয়ে গেছে, এমনও না। আরেকটু প্ল্যান করে গোছাতে পারলে হয়তো স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারব। ঠিক একই রাস্তায় হাঁটার সময় গান শাফল হতে হতে কখনো যদি ভুল করেও কোনো মেটাল গান বাজতে আরম্ভ করে, আর চোখের সামনে দুটো মোটরসাইকেলকে ফুটপাথে উঠতে দেখি, হাঁটতে হাঁটতে দুই হাতে দুইটা কুড়ালের অস্তিত্বকে মিস করি। হাতে দুইটা কুড়াল থাকলে হয়তো ক্যারাটে মুভ দিয়ে একের পর এক ফুটপাথে উঠে আসা মোটরসাইকেল কোপাতে পারতাম ব্রুস লির মতো।
আপাত দৃষ্টিতে যে বিষয়গুলো একসময় অনর্থক লাগতো, সেগুলোর অর্থও কিভাবে কিভাবে যেন ধরা দিচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে দেখি দুজন প্রেমিক-প্রেমিকা রিকশায় হাত ধরে বসে আছে, তাদের দিকে বাঁকা দৃষ্টির ক্ষেপণাস্ত্রের হামলা করছেন কেউ কেউ। আবার ভিড়ের মধ্য থেকে এদের একজনের পকেট কাটছে পকেটমার। সেই পকেটমারকে দূর থেকে দেখে হাসছে তার পরিচিত কোনো এক ভাই-ব্রাদার। সব কিছুই একত্রে কিভাবে যেন বৃক্ষের মত শাখা প্রশাখার মত বেড়ে উঠেছে, শ্বাস নিচ্ছে এক বাতাসে।
এভাবে অনেক দূর এগোতে এগোতে একসময় মনে হচ্ছে যে, এই সমাজে, এই সময়ে, এই দেশে যা কিছু হচ্ছে, আসলে সবই অনর্থক। কোটি কোটি অনর্থক কাজ করা মানুষের আলাদা আলাদা নেয়া ডিসিশনে শেখ হাসিনা যেমন ক্ষমতায় এসেছিলেন, তেমনি দেশ ছেড়েও পালিয়েছেন।
আসলে এতসব অনর্থকে একত্র করলেই অর্থের কাছাকাছি পৌছা সম্ভব হয়ত। প্রত্যেকটা আলাদা ঘটনাই একেকটা পাজল, আর আপনি, আমি, আমরা সেই পাজলকে কিভাবে মেলাব, আদৌ মেলাব কিনা, সেটা নির্ভর করছে কতটুকু বুঝতে চাই আর কতটুকু এড়িয়ে গিয়ে বাঁচতে চাই।
এই শহরের অনর্থগুলো একত্র করলে হয়তো আসল অর্থ খুঁজে পাওয়া সম্ভব। হয়তো একদিন এই অনর্থগুলোই অর্থ হয়ে ধরা দেবে।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন